রজব ১৪৩৬   ||   মে ২০১৫

শতবর্ষী মনীষীর পড়ন্ত বেলা

শরীফ মুহাম্মদ

বিছানায় একা শুয়ে আছেন। শতবর্ষী কীর্তিমান মনীষী। শুধু মুখটা নড়ছে। শব্দ অস্পষ্ট। উপস্থিত কেউ কেউ বলছেন, যিকিরের সঙ্গে শ্বাস গ্রহণের শব্দ হচ্ছে। হাত-পা তাঁর কিছু কিছু নড়ছে। চোখের পাতায় অল্প উঠানামা। প্রথমে মনে হতে পারে সেন্স বা বোধ একদম নেই। বাস্তবে সেরকম নয়। আমরা কয়েকজন নতুন মানুষ তার বিছানার পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। এটা স্পষ্টতই তিনি বুঝতে পেরেছেন। ঘুরে একটু তাকিয়েছেন। তারপর মুসাফাহার জন্য একটি হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। শীর্ণ সে হাত আমরা হাতের মধ্যে নিয়েছি। স্পর্শ নিয়েছি, স্পর্শ করেছি। মাসনুন দুআয় কয়েকটি মুহূর্ত এভাবেই কেটেছে গত ৩ মার্চ মঙ্গলবার বাদ এশা।

কে এই শতবর্ষী মনীষী? তিনি কুরআন শরীফের এক কিংবদন্তিতুল্য খাদেম। বাংলাদেশে সর্বজনীন পর্যায়ে শুদ্ধ কুরআন তেলাওয়াত চর্চার এক মহান শিক্ষক। কুরআনের হাজার হাজার শিক্ষকেরও শিক্ষক। উস্তাযুল মুআল্লিমীন। নুরানী কুরআন শিক্ষাধারার বরেণ্য প্রবর্তক মাওলানা ক্বারী বেলায়েত হোসাইন ছাহেব দা. বা.। তাঁর শাগরিদের অনেকের বয়স এখন সত্তর ছুঁয়েছে। প্রাচীন বড়কাটারার ছাত্র হিসেবে তিনি হযরত ছদর ছাহেব হুযুর রাহ. এবং হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.- উভয়েরই ছাত্র। হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর খলীফা। তাঁর জন্ম ১৯০৭ কিংবা ১৯০৮ সালে। অবুঝ শৈশবেই তিনি ছিলেন মা-বাবা হারা ইয়াতীম। দরদী আত্মীয় ও অভিভাবকদের ছায়ায় দ্বীনী ইলম অর্জন। এরপর কুরআনী তালীমের মেহনতে ত্যাগ ও সাধনাবহুল এক দীর্ঘ জীবন। শুরু গওহরডাঙ্গা মাদরাসা থেকে। তারপর ঢাকার ফরিদাবাদ। চাঁদপুরের জাফরাবাদ হয়ে চাঁদপুর গনি হাইস্কুল মসজিদে দীর্ঘ দিন। কিছুদিন আশরাফাবাদ মাদরাসায়ে নূরিয়ার প্রথম সময়ে। এর মধ্যে বড় একটি কাল রোজগারহীন-বেতনহীন তাওয়াক্কুলের সংসার। কিছুদিন দেশজুড়ে কুরআনের শিক্ষকদের প্রশিক্ষণদান। ভাসমান, ভ্রাম্যমান। কুরআন কেন্দ্রিক আবেগ আর ত্যাগের এক দাস্তান। ৮০-র দশকের গোড়ায় মোহাম্মাদপুরে নূরানীর একটি ঠিকানা। তখন তিনি সত্তরের কোঠায়।

নুরানী, নাদিয়া, নুরিয়াসহ পবিত্র কুরআনের সহীহ উচ্চারণ শেখার বিভিন্ন পদ্ধতি এদেশে এখন প্রচলিত। বুযুর্গ উলামায়ে কেরামের মেহনত, গবেষণা ও পৃষ্ঠপোষকতা এসবের সঙ্গে সম্পর্কিত। কিন্তু সমকালে এদেশে এ ধারার প্রথম পদক্ষেপ ছিল নুরানী। আর সেই নুরানীর প্রবর্তক হিসেবে তাঁর অবদান ও ভমিকা অবিস্মরণীয়। শিশু থেকে বৃদ্ধ-পবিত্র কুরআনের সহীহ তেলাওয়াত শেখার সববয়সী ছাত্রদের কাছে তিনি অত্যন্ত সুপরিচিত ও সম্মানীয়। শত বছর পেরুনো এই মনীষী গত প্রায় দুবছর যাবত শয্যাশায়ী। এরই মধ্যে বেশ কয়েকবার বাসা-হাসপাতাল করতে হয়েছে। শ্যমলী-মোহাম্মাদপুর রিংরোড ধরে সামনে গেলেন সূচনা কমিউনিটি সেন্টারের বিপরীতে রাস্তার পাশের ভবনের দোতলায়। নিজের বাসার একটি কক্ষে তিনি এখন শায়িত। এ ভবনেই এখন তার সন্তানরা বসবাস করেন।

কুরআনের সহীহ উচ্চারণে নিবেদিত জীবন ও যবান এখনও সচল। সে যবান অবশ্য এখন ক্লান্ত ও বিশ্রামপ্রবণ। সে জীবন এখন শয্যাশায়ী, মুমূর্ষু। বিমর্ষ মনে আমরা তাঁর সামনে দাঁড়ানো। শ্যামলী মাদরাসাতুল কুরআনিল কারীমের মাওলানা আতীকুল্লাহ, মোহাম্মাদপুরের সেবক-আলেম মাওলানা রজীবুল হক এবং মাওলানা ইউসুফ ফরহাদ। চারজনের দলটি অল্প কিছুক্ষণ পরই পথে নেমে এলাম। জীবনের পড়ন্ত বেলায় কুরআনে পাকের এই মহান খাদেমের জন্য আসুন- আমরা সবাই দুআ করি। 

 

 

 

advertisement