সফর ১৪৩১   ||   ফেব্রুয়ারী ২০১০

একটি প্রচলিত বর্ণনা : প্রশ্ন ও তার উত্তর

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

প্রশ্ন করেছেন মুহাম্মাদ আবদুল মাজীদ, রংপুর থেকে।

প্রশ্ন : গত মাসে ‘আলকাউসারের প্রচলিত ভুল বিভাগে কে হাদীস নয় বলে লেখা হয়েছে। সেখানে অনেক কিতাবের হাওয়ালা উল্লেখ করা হয়েছে। কিন' আমি আল্লামা ইসমাঈল আজলুনী লিখিত ‘কাশফুল খাফা’ নামক কিতাবে এবং আহসানুল ফাতাওয়ায় এ সম্পর্কিত বিস্তারিত একটি আলোচনা দেখেছি। যাতে প্রমাণ করা হয়েছে যে, এই হাদীসটি ভিত্তিহীন নয়। অতএব হাদীসটি যদি বাস্তবেই ভিত্তিহীন হয় তাহলে এই আলোচনার জবাব কী হবে? যদি এই হাদীসটির ভিত্তি প্রমাণিত হয় তাহলে যারা এর দ্বারা প্রমাণ করতে চায় যে, তৎকালীন যুগে চীনে তো দ্বীনি শিক্ষা ছিল না; বরং জাগতিক জ্ঞান-বিজ্ঞানই ছিল। অতএব জাগতিক শিক্ষাও দ্বীনী শিক্ষার্জনের মতোই ফরয। আবার কোনো কোনো সেক্যুলার লেখক বলেছেন যে, এর দ্বারা নবী চীনে গিয়ে সেক্যুলার জ্ঞান আহরণ করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন! তাঁদের এসব কথাই বা কতটুকু প্রামাণ্য? বিস্তারিত জানিয়ে খুশি করবেন বলে আশা রাখি।

উত্তর : আপনি এ প্রসঙ্গে ‘কাশফুল খাফা’ ও ‘আহসানুল ফাতাওয়া’ গ্রন্থদুটির উদ্ধৃতি উল্লেখ করেছেন। কিন্তু উক্ত কিতাবদ্বয়ে যে তাসামূহ (ভুল) হয়েছে তা আপনি লক্ষ্য করেননি। আসলে এখানে দু’টি পৃথক বাক্য রয়েছে। একটি হল, আর অপর বাক্যটি হল প্রথম বাক্যটি বহু সনদে বর্ণিত হয়েছে। যার মধ্য থেকে কোনো সনদে দুর্বলতা তুলনামূলক কম। এজন্য ইমাম আবুল হাজ্জাজ আলমিযযী বলেছেন, এই বর্ণনাটি সমষ্টিগতভাবে ‘হাসান’ পর্যায়ের হতে পারে। ইমাম উকায়লী রাহ.-এর যে আলোচনা আমরা গত সংখ্যায় উল্লেখ করেছি তাতেও এর প্রতি ইঙ্গিত রয়েছে। তিনি বলেন, (আযযুআফাউল কাবীর ২/২৩০) পক্ষান্তরে দ্বিতীয় বাক্যটি শুধু একটি সনদে বর্ণিত। যার মধ্যে আবু আতিকা নামক একজন রাবী রয়েছে, যে মাতরূক ও মুত্তাহাম অর্থাৎ পরিত্যাজ্য ও মিথ্যার অভিযোগে অভিযুক্ত। এজন্য ইমাম উকায়লী রাহ. এই বাক্য সম্পর্কে বলেন, অর্থাৎ এই বর্ণনা সংরক্ষিত নয়। ইমাম ইবনে হিব্বান রাহ. তো সরাসরি বাতেল ও ভিত্তিহীন বলে আখ্যা দিয়েছেন। (আলমাকাসিদুল হাসানাহ : ৮৬) মুহাদ্দিস আহমদ আলগুমারী এর সনদসমূহের উপর একটি পৃথক পুস্তিকা রচনা করেছেন, যা নামে প্রকাশিত হয়েছে। এটি অধ্যয়ন করলে দেখা যাবে যে, এত সনদের মধ্যে এক আবু আতিকার বর্ণনা ছাড়া অন্য কোনো সনদে বাক্যটি নেই। আর থাকলেও তা রয়েছে আহমদ ইবনে আবদুল্লাহ আলজুয়াইবারীর বর্ণনায়, যে মারাত্মক ধরনের মিথ্যাবাদী এবং নির্লজ্জ হাদীস জালকারীকিংবা ইয়াকুব ইবনে ইসহাক এর মতো আরেক মিথ্যাবাদীর বর্ণনায়।- দেখুন : আলকামিল, ইবনে আদী ১/২৯২; মীযানুল ই’তিদাল ১/১০৬; লিসানুল মীযান ৮/৫২৫-৫২৬ কাশফুল খাফা ও আহসানুল ফাতাওয়ার তাসামূহ এটিই যে, বর্ণনা সম্পর্কে মুহাদ্দিসগণের সিদ্ধান-কে এর সঙ্গে যুক্ত করে দিয়েছেন। এ সম্পর্কে উদ্ধৃত কিতাবগুলো যদি আপনি সরাসরি অধ্যয়ন করতেন এবং মনোযোগের সাথে মুতালাআ করতেন তাহলে এই ভুল ধারণার শিকার হতেন না। আপনি বায়হাকীর ‘শুআবুল ঈমান’ (২/২৫৪), খতীবে বাগদাদীর ‘তারীখে বাগদাদ’ (৯/৩৬৪), ইবনে আবদুল বারের ‘জামিউ বায়ানিল ইলম’ (১/৯), অধ্যয়ন করলে দেখতেন যে, সকলের সনদে উক্ত আবু আতিকা রয়েছে। আর মিযযী ও যাহাবীর বক্তব্য মূল কিতাব থেকে দেখলে স্পষ্ট হয়ে যেত যে, তাদের বক্তব্য তালাবুল ইলমি ফারিযাহ’ সম্পর্কে, ‘ওয়ালাও বিছছীন’ সম্পর্কে নয়। আর আজলুনীর বক্তব্য (কাশফুল খাফা ১/১২৪) সুস্পষ্ট ভুল। মুসনাদে আবু ইয়া’লা প্রকাশিত হয়েছে। আপনি এই কিতাবের তৃতীয় খণ্ডের ২০৫ (২৮২৯) ও ২২৩ (২৮৯৬) নং পৃষ্ঠা অধ্যয়ন করলেও দেখবেন, বর্ণনাটি শুধু ‘তালাবুল ইলমি ফারিযাতুন আলা কুল্লি মুসলিম’ পর্যন্ত রয়েছে, তাতে ‘উতলুবুল ইলমা ওয়ালাও বিছছীন ’নেই। মোটকথা, আমাদের আলোচিত বাক্য শুধু একটি প্রবাদমাত্র, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর হাদীস নয়। কোনো কাযযাব বা মুত্তাহাম রাবী এটিকে হাদীস হিসাবে বর্ণনা করেছে, যার কোনো ভিত্তি নেই। দরসে নিযামীর ছাত্রদের অজানা নয় যে, মুখতাসারুল মাআনী গ্রন্থে ভুলবশত এটিকে হাদীস বলা হয়েছে। তাই হযরত শায়খুল হিন্দ রাহ. বায়নাস সুতুর-এ লিখেছেন, সুতরাং যখন তা হাদীস হওয়াই প্রমাণিত নয় তখন এর অর্থ ও মর্ম সম্পর্কে আলোচনা করা এবং এ কথা বলা যে, নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এখানে ‘ ইলম’ দ্বারা কোনইলম উদ্দেশ্য করেছেন-এটি একটি অর্থহীন কাজ। কেননা, এটি তো তাঁর বাণীই নয়। ফলে এই প্রশ্নেরই তো অবকাশ নেই যে, এ দ্বারা তিনি কী উদ্দেশ্য করেছেন? আর এটিকে যদি হাদীস বলে মেনেও নেওয়া হয় তাহলে এখানে ইলম দ্বারা তা-ই উদ্দেশ্য হবে যা তাঁর অন্যান্য ইরশাদাতের মধ্যে উদ্দেশ্য। অর্থাৎ ইলমে ওহী ও ইলমে দ্বীন। ফলে বাক্যটির অর্থ হবে ‘ইলমে দ্বীনের জন্য দূর দূরান্তে সফরের প্রয়োজন হলেও তা অর্জন কর। (ফয়যুল কাদীর, মুনাবী ১/৫৪৩) সেক্যুলারিজম তো কোনো ইলমই নয়; শুধু মূর্খতা ও অন্ধকার। যা দূর করে ইলমে নবুওয়ত ও ওহীর আলো ছড়ানোর জন্যেই প্রেরিত হয়েছেন সকল নবী-রাসূল, এবং সর্বশেষে হযরত মুহাম্মাদ মোস-ফা সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। যিনি কিয়ামত পর্যন- আগত সকলের নবী। আর কাওনী ইলম তথা জাগতিক বিদ্যার উপকারী অংশ প্রয়োজনীয় হলেও তার প্রয়োজনীয়তার অনুভূতি মানুষের স্বভাবের মাঝেই বিদ্যমান, এর জন্য নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর যবানে তারগীব (উৎসাহ প্রদান) উচ্চারিত হবার কোনো প্রয়োজন নেই। তাই এ বিষয়ে সরাসরি কোনো স্পষ্ট বাণী সহীহ সনদে পাওয়া যায় না। ষ

 

advertisement