জুমাদাল আখিরাহ ১৪৩৬   ||   এপ্রিল ২০১৫

তাওহীদের ক্ষেত্রে প্রান্তিকতা: দুটি উদাহরণ

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

প্রান্তিকতা বাংলায় একটি সুন্দর শব্দ যা দুই প্রান্তকেই বোঝায়। বাড়াবাড়ি-ছাড়াছাড়ি, ইফরাত-তাফরীত দুটোকেই বোঝায়। সব বিষয়ের মতো তাওহীদ-বিষয়েও প্রান্তিকতা আছে। এক ইফরাত ফিত তাওহীদ, অর্থাৎ আপনি তাওহীদের বিষয়ে এমন প্রান্তে গিয়ে পৌঁছলেন যে, তাওহীদ পরিপন্থী নয় এমন অনেক কিছুকে তাওহীদ পরিপন্থী বলা শুরু করলেন। আর তাফরীত ফিত তাওহীদ হল, তাওহীদের ক্ষেত্রে শৈথিল্য প্রদর্শন করতে করতে এমন প্রান্তে গিয়ে পৌঁছলেন যে, এখন তাওহীদ পরিপন্থী জিনিসকেও বলেন তাওহীদ পরিপন্থী নয়। নাউযুবিল্লাহ।

তাওহীদের ক্ষেত্রে উভয় প্রান্তিকতাই আমাদের বর্জন করতে হবে। প্রান্তিকতা যে দিকেরই হোক এর অর্থ হল, তাওহীদের ক্ষেত্রে মাঝামাঝি রাস্তা থেকে সরে যাওয়া। একটি কাজ তাওহীদ পরিপন্থী কিন্তু আমি মনে করলাম তাওহীদ পরিপন্থী নয়। আবার তাওহীদ পরিপন্থী নয় কিন্তু আমি মনে করলাম তাওহীদ পরিপন্থী দুটোই নিন্দনীয় এবং দুটোই বর্জনীয়। বিষয়টি উদাহরণের মাধ্যমে আরো স্পষ্ট হয়ে যাবে।

তাওহীদ পরিপন্থী কিন্তু মনে করা হচ্ছে তাওহীদ পরিপন্থী নয়-এর উদাহরণ হল, বেরলবীগণ। কিছু কাজ যা তাওহীদের জন্যে একেবারে প্রাণঘাতী, তাওহীদের সাথে পুরোপুরি সাংঘর্র্র্ষিক কিন্তু বেরলবীগণ বলেন, না, এটা তাওহীদ পরিপন্থী না।

আগে বেরলবীদের পরিচয়টা সংক্ষেপে বলি। আহমাদ রেযা খানের অনুসারী যারা তাদেরকে বলা হয় বেরলবী।  আহমাদ রেযা খান যেহেতু বেরেলীর অধিবাসী ছিল, তাই তার অনুসারীদেরকে বলা হয় বেরলবী। আবার তার নামের একটা অংশ যেহেতু রেযাখান তাই তার দলের এক নাম রেযাখানী। রেযাখানীকে সংক্ষেপে বলা হয় রেজভী।

 হিন্দুস্তানে বেরেলী নামে দুটি জায়গা আছে। একটি জায়গার নাম রায়বেরেলী, আরেকটার নাম শুধু বেরেলী। রায়বেরেলী ভালো জায়গা। আবুল হাসান আলী নদভী রাহ.-এর বাড়ি। তার পূর্বপুরুষরাও অনেক বড় বড় বুযুর্গ ছিলেন। তাদের কবর সেখানে আছে। নদভী রাহ.-এর খান্দানের একজন বুযুর্গের নাম শাহ আলামুল্লাহ রাহ. তার কবরও রায়বেরেলীতে। সাইয়েদ আহমাদ শহীদ রাহ.ও রায়বেরেলীর অধিবাসী। সাইয়েদ আহমাদ শহীদকে যে বেরেলবী বলা হয় তা কিন্তু আহমাদ রেযাখানের বেরেলীর কারণে নয়। বরং এই রায়বেরেলীর কারণে। লখনৌ  থেকে রায়বেরেলী যেতে লাগে দুই ঘন্টা আর বেরেলী যেতে লাগে ছয় ঘন্টা। বেরেলী তো  আসলে আহমাদ রেযাখানের না। বেরেলীতে আহমাদ রেযাখানের আগে ও পরে আকাবিরে  দেওবন্দ, আহলে সুন্নাত ওয়াল জামাতের  অনেক আলিম ছিলেন।

তো আমি তাদের তিনটি নাম বললাম- রেজভী, রেযাখানী, বেরলভী। কিন্তু তারা তাদের নাম দিয়েছে সুন্নী। আর আহলে  হকের নাম দিয়েছে, ওয়াহাবী। তাদের মতে, সুন্নী হল তাদের সংক্ষিপ্ত নাম। পুরো নাম, আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাআহ। এবং আহমাদ রেযাখানের লকব হল, ইমামে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ। আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআর ইমাম! নাউযুবিল্লাহ! পাকিস্তান ভারত বাংলাদেশ এই এলাকায় তারা আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহ নামটি দখল করে নিয়েছে। আমরা কেন যেন এ দিকে খুব একটা গুরুত্ব দেই না। এ বিষয়টি আমাদের খুব গুরুত্ব দিয়ে ভাবা উচিত।

এই বেরলবীদের নিকট বুযুর্গদের কবর তাওয়াফ করা জায়েয! এটা কোনো শিরকি কাজ নয়! এমনকি তারা একথাও বলে, বুযুর্গদের কবরে সিজদা করা জায়েয। কারণ কবরে যে সিজদা করা হয় সেটা সম্মানের সিজদা, ইবাদতের সিজদা নয়। কিন্তু আল্লাহর কী কুদরত! আহমাদ রেযাখানের কলমে বের হয়ে গেছে সম্মানের জন্যে কারো কবরে সিজদা করা নাজায়েয। কট্টর বেদআতী হওয়া সত্তে¡ও সে লিখেছে, কারো কবরে সম্মানসূচক সিজদা নাজায়েয। অবশ্য তার পক্ষের লোকেরা বাস্তবে এটার উপর নেই।

ছেলে হারিয়ে গেছে বা কঠিন কোনো রোগে আক্রান্ত হয়েছে,তো ছুটে যাচ্ছে আটরশী,সুরেশ্বর, দেওয়ানবাগ,মাইজভাণ্ডারে। আহ! কত বড় আফসোসের কথা। মক্কার মুশরিকরা সাধারণ কোনো বিপদে পড়লে তাদের দেবদেবীর কথা স্মরণ করত। তাদের জন্যে মানত করত। কিন্তু বড় কোনো বিপদে পড়লে আল্লাহকে ডাকত,আল্লাহর কথা স্মরণ করত। অথচ মুসলিম নামধারণ করেও আজ তাদের খাসলত হল, যেকোনো বিপদেই তারা স্মরণ করে মাযারকে।  শরণাপন্ন হয় বাবার দরবারে। এ সকল কর্মকাণ্ড যে শিরক এতে কোনো সন্দেহ নেই। কিন্তু বেরলবীগণ বলছেন, এখানে দেখতে হবে, তারা যে বাবার কাছে চাচ্ছে কী নিয়তে চাচ্ছেযদি এই নিয়তে চায় যে, বাবা আল্লাহর কাছ থেকে নিয়ে দেবেন তাহলে এটা শিরক হবে না। যদিও সে মুখে বলে, বাবা দেন! বাবা দেন! এটা তাওহীদের ক্ষেত্রে এক প্রান্তিকতা। এটা হল, তাফরীতের উদাহরণ।

আরেক প্রান্তিকতা হল, তাওহীদ পরিপন্থী নয় কিন্তু বলা হচ্ছে তাওহীদ পরিপন্থী। এই গোমরাহী নতুন কিছু নয়। এর সিলসিলা অনেক আগের যেমন- গোমরা ফেরকাগুলোর মধ্যে এক ফেরকা হল মুতাযিলা।  তারা নিজেদের নাম দিয়েছে আসহাবুল আদলি ওয়াত তাওহীদ অর্থাৎ ইনসাফ ও তাওহীদওয়ালা জামাত। তাদের নামটিই কিন্তু তীর্যক নাম। নামের মধ্যেই এই খোঁচা আছে যে, অন্যরা  কেউ তাওহীদওয়ালা নয়।

ইতিযাল মানে পৃথক হওয়া। মুতাযিলা মানে পৃথক, আলাদা। প্রথম যিনি আলাদা  হয়েছেন তিনি হযরত হাসান বসরী রাহ.-এর সাথে তাকদীরের মাসআলা নিয়ে এখতেলাফ করে তার মজলিস থেকে আলাদা হয়েছিলেন। সেখান থেকে উৎপত্তি হয় মুতাযিলার। মানে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআহর ইমামদের থেকে আলাদা পৃথক সম্প্রদায়। তাদের কথা হলহাসান বসরী এবং আহলুসসুন্নাহ ওয়াল জামাআহর তাওহীদের আকীদা বিশুদ্ধ নয়। কারণ তারা তাকদীরের উপর ঈমান রাখেন। আর তাকদীরের বিশ্বাস তাওহীদের পরিপন্থী!

তাওহীদের শিক্ষা আমরা পেয়েছি রাসূলে কারীম সল্লাল্লাহু আলাইহিওয়া সাল্লামের কাছ থেকে। রাসূলুল্লাহ সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে তাওহীদের কথা ঈমানের কথা জিজ্ঞাসা করা হল। তিনি তাওহীদের সংজ্ঞা দিতে গিয়ে বললেন,

أن تؤمن  باالله وملائكته و كتبه و رسله و اليوم الآخر و القدر خيره و شره من الله تعالى و البعث بعد الموت  ..... 

তো রাসূল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঈমানের সংজ্ঞার মধ্যে বললেন, তাকদীরের উপর আকীদা রাখার কথা আর মুতাযিলাগণ বলছে, তাকদীরে ঈমান রাখা তাওহীদ পরিপন্থী। এ হল আরেক প্রান্তিকতা।

বেরলবীগণ তো তাওহীদ পরিপন্থী বিশ্বাস ও কর্মকাণ্ডকে তাওহীদ পরিপন্থী বলছেন না। স্পষ্ট শিরকও তাদের কাছে তাওহীদ পরিপন্থী নয়। আর মুতাযিলীগণ কুরআন-সুন্নাহয় অকাট্যভাবে বর্ণিত আকিদাকে বলছেন তাওহীদ পরিপন্থী। সুতরাং তাওহীদের ক্ষেত্রে  দু দলই ভয়াবহ প্রান্তিকতার স্বীকার।

তাওহীদ পরিপন্থী নয় এমন জিনিসকে তাওহীদ পরিপন্থী বলার ধারাবাহিকতায় এখন কিছু সংখ্যক সালাফি বন্ধুও কিছু কিছু ক্ষেত্রে বাড়াবাড়ি করেন। সবার কথা বলছি না। যেমন ধরুন একটা জিনিস এভাবে হলে বেদআত হবে, এভাবে হলে শিরক হবে, এভাবে হলে সুন্নত হবে, এভাবে হলে মোবাহ হবে এভাবে একটা জিনিসের বিভিন্ন আঙ্গিক ও পর্যায় রয়েছে। কিন্তু কিছু সংখ্যক সালাফী ভাই আজ সবগুলোকে ঢালাওভাবে বলে দেন  শিরক। যারা পেশাদার আহলে হাদীস তারা আজ চোখ বন্ধ করে তাকলীদকে শিরক বলে দিচ্ছেন!

এভাবে আরো অনেক উদাহরণ আছে,যা প্রান্তিকতার মারাত্মক উদাহরণ এজন্যে আমাদেরকে সীরাতে মুস্তাকীম ধরতে হবে। প্রান্তিকতামুক্ত সরলপথে কোনটি তা বুঝতে হবে। আল্লাহ তাওফীক দান করুন। আমীন!

[রমযান ১৪৩৫হি. - এর ইতিকাফে মারকাযুদ দাওয়াহ-এর মসজিদে কৃত বয়ান থেকে গৃহীত]

 

 

 

 

advertisement