জুমাদাল উলা ১৪৩৬   ||   মার্চ ২০১৫

মুসলমানদের মাঝে ঈমান ও ইসলামী ভ্রাতৃত্বের ঐক্য সৃষ্টির চেষ্টা করুন একই দিনে ঈদ-প্রসঙ্গ দায়িত্বশীলদের উপর ছেড়ে দিন-১৭

মাওলানা মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক

 চান্দ্রমাস: একটি পর্যালোচনা

বিশ্বব্যাপী একই দিনে/বারে ও তারিখে রোযা/ঈদ পালন করতে হবে

(কোরআন,সুন্নাহ ও জ্যোতির্বিজ্ঞানের আলোকে মুসলিম বিশ্বের জন্য একটা জরুরী পরামর্শ ও যুগান্তকারী সংস্কার)

লেখক : ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মাদ এনামুল হক

নবম সংস্করণ,পরিবর্ধিত,পরিমার্জিত ও পরিশীলিত

যিলহজ ১৪৩১ হি.,ডিসেম্বর ২০১০ ঈ.,মাস্ পাবলিশার্স (৩/বি,কলাবাগান,ঢাকা)

 

জনাব ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মাদ এনামুল হকের এই বইয়ে বর্তমান সংস্করণ অনুযায়ী পৃষ্ঠা সংখ্যা হচ্ছে দুইশ চল্লিশ। পর্যালোচনার উদ্দেশ্যে আমাদের হাতে আসা বই-পুস্তকের মধ্যে কলেবরের দিক থেকে এটিই বৃহৎ। কিন্তু এতে পুনরুক্তি ও পৌনঃপুনিকতা এত পরিমাণ যে, তা পাঠকের জন্য খুবই বিরক্তিকর। ভুল ব্যাখ্যা, অসংলগ্ন কথা এবং স্ববিরোধী বক্তব্যের দিক থেকে এই বই এক কথায় অসাধারণ, যাকে বলে বেনযীর! এর উপর বিস্তারিত পর্যালোচনা লিখতে শুরু করেছিলাম। একশ পৃষ্ঠার মতো লেখা হয়েও গিয়েছিল। পরে দেখলাম, এত দীর্ঘ ও বিস্তারিত আকারে লিখতে থাকলে প্রায় তিনশ পৃষ্ঠা লেগে যাবে। যা একটি মাসিক পত্রিকায় তো বটেই, এমনকি কোনো বইয়ের অন্তর্ভুক্ত করা হলেও পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটবে। তাই দীর্ঘ আলোচনায় না গিয়ে পাঠকবৃন্দের জন্য এখন একটি সংক্ষিপ্ত পর্যালোচনা তুলে ধরছি নীচের লাইনগুলোতে:

যেমনটি আমি এইমাত্র বললাম, এই বইয়ের ভুল ও বিচ্যুতি এবং অপব্যাখ্যা ও অবান্তর দাবি এবং নিজের কথার মধ্যেই বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতার তালিকা অনেক লম্বা। সেজন্য খুব সংক্ষেপে শুধু ছয়টি শিরোনামে কিছু বিষয় উপস্থাপন করছি। শিরোনামগুলো এই:

১. ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সংস্কার কর্মের স্বরূপ

২. হিলাল-এর অর্থ বিকৃতি : একসঙ্গে অনেক বিভ্রান্তি

৩. আল-বেরুনী কী বলেছেন?

৪. বৈপরীত্য ও স্ববিরোধিতা

৫. ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের লেখায় নতুন জিনিস কী?

৬. প্রকাশ্য মিথ্যাচার

১. ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের সংস্কার-এর স্বরূপ

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের দাবি, এই বই লিখে তিনি এক বিশাল বিপ্লবী কাজ করেছেন। (তার ভাষায় যা হল, যুগান্তকারী সংস্কার) এবং এর মাধ্যমে হাজার বছর বরং তারও বেশি সময় ধরে চলে আসা ভুলের তিনি সংশোধন করেছেন। তার বক্তব্য মতে, তার এই সংস্কার কর্মের ভিত্তি হচ্ছে, সূরা বাকারা ১৮৯ নং আয়াতের প্রথম অংশ:

يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ

-এর তরজমা সংশোধন এবং এতে هلال -এর সংজ্ঞা পুনঃনির্ধারণ। তার দাবি, মুফাসসিরগণ এ আয়াতের সঠিক ব্যাখ্যা উপস্থাপন করতে পারেননি এবং যারা কুরআনের তরজমা করেছেন তারাও এর ভুল তরজমাই করে গেছেন। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব এসে সেই ভুলের প্রতিকার করেছেন এবং আয়াতের শুদ্ধ তরজমা ও বিশুদ্ধ অর্থ নির্ধারণ করতে সমর্থ হয়েছেন। তার বক্তব্য, যদি এই সংশোধনকে গ্রহণ করা হয় তাহলে রোযা ও ঈদ-প্রসঙ্গে চলমান সমস্ত বিতর্ক ও বিশৃঙ্খলার অবসান ঘটবে! (দেখুন: চান্দ্রমাস, সপ্তম সংস্করণ, পৃ. ১৩, ১৫, ৪১, ৫৫ ও ১০৭-১১১ এবং নবম সংস্করণ, পৃ. ২০, ২১, ৪৭, ১১১-১১২ ও ২১৫-২১৯)।

বাস্তবতা হল, এগুলো সবই ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের ধারণা। বলা যায়, নিজের ব্যাপারে সুধারণা। না হয় কুরআনের অনুবাদকারীগণও ভুল অনুবাদ করেননি এবং তাফসীরকারগণও সঠিক ব্যাখ্যা তুলে ধরতে ব্যর্থ হননি। ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আয়াতের আলোচ্য অংশের ব্যাপারে যা কিছু সহীহ কথা লিখেছেন তা পূর্ববর্তী মুতারজিম ও মুফাসসিরদের  লেখাতেও পাওয়া যাবে এটাই স্বাভাবিক। কেননা তিনি তো তাদেরই কিছু কিতাবের অনুবাদ দেখে তা লিখেছেন। আর যা কিছু তিনি বিকৃত করে নিজের পক্ষ থেকে লিখেছেন- সত্যপন্থী কোনো লেখকের লেখায় তার উপস্থিতি পাওয়া অসম্ভব। তারা তো আয়াতের সঠিক অর্থই লিখবেন। নিজেদের পক্ষ থেকে কোনোরূপ অর্থ বিকৃত করবেন না এবং কোনো ধরনের মনগড়া ব্যাখ্যার আশ্রয় নেবেন না। অতএব যদি তার এসমস্ত কথাবার্তা তাদের কোনো তরজমা ও তাফসীরে পাওয়া না যায় তাতে তার গৌরববোধের কী আছে? এটা তো বরং তার জন্য লজ্জার বিষয়!

আলোচনার মূলপর্বে যাওয়ার আগে ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলতে চাই, যেমনটি তার বই থেকে প্রতীয়মান হয়; আরবীর ভাষাজ্ঞান তার নেই। ফার্সির তো প্রশ্নই আসে না। উর্দুর জ্ঞানও খুব একটা হওয়ার কথা নয়। কুরআনের তরজমা এবং তাফসীর তো এই তিন ভাষাতেই সবচে বেশি। বাংলা ও ইংরেজিতে তরজমা হয়ে থাকলেও কয়টা কিতাবেরই বা? যতটুকু যা তরজমা হয়েছে তার মধ্যে কয়টা তার নযরে পড়েছে বা পড়বার সুযোগ হয়েছে? এই যখন অবস্থা তখন কারো জন্য কি এটা শোভন হয় যে, তিনি তরজমা ও তাফসীরকারদের উপর কোনো আপত্তি তুলবেন, আপত্তি তোলার অধিকার আছে কি নেই এবং সেই আপত্তি যুক্তিসঙ্গত কি না সেটা ভিন্ন আলোচনা। আমার প্রশ্ন, যখন একজন লেখকের জানাই নেই যে, কোন মুফাসসির কী লিখেছেন এবং কোন মুতারজিম কী তরজমা করেছেন তখন এমনতরো কথাবার্তা তার মুখ থেকে কী করে বেরোয়, তার লেখায় কেমন করে আসে, আসতে পারে? লজ্জা ও সৌজন্যবোধের এতটুকুও কি অবশিষ্ট নেই আমাদের সমাজে?

আয়াতের ব্যাখ্যা

ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের আবিষ্কৃত অর্থ এবং তরজমা ও তাফসীরকারদের উপর তার উত্থাপিত আপত্তিসমূহ উল্লেখের আগে আলকুরআনুল কারীমের অনুবাদ এবং তাফসীর ও ব্যাখ্যা গ্রন্থসমূহের সাহায্যে আলোচ্য আয়াতের সংশ্লিষ্ট অংশের তরজমা ও তার ব্যাখ্যা উল্লেখ করে দেয়া সঙ্গত মনে হয়। যাতে সঠিক কথাটি সামনে এসে যায় প্রথমে।

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন বলেছেন

يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ وَالْحَجِّ

-সূরা বাকারা ২ : ১৮৯

শব্দ-বিশ্লেষণ

১. يَسْأَلُونَكَ তারা জিজ্ঞেস করে আপনাকে

২. عَنِ সম্পর্কে/বিষয়ে

৩. الْأَهِلَّةِ

الْأَهِلَّةِ শব্দটি হচ্ছে  هلال-এর বহুবচন। অমাবস্যা পার হওয়ার পর চাঁদের আলোকিত যে অংশ ধনুকের আকৃতিতে দৃষ্টিগোচর হয় তার নাম هلال (হিলাল)। যেহেতু অমাবস্যার সময় চাঁদ পৃথিবী থেকে দেখা যায় না; বরং যখন তা هلال (হিলাল)-এ রূপ নেয় তখনই কেবল দৃষ্টিগোচর হওয়া শুরু হয় এবং সেই সময় থেকেই নতুন ইসলামী মাসের সূচনা হয়- তাই هلال (হিলাল)-এর তরজমা করা হয় নতুন চাঁদ বা নবচন্দ্র। কতক অমুসলিম সম্প্রদায় চান্দ্রমাস আরম্ভ করে অমাবস্যার সময় যখন চাঁদ ও সূর্যের সম্মিলন ঘটে সেই মুহূর্ত থেকে। আর এটা কেবল জ্যোতির্শাস্ত্রীয় হিসাবের মাধ্যমেই জানা সম্ভব। ঐ অমুসলিম জাতিবর্গ যেহেতু অমাবস্যা থেকেই চান্দ্রমাস আরম্ভ করে সেজন্য তারা অমাবস্যার নাম দিয়েছে নিউ মুন। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানে এই পরিভাষাই প্রচলিত। এই জ্যোতির্শাস্ত্রীয় নিউ মুন-এর বাংলা তরজমা নতুন চাঁদ বা নবচন্দ্র নয়। এর তরজমা হল অমাবস্যা। জ্যোতির্শাস্ত্রীয় নিউ মুন-এর ধাপ অতিক্রান্ত হওয়ার পর যখন ক্রিসেন্ট মুন-এর পর্যায় আরম্ভ হয় তখনই কেবল চাঁদকে বলা হয় هلال (হিলাল)। আর এই হিলাল-কেই আল্লাহ তাআলা বানিয়েছেন ميقات বা সময় নিরূপণের মাধ্যম।

আয়াতে أهلة (নবচন্দ্রসমূহ) এই বহুবচন নির্দেশক শব্দ কেন আনা হল এ বিষয়ে বেশ কয়েকজন মুফাসসির আলোকপাত করেছেন। এ দ্বারা হয়ত চাঁদের বিভিন্ন আকারকে বোঝাতে চাওয়া হয়েছে। অথবা এর ব্যাখ্যা, চাঁদ প্রতি ঊনত্রিশ/ত্রিশ তারিখের পর হিলাল রূপে আত্মপ্রকাশ করে। অতএব হিলাল একটি নয়; বরং অনেক।

আবার উদয়স্থলের ভিন্নতার কারণে হিলাল প্রথম রাতেই সব জায়গা থেকে দেখা যায় না। বহু অঞ্চল আছে যেখানে দেখা যায় দ্বিতীয় রাতে। তাদের জন্য হিলাল (নতুন চাঁদ) সেটিই। আরবী ভাষায় শুধু প্রথম রাতের চাঁদকেই নয়; বরং মাসের শুরুর দিকের দুই তিন রাতের চাঁদকেও হিলাল বলা হয়। (লিসানুল আরব ১৫/৮৩-৮৪; তাজুল আরূস ৩১/১৪৪-১৪৫; তাফসীরে কাবীর : ফখরুদ্দীন রাযী ৫/১০৩)।

هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ এখানে هِيَ অর্থাৎ الأهلة দ্বারা যতগুলি পর্যায়ে চাঁদের যত রকম আকার দাঁড়ায় তার সবটাই যে উদ্দেশ্য তাতো স্পষ্ট। কেননা শুধু প্রথম রাতের চাঁদ তো মীকাত (সময় নির্ধারক) হতে পারে না। চাঁদের মীকাত বা সময় নিরূপণের মাধ্যম হওয়ার বিষয়টি বরং হিলাল আকারে তার প্রকাশ পাওয়া থেকে নিয়ে অদৃশ্য হওয়া, অতপর আবার হিলালরূপে আত্মপ্রকাশ পর্যন্ত যে নানা পর্যায় ও ধারা পরিক্রমা তার সাথে যুক্ত। সূরা ইয়া-সীনে তাই ইরশাদ হয়েছে :

وَالْقَمَرَ قَدَّرْنَاهُ مَنَازِلَ حَتَّى عَادَ كَالْعُرْجُونِ الْقَدِيمِ

আর চাঁদের জন্য আমি নির্দিষ্ট করেছি বিভিন্ন মনযিল। অবশেষে তা পুরাতন খেজুর শাখার ন্যায় (সরু, বাঁকা ও নিষ্প্রভ) হয়ে যায়। -সূরা ইয়া-সীন ৩৬ : ৩৯

সূরা ইউনুসে ইরশাদ করেছেন :

هُوَ الَّذِي جَعَلَ الشَّمْسَ ضِيَاءً وَالْقَمَرَ نُورًا وَقَدَّرَهُ مَنَازِلَ لِتَعْلَمُوا عَدَدَ السِّنِينَ وَالْحِسَابَ

তিনিই সেই সত্তা,যিনি সূর্যকে করেছেন জ্যোতি এবং চাঁদকে আলো। আর তাকে বিভক্ত করেছেন বিভিন্ন পরিমিত মনযিলে,যেন তোমরা জানতে পারো বর্ষগণনা এবং (অন্যান্য) হিসাব।-সূরা ইউনুস ১০: ৫

সুতরাং বর্ষগণনা এবং মাসসমূহের হিসাব সাধারণভাবে বোঝার সম্পর্ক কেবল চাঁদের হিলাল আকৃতির সাথে নয়;বরং তার ক্রমাগত তিথি পরিবর্তন ও রূপ বদলের সাথে।

ইঞ্জিনিয়ার সাহেব নিজেই সূরা ইউনুসের উপরোক্ত আয়াতের অধীনে লিখেছেন, আর চন্দ্রকে আল্লাহ জ্যোতি দিয়েছেন। বিজ্ঞান প্রমাণ করেছে যে, চন্দ্র সূর্য থেকে আলো পায়। এই জ্যোতির হ্রাস-বৃদ্ধির মাধ্যমে একটা মাসের সৃষ্টি হয়। তার ব্যাপ্তি এক নবচন্দ্রোদয় দিয়ে শুরু এবং আরেক নবচন্দ্রোদয় দিয়ে শেষ। আর এভাবে বারো মাসে বছর গণনা করতে বলেছেন আল্লাহ। (চান্দ্রমাস, পৃষ্ঠা :১১৮)

তাই চাঁদের হিলাল আকৃতি থেকে নিয়ে পরবর্তী হিলাল এর রূপ লাভ পর্যন্ত তার এই সবগুলি পর্যায়কে ইঙ্গিত করে আয়াতে أهلة (আহিল্লাতুন) বহুবচনের শব্দ ব্যবহার করা হয়ে থাকতে পারে। আর তা খুবই স্বাভাবিক। অনেক মুফাসসির এই সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করেছেন। (উদাহরণস্বরূপ দেখুন :

ক. রূহুল মাআনী,আলুসী (১২৭০ হি.) ২/৭১ তিনি লিখেছেন :

  إذ لو كان الهلال على شكل واحد لا يحصل التعدد...، ولو كان الهلال مدورا (في نظرنا كما هو في حالة البدر، فيرى دائما) كالشمس أو ملازما حالة واحدة لم يكد يتيسر التوقيت به.

খ. আল-মুহাররারুল ওয়াজীয, ইবনে আতিয়্যা (৫৪৩ হি.) ২/১৩৪।

গ. তাফসীরে কুরতুবী ৩/২২৯।

ঘ. যাহরাতুত তাফাসীর, আবু যাহরা মিসরী (১৩১৬-১৩৯৪ হি.) ২/৫৭৩)

যাই হোক আয়াতে أهلة (আহিল্লাহ) বহুবচনের শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। কিন্তু বাংলা ভাষায় নতুন চাঁদ বা নবচন্দ্র শব্দ দ্বারাই বহুবচনের অর্থ বুঝে এসে যায়। একারণে সাধারণভাবে يسئلونك عن الأهلة-এর তরজমা করা হয়েছে : তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে নতুন চাঁদ সম্পর্কে

৪. قل আপনি বলুন/বলে দিন।

৫. هي সর্বনামটির ইঙ্গিত أهلة (নবচন্দ্রসমূহ)-এর দিকে।

৬. مواقيت : ميقات  (মীকাত) শব্দের বহুবচন। এখানে মীকাতেমীম কে যদি মাসদারি ধরা হয় তাহলে অর্থ হবে ওয়াক্ত বা সময়। তবে সাধারণত কোনো কাজের জন্য নির্ধারিত সময়কেই মীকাত বলা হয় (লিসানুল আরব ১৫/২৫৪-২৫৫    ; তাজুল আরূস খ. ৫ পৃ.১৩২-১৩৩) আর যদি মীম কে ইসমে আলার জন্য ধরা হয় তাহলে মীকাতের অর্থ হবে সময় নির্ধারণের উপায় বা মাধ্যম। (আত তাফসীরুল মাযহারি খ. ১ পৃ. ২১০ )

দুরকম অর্থেরই অবকাশ আছে আয়াতে। বেশির ভাগ তাফসীরকার ও তরজমাকারীগণ এখানে দ্বিতীয় অর্থটিই গ্রহণ করেছেন। তবে উভয় অর্থের ফলাফল একই।

৭. للناس  মানুষের জন্য। অর্থাৎ মানুষের দ্বীনী ও দুনিয়াবি বিষয়ে যেখানে যেখানে সময় নির্ধারণের দরকার হয় তার জন্য ।

৮. والحج এবং হজ্বের জন্য। মানুষের জন্য কথাটির মধ্যেই হজ্বের প্রসঙ্গও এসে গিয়েছিল। কিন্তু গুরুত্ব বোঝাতে হজ্বের কথা আলাদা করে উল্লেখ করে দেয়া হয়েছে। অর্থাৎ এতে নির্দিষ্ট সময় রক্ষার বিষয়টি এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, হজ্বের কাযাও করতে হয় এই নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যেই, যা কিনা বছরে একবারমাত্র আসে। আরবী ব্যাকরণের নিয়ম অনুসারে للناس والحج  অংশটি مواقيت  -এর ছিফত। অর্থাৎ  مواقيت كائنة للناس

সূরা বাকারার ১৮৯ নং আয়াতের আলোচ্য অংশের পূর্ণ তরজমা দাঁড়ায় এরকম :

তারা আপনাকে জিজ্ঞেস করে নবচন্দ্রসমূহ সম্পর্কে। আপনি বলুন, সেগুলো মানুষের (যাবতীয় কাজকর্মের) জন্য এবং হজ্বের জন্য সময় নিরূপণের মাধ্যম

হিলাল কীসের মীকাত?

আয়াতে বলা হয়েছে مواقيت للناس والحج অর্থাৎ, হিলাল মানুষের জন্য এবং হজ্বের জন্য মীকাত। অর্থাৎ মানুষ দ্বীনী ও দুনিয়াবি কাজকর্মে এর মাধ্যমে সময় নির্ধারণ করে থাকে। বিশেষত হজ্বের সময় নির্ধারণ করে এরই মাধ্যমে। হিলালের মাধ্যমে সময় নিরূপণের অর্থ, হিলাল কেন্দ্রিক চান্দ্রমাসের সাহায্যে সময় নির্ণয়। ইবাদতসমূহ এবং পারস্পরিক লেনদেন ও আদান-প্রদানের সময় জেনে নেয়া। কবে রোযা, কবে ঈদ এবং কবে হজ্ব ও কুরবানী ইত্যাদি। অনুরূপ দুনিয়াবি লেনদেনের ক্ষেত্রে। যেমন অমুকের ধারশোধ করতে হবে কোনদিন, ওয়াদাপূরণের সেই তারিখটি আসছে কবে... এ ধরনের আরো যা। ইমাম ইবনে আবী হাতেম রাহ. (৩২৭ হি.) তাঁর সংকলিত তাফসীর-এ এবং ইমাম ইবনে জারীর তাবারী রাহ. (৩১০ হি.) জামেউল বয়ানে হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণনা করেছে যে, তিনি বলেছেন,

 سأل الناس رسول الله صلى الله عليه وسلم عن الأهلة فنزلت هذه الآية : يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ يعلمون بها حل دينهم، وعدة نسائهم، ووقت حجهم

অর্থাৎ, মানুষজন আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কাছে চাঁদের বিষয়ে জিজ্ঞেস করল, তখন এই আয়াত নাযিল হল:

يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ

অর্থাৎ মানুষ এর মাধ্যমে তাদের ঋণ পরিশোধের সময়, মহিলাদের ইদ্দত এবং হজের সময় অবগত হয়ে থাকে। (তাফসীর ইবনে আবী হাতেম ১/৩২২, তাফসীরে তাবারী, ২/২৮২,

(وفي إسناده ضعف يجبره ما يأتي من مرسل ابن جريج وغيره)

বিখ্যাত তাবেঈ ইমাম কাতাদা রাহ. (১১৮ হি.) বলেন,

سألوا نبي الله صلى الله عليه وسلم عن ذلك لم جعلت هذه الأهلة؟ فأنزل الله فيها ما تسمعون : قل هي مواقيت للناس. فجعلها لصوم المسلمين وإفطارهم، ولمناسكهم وحجهم، ولعدة نسائهم، ومحل دينهم، في أشياء، والله بما يصلح خلقه.

ইমাম ইবনে জুরাইজ রাহ. বলেন,

 قال الناس لم جعلت هذه الأهلة ؟ فنزلت: يسألونك عن الأهلة قل هي مواقيت للناس، لصومهم وإفطارهم، وحجهم ومناسكهم، قال قال ابن عباس : ووقت حجهم، وعدة نسائهم، وحل ديونهم

 এই দুটো বর্ণনার সারকথাও এটাই যে, হিলাল হচ্ছে মানুষের ইবাদত ও লেনদেনের সময় নির্ধারণ ও নিরূপণের মাধ্যম। রোযা, ঈদ, হজ্ব, কুরবানী; ইদ্দত পালন এবং ঋণ পরিশোধ বা কর্জ উসুলের সময় ইত্যাদি।

একই রকম বক্তব্য আরো অনেক তাবেঈ ও তাবে তাবেঈ থেকে বর্ণিত আছে। (তাফসীরে তাবারী ২/২৮০-২৮৩; তাফসীরে ইবনে কাসীর ১/৩৩৮; তাফসীরে ইবনে আবী হাতেম ১/৩২২)।

হিলাল মীকাত হওয়ার কী অর্থ?

হিলাল মীকাত হওয়ার অর্থ খুবই পরিষ্কার। এতে কখনোই কারো কোনো দ্বিধা বা সংশয় তৈরি হয়নি। অর্থাৎ, হিলাল দেখেই চান্দ্রমাস শুরু হবে এবং পরবর্তী হিলাল দেখার মাধ্যমে আগের মাস সমাপ্ত ও নতুন চান্দ্রমাস আরম্ভ হবে। খায়রুল কুরূন তথা ইসলামের প্রথম তিন প্রজন্মের লোকেরা এ অর্থই বুঝেছেন। সব ফকীহ, সকল মুফাস্সির এবং সমস্ত মুহাদ্দিস এটাই বুঝেছেন। মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরাও এ অর্থই বুঝেছেন। আমি শুধু আল-বেরুনী (৪৪০ হি.)-এর উদ্ধৃতি উল্লেখ করছি। তিনি তার লিখিত الآثار الباقية عن القرون الخالية গ্রন্থে সন-তারিখের ইতিহাস বর্ণনা করতে গিয়ে লিখেছেন :

 ثم تاريخ هجرة النبي محمد صلى الله عليه وسلم من مكة إلى المدينة ، وهو على السنين القمرية برؤية الأهلة، لا الحساب، وعليه يعمل أهل الاسلام بأسرهم.

অর্থাৎ হিজরী তারিখ, যা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মক্কা থেকে মদীনায় হিজরতের সাথে সম্পর্কযুক্ত, তার ভিত্তি চান্দ্রবর্ষের উপর-চাঁদ দেখার মাধ্যমে, হিসাবের ভিত্তিতে নয়। এবং সমস্ত মুসলমানের আমল এই তরীকা মোতাবিক। -আল আছারুল বাকিয়া পৃ. ৩১

আরেক জায়গায় লিখেছেন,

ويبتدؤن بالشهر من عند رؤية الهلال، وكذلك شرع في الاسلام، كما قال الله تعالى : يسألونك عن الأهلة، قل هي مواقيت للناس والحج.

আরবের লোকজন চাঁদ দেখে মাস শুরু করে এবং এই বিধানই দেওয়া হয়েছে ইসলামে। যেমনটি আল্লাহ তাআলা বলেছেন,

يسألونك عن الأهلة، قل هي مواقيت للناس والحج

-আল আছারুল বাকিয়া পৃ. ৬৪

এক বেদাতী ফের্কা, যারা চাঁদের হিসাব করে রোযা ও ঈদ করত এবং রমযান মাসকে সবসময় ত্রিশ দিন গণনা করত, এদের খণ্ডন করতে গিয়ে আল-বেরুনী লিখেছেন যে, ইহুদী-খ্রিস্টানরা তো মাসের হিসাব ক্যালেন্ডারের মাধ্যমে করে থাকে, কিন্তু মুসলমানের জন্য চাঁদ দেখা ছাড়া কোনো গত্যন্তর নেই। তাদের এ অনুসন্ধান করা জরুরি, চাঁদ আলো গ্রহণ পূর্বক তার কোনো অংশ দৃষ্টিগোচর হচ্ছে কি? আল-বেরুনীর আরবী ভাষ্যের সংশ্লিষ্ট জায়গাটি দেখুন :

 ... اليهود والنصارى، فإذا لهم جداول وحسبانات يستخرجون بها شهورهم ويعرفون منها صيامهم، والمسلمون مضطرون إلى رؤية الهلال وتفقد ما اكتساه القمر من النور واشترك بين نصفه المرئي ونصفه المستور (الآثار الباقيئة : ৬৪)

নির্ভরযোগ্য ও সুপ্রসিদ্ধ জ্যোতির্বিজ্ঞানী আল-বেরুনীর বক্তব্য থেকে যেমন এটা জানা গেল যে, হিজরী তারিখের ভিত্তি হল হিলাল দেখার উপর, তেমনি এ বিষয়টিও পরিষ্কার হয়ে গেল যে, কুরআনে কারীমের আলোচ্য আয়াতে الشهور القمرية   (চান্দ্রমাসসমূহ) শব্দ ব্যবহার না করে الأهلة শব্দের মাধ্যমে হিলালী মাসসমূহকে মীকাত বানানোর সুনির্দিষ্ট অর্থ এটাই যে, হিলাল দেখে মাস শুরু করা হবে। হিলালের হিসাব বের করে মাস আরম্ভের অর্থ এই আয়াতে কোনোভাবেই খাটে না। মোটকথা, এই আয়াত এ অর্থ বোঝাবার ক্ষেত্রে খুবই পরিষ্কার এবং দ্ব্যর্থহীন যে, চান্দ্রমাস শুরু হবে হিলাল দেখার মাধ্যমে। তারপরও যেহেতু আয়াতে رؤية বা দেখা শব্দটির উল্লেখ নেই তাই আধুনিককালে কারো জন্য বিভ্রান্তি সৃষ্টির কিংবা বিভ্রান্তির শিকার হবার অবকাশ ছিল; কিন্তু আল্লাহ তাআলার শোকর, এই রাস্তাও তিনি বন্ধ করে দিয়েছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়ামাল্লামের যবানীতে, সহীহ হাদীসে এই আয়াতের উদ্ধৃতি দিয়েই হিলালের সাথে رؤية  বা দেখা শব্দটিও যুক্ত করে দিয়েছেন। যার ফলে আয়াতের অর্থ ও উদ্দেশ্য স্পষ্ট থেকে স্পষ্টতর হয়ে উঠেছে।

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে উমর রা. থেকে সহীহ সনদে বর্ণিত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,

إن الله تبارك وتعالى جعل الأهلة مواقيت للناس، فصوموا لرؤيته، وأفطروا لرؤيته، فان غم عليكم فعدوا له ثلاثين يوما

নিশ্চয়ই আল্লাহ তাআলা হিলালকে মানুষের জন্য মীকাত বানিয়েছেন। অতএব তোমরা হিলাল দেখে রোযা রাখো এবং হিলাল দেখে রোযা ছাড়ো। আর যদি তা তোমাদের দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায় তাহলে তাকে ত্রিশ দিন গণনা করো। -আল-মুসান্নাফ, আব্দুর রায্যাক ইবনে হাম্মাম (১২৬-২১১ হি.), ৪/১৫৬, হাদীস : ৭৩০৬; আস-সুনানুল কুবরা, বাইহাকী : ৪/২০৫;আলমুসতাদরাক, হাকেম আবু আব্দিল্লাহ ১/৪২২, হাদীস : ১৫৭৯

قال الحاكم : هذا حديث صحيح الإسناد على شرطهما ولم يخرجاه، وعبد العزيز بن أبي رواد ثقة عابد مجتهد شريف البيت.

(অর্থাৎ, মুহাদ্দিস হাকেম আবু আব্দিল্লাহ বলেছেন, এই হাদীসের সনদ ইমাম বুখারী এবং ইমাম মুসলিম রাহ.-এর মিয়ার (মানদণ্ড) অনুসারে সহীহ। (আল-মুস্তাদরাক, প্রাগুক্ত)

এই হাদীসটি ইমাম ইবনে খুযাইমা রাহ. (২২৩ হি.-৩১১ হি.) তাঁর আস-সহীহ গ্রন্থে, কিতাবুস্ সওমের পঁচিশতম অনুচ্ছেদে রেওয়ায়েত করেছেন। এই অনুচ্ছেদের শিরোনাম তার ভাষায় :

 باب ذكر البيان أن الله جل وعلا جعل الأهلة مواقيت للناس لصومهم وفطرهم، إذ قد أمر الله على لسان نبيه عليه السلام بصوم شهر رمضان لرؤيته ما لم يغم، قال الله عز وجل : يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ ، الآية

(অর্থাৎ অনুচ্ছেদ : এ বিষয়ক বর্ণনা প্রসঙ্গে যে, আল্লাহ তাআলা হিলালকে মানুষের জন্য মীকাত বানিয়েছেন। তাদের রোযা রাখা এবং রোযা ছাড়ার জন্য। কারণ আল্লাহ তাঁর নবী আলাইহিস সালামের যবানে আদেশ করেছেন হিলাল দেখে রোযা রাখতে এবং হিলাল দেখে রোযা ছাড়তে, যদি না চাঁদ দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায় (তখন ত্রিশ পূর্ণ করতে হবে)। আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন,

يَسْأَلُونَكَ عَنِ الْأَهِلَّةِ قُلْ هِيَ مَوَاقِيتُ لِلنَّاسِ...

(সহীহ ইবনে খুযাইমা ৩/২০১, হাদীস ১৯০৬-এর অনুচ্ছেদের শিরোনাম, যা স্বয়ং ইমাম ইবনে খুযাইমা কর্তৃক নির্ধারিত)

হুবহু এই নির্দেশনাই হযরত তলাক ইবনে আলী রা.-এর মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। তিনি বলেন,

(قال رسول الله صلى الله عليه وسلم : إن الله عز وجل جعل هذه الأهلة مواقيت للناس، صوموا لرؤيته، وأفطروا لرؤيته، فإن غم عليكم فأتموا العدة)

অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, নিঃসন্দেহে আল্লাহ তাআলা হিলালকে মানুষের জন্য মীকাত বানিয়েছেন। তোমরা হিলাল দেখে রোযা রাখো এবং হিলাল দেখে রোযা শেষ করো। যদি চাঁদ তোমাদের দৃষ্টির আড়াল হয়ে যায় তাহলে সংখ্যা পূরণ করো। -মুসনাদে আহমাদ ৪/২৩, হাদীস ১৬২৯৪

(এই হাদীস সনদের দিক থেকে হাসান এবং মতনের দিক দিয়ে সহীহ লিগাইরিহী, হাশিয়া মুসনাদে আহমাদ : শায়খ শুআইব ২৬/২২১-২২২, হাশিয়া শরহু মুশকিলিল আছার তাহাবী, শায়খ শুআইব কৃত ৯/৩৯৪, মুহাম্মাদ ইবনে জাবের আল-ইয়ামামীর জীবনী রিজাল বিষয়ক গ্রন্থে)

এ দুই হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা বাকারার ১৮৯ নং আয়াত يسألونك عن الأهلة-এর প্রতি ইঙ্গিত করে হিলালের মাধ্যমে সময় নির্ণয়ের মাপকাঠি এবং তার মীকাত হওয়ার ধরন সম্পর্কে বলে দিয়েছেন। এবং পরিষ্কার ইরশাদ করেছেন, হিলাল দেখে রোযা রাখতে হবে এবং হিলাল দেখেই রোযা শেষ করতে হবে। এ কারণে এ হাদীসগুলোর মাধ্যমে যেমন এই মাসআলা প্রমাণিত হল যে, রোযা ও ঈদ হিলাল দেখার সাথে সম্পর্কযুক্ত; হিসাবের মাধ্যমে হিলালের অস্তিত্ব জানার সাথে নয়, তেমনি হাদীসগুলোর মাধ্যমে আয়াত ২:১৮৯-এর ব্যাখ্যাও হয়ে গেল। অর্থাৎ, হিলাল মীকাত হওয়ার অর্থ এই যে, হিলাল দেখে চান্দ্রমাস শুরু করা হবে এবং পরবর্তী হিলাল দেখে তবে পূর্ববর্তী মাস শেষ করা হবে। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, যার উপর কুরআন নাযিল হয়েছে, যাকে আল্লাহ তাআলা কুরআনের বয়ান (তাফসীর) শিক্ষা দিয়েছেন এবং যাকে উম্মতের জন্য কুরআন ও হিকমতের শিক্ষক বানিয়েছেন- তাঁর ব্যাখ্যার পর আর কারো জন্য কোনো ধরনের পুনর্বিবেচনা বা নতুন করে মত প্রদান কিংবা সংশোধনী দেয়ার কোনো সুযোগ নেই।

যে বিষয়ে পরিষ্কার এবং অবিচ্ছিন্ন ও মুতাওয়াতির সূত্রসমূহে বর্ণিত অনেক হাদীস রয়েছে সেখানে ভিন্নমত পোষণের অবকাশ থাকে না। যে কারণে এই মাসআলা উম্মতের কাছে সর্বজনস্বীকৃত ও সর্ববাদীসম্মত। কেউ পা ফসকে যদি কোনো বিচ্ছিন্নতার শিকার হয় সেটা ভিন্ন কথা। না হলে যে কোনো নির্ভরযোগ্য আলেমকে এই আয়াতের তাফসীর জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি সে উত্তরই দিবেন যে উত্তর দিয়েছেন খলীফায়ে রাশেদ হযরত আলী রা.। مواقيت للناس  সম্পর্কে তাঁর কাছে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন,

هي مواقيت، الشهر هكذا وهكذا وهكذا، وقبض إبهامه، فإذا رأيتموه فصوموا، وإذا رأيتموه فافطروا، فان غم عليكم فأتموا ثلاثين.

অর্থাৎ হিলাল হচ্ছে মীকাত। তারপর আঙ্গুলের ইশারায় বললেন, মাস ঊনত্রিশ দিনের। যদি হিলাল দেখা যায় রোযা রাখো তারপর আবার হিলাল দেখা গেলে রোযা শেষ করো। যদি হিলাল দৃষ্টির আড়ালে থেকে যায় তাহলে ত্রিশ দিন পূর্ণ করো (তাফসীরে তাবারী ৩/২৮২)

আজকেও যদি কাউকে এই আয়াতের তাফসীর জিজ্ঞেস করা হয় তাহলে তিনি নববী নির্দেশনার আলোকে তা-ই বলবেন, যা বলেছেন হযরত আলী রা.। হিলাল দেখে রোযা রাখো এবং হিলাল দেখেই রোযা শেষ করো- এই নির্দেশনা কেবল এই দুই হাদীসেই নয়; বরং এই দুই সাহাবী ছাড়াও অন্য অনেক সাহাবীর মাধ্যমে অনেকগুলি সনদে বর্ণিত হয়েছে। স্বয়ং আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা.-এর সূত্রে এই কথা তার বিপুল সংখ্যক ছাত্রের মাধ্যমে বর্ণিত হয়েছে। যা সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিম এবং মুসনাদে আহমদ সমেত হাদীসের শতশত গ্রন্থে বিদ্যমান রয়েছে। উপরিউক্ত দুই সাহাবী ছাড়া আর যাদের সূত্রে এই নির্দেশনা সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণিত হয়েছে তাদের নামগুলোই শুধু উল্লেখ করা হচ্ছে,

১. আবু হুরায়রা রা.

২. আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা.

৩. হুযায়ফাতুবনুল ইয়ামান রা.

৪. আবু বাকরা রা.

৫. জাবের রা.

৬. সাআদ ইবনে আবী ওয়াক্কাস রা.

৭. আনাস ইবনে মালেক রা.

৮. বারা ইবনে আযেব রা.

৯. রাফে ইবনে খাদীজ রা.

১০. সামুর রা.

১১. আদী ইবনে হাতেম রা.

১২. আয়েশা রা.

হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রা. এবং তলাক ইবনে আলীসহ মোট চৌদ্দ সাহাবী হল। উল্লিখিত হাদীসসমূহের (একটি বাদে) সবকটি কওলী এবং মারফ‚’। অর্থাৎ এতে সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মৌখিক নির্দেশনা বিভিন্ন শব্দে বর্ণিত হয়েছে। যাতে বলা হয়েছে, হিলাল দেখে রোযা রাখো এবং হিলাল দেখেই রোযা শেষ করো। আর কোনো কোনো হাদীসে ইরশাদ করেছেন, তোমরা হিলাল না দেখে রোযা শুরু করো না এবং হিলাল দেখা ছাড়া রোযা শেষ করো না। যদি হিলাল ঢাকা পড়ে যায় তাহলে ত্রিশ পূর্ণ করো।

সর্বশেষ হাদীস হযরত আয়েশা রা.-এর মারফ‚’ রেওয়ায়েত, যা ফেলী। এতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের নিজের আমল বর্ণনা করা হয়েছে। যা তাঁর নির্দেশ ছিল সে মোতাবেকই ছিল তাঁর আমল। হিলাল দেখে রোযা শুরু করা, হিলাল দেখেই রোযা শেষ করা এবং হিলাল ঢাকা পড়ে গেলে ত্রিশ পূর্ণ করা। চাঁদ দেখা বিষয়ক এই সকল হাদীস ছাড়াও চাঁদের সাক্ষ্য দেয়া সম্পর্কিত হাদীস থেকেও এটি প্রমাণিত হয়। কারণ ঐ হাদীসগুলোর অর্থও এটাই যে, হিলাল প্রমাণিত হবে দেখার দ্বারা। নিজে না দেখলেও যদি দেখার সাক্ষ্য পাওয়া যায় তাহলেও হিলাল প্রমাণিত হয়ে যাবে। চাঁদ দেখার সাক্ষ্য দেয়া সম্পর্কিত হাদীসও বহু সাহাবীর মাধ্যমে বহু সনদে বর্ণিত হয়েছে। শুধু মুয়াত্তা ও পাঁচ কিতাব, যেগুলোর হাদীসের সমষ্টি ইবনুল আছীর-এর জামেউল উসূলে রয়েছে- ওখানেই ছয় সাহাবীর হাদীস বিদ্যমান রয়েছে। -জামেউল উসূল, ৬/২৭১-২৭৫    

অতএব রমযানের হিলাল ও শাওয়ালের হিলাল প্রমাণিত হওয়ার জন্যে তা দেখতে পাওয়া যে জরুরি- এটা কেবল এক দুইটি সহীহ হাদীস দ্বারা নয়; বরং বিশের অধিক সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণিত। যার মধ্যে অধিকাংশ হাদীসই এমন, যার একাধিক সনদ রয়েছে। আর কোনো কোনোটির তো দশ বা তার চেয়েও বেশি সনদ রয়েছে।

মোটকথা,এই বিষয়টি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে অনুসৃত ও অবিচ্ছিন্ন বিপুল সংখ্যক সূত্র পরম্পরায় বর্ণিত ও প্রমাণিত এবং খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ এবং তাদের কথা ও কাজ দ্বারাও এটাই প্রমাণিত। অন্যান্য সাহাবায়ে কেরাম ও তাবেঈন এবং তাবে তাবেঈনের আমল ও ফতোয়াও ছিল এটিই। এবং পরবর্তীকালের ইমামদের ইজমা ও সম্মিলিত সিদ্ধান্তও ছিল এ মোতাবেক। সংক্ষেপনের স্বার্থে এখানে খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শ এবং সাহাবা ও তাবেঈনের বক্তব্য উদ্ধৃত করা হল না। এই মাসআলার মুজমা আলাইহি বা সর্বজনস্বীকৃত হওয়ার বিষয়ে মনীষী ফকীহ ও মুহাদ্দিসদের ভাষ্য ইনশাআল্লাহ প্রবন্ধের শেষ অনুচ্ছেদে উদ্ধৃত করা হবে।

সারকথা দাঁড়ালো এই যে, কুরআনের তাফসীরের সমস্ত নির্ভরযোগ্য উৎস মোতাবেক يسألونك عن الأهلة শীর্ষক আয়াতের তাফসীর সুনির্ধারিত। আর তা এই যে, হিলালের মীকাত হওয়ার অর্থ, চান্দ্রমাস শুরু হবে হিলাল দেখার মাধ্যমে এবং পরবর্তী হিলাল পর্যন্ত তা অব্যাহত থাকবে। পরবর্তী হিলাল দেখার পর কিংবা ত্রিশ দিন পূর্ণ করার মধ্য দিয়ে পরের মাস আরম্ভ হবে।

 ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কী বলেন?

আয়াতে কারীমার এই স্পষ্ট, অনুসৃত এবং সর্বজনস্বীকৃত অর্থের বিপরীতে এবং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এত সংখ্যক হাদীসের মোকাবেলায় ইঞ্জিনিয়ার সাহেব কী বলেন তা (নাঊযুবিল্লাহ সহকারে) একবার দেখুন। তিনি তার বইয়ের প্রশ্নোত্তর অংশে ৭৪ নং প্রশ্নের উত্তরে লিখেছেন:

চাঁদ দেখে চান্দ্রমাস শুরু করার কোন হাদীস নেই। কোরআন আমাদেরকে নতুন চাঁদ দেখে মাস শুরু করতে বলে না, হিসাব করতে বলে। এই জ্ঞান প্রকাশিত অথবা জানার আগে অস্থায়ী ভিত্তিতে উদ্দেশ্য সাধনের জন্য অন্য ব্যবস্থা আমাদেরকে করতে হয়েছে। সেগুলো উপরোক্ত সত্য উদঘাটনের পর এখন আর গ্রহণযোগ্য থাকতে পারে না। (চান্দ্রমাস পৃ. ২১৪)

বুঝুন তাহলে! এরকম ডাহা মিথ্যাচার সম্পর্কেও যদি পর্যালোচনা করতে হয় তাহলে আর কী করার থাকে? এরকম বে-ঈমানী দুঃসাহসকে আপনি কী বলবেন-কুরআন মাস আরম্ভ করতে বলেছে হিলাল দেখে নয়;বরং চাঁদের হিসাবের ভিত্তিতে!নাঊযুবিল্লাহি মিন যালিক!!

তাই যদি হবে তাহলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, সাহাবায়ে কেরাম এবং সালাফে সালেহীন কেন চাঁদ দেখে মাস শুরু করতেন এবং চাঁদ দেখেই রোযা ও ঈদ করতেন? ইঞ্জিনিয়ার সাহেব বলছেন, এ সবকিছু এই সত্য উদঘাটিত হবার পূর্বেকার কথা। যা ইঞ্জিনিয়ার সাহেবের বদৌলতে উম্মত জানতে পেরেছে!! ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিঊন।

যাই হোক আয়াতে কারীমার সঠিক অর্থ ও সহীহ ব্যাখ্য উল্লেখের পর এখন  দেখুন,ইঞ্জিনিয়ার সাহেব আয়াতের কী তরজমা করছেন এবং কী ব্যাখ্যা হাযির করছেন।

 (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

 

advertisement