সূরা ফাতিহা কি কিরাত নয়?
কয়েকদিন আগে জামালপুর জেলার মাদারগঞ্জ থানায় একটি দ্বীনী সফর করার তাওফীক হয়। সেখানে যাওয়ার পর উলামায়ে কেরামের উদ্দেশ্যে মানুষ বারবার এই প্রশ্নটি করছিলেন যে, হুযুর! সূরা ফাতিহা নাকি কিরাত নয়? হঠাৎ এমন আজব প্রশ্ন! কারণ খোঁজ করে জানতে পারলাম, কিছুদিন আগে গাইরে মুকাল্লিদ ভাইয়েরা সে এলাকায় একটি মাহফিলের আয়োজন করেছিলেন। সেই মাহফিলে তাঁদের কোনো এক আলেম ‘ইমামের কিরাতই মুক্তাদির কিরাত’ মর্মে হাদীসকে এই বলে খন্ডন করেছেন যে, এখানে মুক্তাদীকে কিরাত পড়তে নিষেধ করা হয়েছে; সূরা ফাতিহা পড়তে নিষেধ করা হয়নি। কারণ, কিরাত হল সূরা বাকারা থেকে সূরা নাস পর্যন্ত। সূরা ফাতিহা কিরাতের অমত্মর্ভুক্ত নয়।’ এমন আজগুবি একটি কথা গাইরে মুকাল্লিদ আলেমগণ বলে থাকেন শুনে খুব আশ্চর্যবোধ করলাম। নিজেদের মত প্রতিষ্ঠার লক্ষ্য আমাদের ঐ বন্ধুরা এত নীচে নামবেন, তা আমরা ভাবতে পারিনি।
সূরা ফাতিহা কুরআনে কারীমের একটি সূরা। এটি স্বীকৃত বাস্তবতা। সুতরাং তা পাঠ করা তো অবশ্যই কিরাত। কারণ এখানে কিরাতের অর্থ হল- কুরআন পড়া। ফাতিহা যেহেতু কুরআনেরই একটি সূরা তাই ফাতিহা পড়া কিরাত (কুরআন পড়া) হবে না কেন? বিষয়টি এত স্পষ্ট যে, এর জন্যে দালীলিক আলোচনার প্রয়োজন পড়ে না। তবু আমরা এখানে কিছু হাদীস উল্লেখ করছি, যাতে স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে যে, সূরা ফাতিহা পড়াও ‘কিরাত’-এর অন্তর্ভুক্ত।
(১) হযরত আয়েশা রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم يستفتح الصلاة بالتكبير والقراءةَ بالحمد لله رب العالمين.
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাকবীরের মাধ্যমে নামায শুরু করতেন এবং ‘আল-হামদু লিল্লাহি রাবিবল আলামীন’-এর মাধ্যমে কিরাত শুরু করতেন।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৪৯৮; সুনানে আবু দাউদ, হাদীস ৭৭৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৫০৭; মুসনাদে আহমদ ৬/৩১
এই হাদীসে সুস্পষ্টভাবে সূরা ফাতিহাকে ‘কিরাত’ বলা হল।
(২) হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত তিনি বলেন-
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم إذا نهض من الركعة الثانية استفتح القراءة "بالحمد لله رب العالمين".
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন দ্বিতীয় রাকাত থেকে উঠে দাঁড়াতেন তখন ‘আল-হামদু লিল্লাহি রাবিবল আলামীন’-এর মাধ্যমে কিরাত শুরু করতেন।’ -সহীহ মুসলিম, হাদীস ৫৯৯; সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস ৮১৪; সহীহ ইবনে হিববান, হাদীস ১৯৬৩
এ হাদীসেও সূরা ফাতিহাকে ‘কিরাত’ বলা হল।
(৩) হযরত আনাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-
كان رسول الله صلى الله عليه وسلم وأبو بكر وعمر يستفتحون القراءة "بالحمد الله رب العالمين".
‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর এবং উমর রা. ‘আলহামদুলিল্লাহি রাবিবল আলামীন’-এর মাধ্যমে কিরাত শুরু করতেন।’ -ইমাম বুখারী, জুযউল কিরাআত খালফাল ইমাম, হাদীস ৭৭৮; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ৯০২; ইবনে মাজাহ, হাদীস ৫০৮; মুসনাদে আহমাদ ৩/১০১
(৪) হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে মুগাফফাল রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন-
صليت خلف النبي صلى الله عليه وسلم وأبي بكر وعمر وعثمان رضي الله عنهم يستفتحون القراءة "بالحمد لله رب العالمين"
আমি নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম, আবু বকর, উমর ও উসমান রা.-এর পিছনে নামায আদায় করেছি। তাঁরা প্রত্যেকেই ‘আল-হামদু লিল্লাহি রাবিবল আলামীন’-এর মাধ্যমে কিরাত শুরু করতেন।’ -ইমাম বুখারী, জুযউল কিরাআত খালফাল ইমাম, হাদীস ১৩০
তো এতগুলো সহীহ হাদীসে সূরা ফাতিহা পড়াকে কিরাত বলা হল। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদীন থেকে প্রমাণিত হল যে, সূরা ফাতিহা পড়াও কিরাত। এরপরও কি আমাদের ঐ বন্ধুরা বলবেন- সূরা ফাতিহা পড়া কিরাত নয়?
ফাতিহা কি কুরআন নয়? নাউযুবিল্লাহ!
কোনো কোনো গায়রে মুকাল্লিদ নিজস্ব মতামতের পক্ষে প্রমাণ দাঁড় করাতে গিয়ে (বুঝে কিংবা না বুঝে) ঈমান বরবাদ করা শুরু করেছে এবং বলছে, সূরা ফাতেহা কুরআনের অংশই নয়! নাউযুবিল্লাহি মিন যালিক। এই কুফ্রী উক্তির জন্য তাদের একজন সূরা হিজরের ৮৭ নং আয়াতের বিকৃতি পর্যমত্ম ঘটিয়ে দিয়েছে। এই আয়াতে আছে-
وَلَقَدْ آَتَيْنَاكَ سَبْعًا مِنَ الْمَثَانِي وَالْقُرْآَنَ الْعَظِيمَ
অর্থ: ‘আমি তোমাকে দিয়েছি বারবার পঠিত সাত আয়াত এবং মর্যাদাপূর্ণ কুরআন।’ (সূরা হিজর, আয়াত ৮৭) এখন আমাদের ঐ ভাইদের বক্তব্য হল, ‘সাবআ মাছানী’ তথা সাত আয়াত দ্বারা উদ্দেশ্য হল সূরা ফাতিহা। আর এই আয়াতে সূরা ফাতিহাকে ‘কুরআন’ থেকে পৃথকভাবে উল্লেখ করা হয়েছে। সুতরাং বোঝা গেল সূরা ফাতিহা কুরআনের অংশ নয়! নাউযুবিল্লাহ। অথচ এক হাদীসে সূরা ফাতিহাকে সাবআ মাছানী বলা হয়েছে আবার সেই হাদীসেই আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা ফাতিহাকে কুরআনের গুরুত্বপূর্ণ অংশ বলে উল্লেখ করেছেন। একটি দীর্ঘ হাদীসে হযরত আবু সাঈদ ইবনুল মু’আল্লা রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বলেছেন-
ألا أعلمك أعظم سورة في القرآن قبل أن أخرج من المسجد، فذهب النبي صلى الله عليه وسلم يخرج من المسجد، فذكرته فقال : الحمد لله رب العالمين هي السبع المثاني والقرآن العظيم الذي أوتيته.
অর্থ : মসজিদ থেকে বের হওয়ার আগেই কি কুরআনের সবচে মর্যাদাপূর্ণ সূরা আমি তোমাকে শিখিয়ে দেব না? অতপর যখন তিনি মসজিদ থেকে বের হতে উদ্যত হলেন, আমি তাঁকে স্মরণ করিয়ে দিলাম। তিনি বললেন, তা হল, ‘আলহামদু লিল্লাহি রাবিবল আলামীন...।’ এটাই হল ‘সাবআ মাছানী’ তথা বারবার পঠিত সাত আয়াত এবং মর্যাদাপূর্ণ কুরআন যা আমাকে দান করা হয়েছে।’ -সহীহ বুখারী, হাদীস ৪৭০৩, ৪৪৭৪
এই হাদীসে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূরা ফাতিহাকে শুধু কুরআনের অংশ বলেই ক্ষান্ত হননি; বরং কুরআনের সবচে মর্যদাপূর্ণ সূরা হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। আর এ-ও বলে দিয়েছেন যে, আয়াতে ‘আল কুরআনুল আযীম’ দ্বারা সূরা ফাতিহা উদ্দেশ্য। কুরআনের অতি গুরুত্বপূর্ণ সূরা হওয়ার কারণে একে القرآن العظيم বলা হয়েছে।
(২) ঐ কুফরী উক্তির সমর্থনে দ্বিতীয় যে কৌশল তারা অবলম্বন করেছেন তা হল, হাদীস শরীফে সূরা ফাতিহাকে উম্মুল কুরআন তথা কুরআনের মা বলা হয়েছে। কাজেই সূরা ফাতিহা কুরআনের মা, কুরআন নয়! এটা কি কোনো যৌক্তিক কথা?
কুরআন মাজীদে মক্কা মুকাররমাকে উম্মুল কুরা তথা সমস্ত জনপদের মা বলা হয়েছে। তাহলে কি আমাদের ঐ বন্ধুরা বলবেন, মক্কা মুকাররমা সমস্ত জনপদের মা কিন্তু কোনো জনপদ নয়?
হযরত হাওয়া আ. সমস্ত মানবজাতির মা। কিন্তু এর অর্থ কি এই যে, তিনি মানব নন, অন্য কোনো প্রাণী? প্রত্যেক ব্যক্তি জানে, দেখে এবং পড়ে যে, আল কুরআনুল কারীমে সূরা ফাতিহা আছে। বরং তার প্রথম সূরাটিই হল সূরা ফাতেহা। তো এটিই তো একথার অকাট্য প্রমাণ যে, সূরা ফাতেহা কুরআন। তাছাড়া কুরআন এবং সহীহ হাদীসেও ফাতিহাকে শুধু কুরআন নয় বরং ‘কুরআনে আযীম’ বলা হয়েছে। এতকিছুর পরও এ কথা বলা যে, ফাতিহা কুরআন নয়, কত বড় বে-ঈমানী?!
আর এ বে-ঈমানী শুধু নিজের এই মাযহাবের পক্ষপাতিত্বের জন্য করা হচ্ছে যে, ইমামের পেছনে ফাতিহা পড়া ফরয। অথচ এটি (ইমামের পিছনে সূরা ফাতিহা পড়া) তো দুএকজন ইমামেরও মাযহাব। তারা এর সমর্থনে কিছু প্রমাণও পেশ করেছেন। যদি এই মারজুহ মাযহাবকে গ্রহণ করতেই হয়, তবে সেই স্বীকৃত ইমামদের তাকলীদ বা ইত্তেবা করা যেতে পারে। কিন্তু এর জন্য কুরআনের পূর্ণ একটি সূরাকে অস্বীকার করা কেমন বিবেকের কাজ?
আফসোস যে, এসব লোক মুক্তাদীর নামায সহীহ হওয়ার জন্য সূরা ফাতিহা পড়াকে ফরয মনে করে, কিন্তু ঈমান সহীহ হওয়ার জন্য পুরো কুরআনের উপর ঈমান আনাকে ফরয মনে করে না। ফাতিহার সাথে এমন মুহাববত যে, তা কুরআন হওয়াকেও অস্বীকার!
আল্লাহ তাআলা এ ধরনের নির্বুদ্ধিতা ও মাযহাবী গোঁড়ামি থেকে আমাদের রক্ষা করুন। আমীন।