সফর ১৪৩১   ||   ফেব্রুয়ারী ২০১০

মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদের একটি রূপ

ফাহমিদ-উর-রহমান

সাম্রাজ্যবাদী মিডিয়ার স্বরূপ তুলে ধরে গত ২৬ জানুয়ারি ঢাকার একটি দৈনিক সংবাদপত্রের ৭-এর পাতায় ‘মিডিয়া সাম্রাজ্যবাদ’ শিরোনামের একটি নিবন্ধ ছাপা হয়। প্রাসঙ্গিকতা বিবেচনায় সে নিবন্ধ থেকে ক্ষুদ্র একটি ‘চয়ন’ এখানে পরিবেশন করা হল। পশ্চিমের মানুষেরা নিজের বোধ-বুদ্ধিকে জলাঞ্জলি দিয়ে প্রচারযন্ত্রের নাচের পুতুলে পরিণত হয়েছে। প্রচারযন্ত্রের প্রচারণার নিরিখেই তারা জীবনের সবকিছু মাপতে চায়, তারা বুঝতে চায় কে কতখানি উন্নত বা অনুন্নত। প্রচারযন্ত্রই সাম্রাজ্যিক স্বার্থে তাদের মাথায় ঢুকিয়ে রেখেছে, অপশ্চিমা বিশ্বের মানুষেরা নিজেদের ভালোমন্দ বুঝতে পারে না। সুতরাং এদের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বাস্তবায়নে পশ্চিমের উন্নত মানুষদের সহায়তা জরুরী। একটু উদাহরণ দেওয়া যাক। চিলিতে সালভেদর আলেন্দের জনপ্রিয় সরকার ক্ষমতায় আসার পর বহুজাতিক কোম্পানি ও তার পাহারাদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথা খারাপ হয়ে যায় এবং আলেন্দের সরকারকে উৎখাতের জন্য তারা সর্বস্ব পণ করে। চিলিতে মার্কিন হ্স্তক্ষেপের সপক্ষে নিক্সন সরকারের ভূমিকাকে আন্তর্জাতিক রাজনীতির তৎকালীন ‘গুডবয়’ হেনরি কিসিঞ্জারের উক্তিটি ‘কিংবদন্তি হয়ে আছে : I do not see why need to stand by and watch a country go communist due to the irresponsibility of its own people. এরপর ১৯৭০ থেকে ’৭৩ পর্যন্ত চিলিতে যা ঘটেছে তা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের ছক অনুযায়ী। আলেন্দে সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র এক মিডিয়াযুদ্ধ শুরু করে এবং সেই অপপ্রচারের তোড়ে আলেন্দে সরকার উৎখাতের জন্য চিলির মানুষের মনোগঠন সম্পন্ন হয়। শেষ পর্যন্ত মিলিটারি ক্যু’র মাধ্যমে আলেন্দে সরকারের অপমৃত্যু ঘটে। সমস- প্রক্রিয়াটি বাস-বায়নে যুক্ত হেিছল বহুজাতিক পুঁজির অধিপতিরা, যারা মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের পক্ষে সাংস্কৃতিক ও মিডিয়ার যন্ত্রগুলোর নিয়ন্ত্রণ করে। ক্যু’ পৃথিবীর কোথাও বিদেশী স্বার্থ ও এলিট শ্রেণীর স্বার্থের নামে হয় না। তা হয়ে থাকে নৈতিকতা, দেশপ্রেম, ঐতিহ্য, জাতিসত্ত্বা এমনকি দুর্নীতির বিরুদ্ধে জেহাদের স্লোগান দিয়ে। এরকম উদাহরণ আমাদের দেশেও আছে। চিলিতেও সে রকম ঘটনা ঘটানো হয়েছিল। সেখানে বলা হয়েছিল, আলেন্দের লোকজন কমিউনিজমের নামে দেশটিকে এক অপসংস্কৃতির দিকে নিয়ে গেছে। বিশেষ করে আলেন্দের দল ক্ষমতায় থাকলে প্রথমে দেশে ঘটবে গৃহদাহ, রক্তস্নান, তারপর দেশটির সুপ্রাচীন সভ্যতারই বিনাশ ঘটে যাবে। এ অবস'ায় চিলির গৌরবময় ঐতিহ্য রক্ষা করতে মিলিটারি ক্যু’র কোনো কিল্প আছে কি? এই প্রক্রিয়ায় যখন ক্যু ঘটেই যায় তখন সেটিকে কেউ প্রতিবিপ্লব বা মার্কিনি ষড়যন্ত্র বলবে না। সবাই মনে করবে, এ ধরনের ঘটনা অবধারিতই ছিল কিংবা এ হচ্ছে প্রকৃতির প্রতিশোধ! আমাদের স্মৃতি থেকে মুছে যায়নি এমন কিছু সামপ্রতিক ঘটনা হচ্ছে ইরাক ও আফগানিস্তান। সাদ্দামকে খলনায়ক নির্মাণের আগে গণমারণাস্ত্র ভাণ্ডারের গল্পকাহিনী নিয়ে বুশ-ব্লেয়ার ও তাদের অনুগত মিডিয়া যেভাবে লাফিয়ে বেড়িয়েছে, তা পৃথিবীর মানুষ দেখেছে। গণধ্বংসের অস্ত্র জমা করার জন্য সাদ্দামের ইরাক বিপজ্জনক রাষ্ট্র হয়ে উঠার গল্পটা যে কতখানি অন্তঃসারশূন্য তা এতদিনে সবাই হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছে। ওটা যে আগাগোড়াই মিথ্যা প্রচার ছিল, ইরাক আগ্রাসনের ছল বা অজুহাত ছিল-সেসব কথা আজ দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। অথচ এই গল্পকাহিনীই আমাদের পশ্চিমা মিডিয়া বিশ্বাস করতে বাধ্য করেছে। আবার কমিউনিস্ট শয়তানদের সাম্রাজ্য থেকে মুক্তি দেওয়ার পর ইসলামিক সন্ত্রাসবাদীদের মূর্খের স্বর্গটিকে রসাতলে পাঠিয়ে এ বিশ্বকে আমেরিকার শিশুদের বাসযোগ্য করে তোলার অঙ্গীকার পালন চলছে, চলবে। এখানেও সাম্রাজ্যবাদীদের মিডিয়ার ‘কর্তব্যপরায়ণতা’য় কোনো ভুল নেই। স্পেকটার অব কমিউনিজমের পর পশ্চিমা মিডিয়া স্পেকটার অব ইসলামের বিরুদ্ধে লড়াই শুরু করেছে। নোয়াম চমস্কি ঠিকই বলেছেন। কমিউনিজমের পর সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধের আড়ালে ইসলামবিরোধীতাকে পশ্চিমা জগত আজ জাতীয় ধর্মে পরিণত করে ফেলেছে। স্বাভাবিকভাবেই পশ্চিমের প্রযুক্তি শাসিত শক্তিশালী মিডিয়া পুঁজিবাদ সাম্রাজ্যবাদের একান্ত অনুগত খেদমতগার হিসেবে ইসলামকেই এই মুহূর্তে তার বড় শত্রু হিসেবে নিশানা করেছে। কমিউনিজমের পতনের পর ইসলামকে এই নিশানা করা কেন? কারণ এটি একটি সুগঠিত আদর্শ। এটি কর্পোরেট পুঁজিকে সমর্থন করে না। সমর্থন করে না বাজার অর্থনীতি, বিশ্বায়নের নামে নতুন কালের অর্থনৈতিক শোষণের দাপাদাপি। পশ্চিমের অবাধ কনজুমারিজম, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ ও আত্মস্বার্থপরতা ইসলামের কাম্য নয়। ইসলাম চায় না একজনের শোষণে আর একজনের অগ্রগতি; ইসলাম চায় আদল, ইহসান ও ইনসাফভিত্তিক সমাজ ব্যবস্থা যেখানে শোষণ ও বঞ্চনা থাকবে না। সাম্রাজ্যবাদীদের পথের কাঁটা এই মতাদর্শকে Preemptive war এর জয়ধ্বজা উড়িয়ে মার্কিন গলিয়াথ খতম করার চেষ্টা করবে, এতে আর অবাক হওয়ার কী আছে। এক্ষেত্রে পুঁজিবাদী সাম্রাজ্যবাদী রাষ্ট্রগুলো তথ্যপ্রযুক্তিকে তাদের স্বার্থে Catalytic converter এর মতো ব্যবহার করে। এজন্য পুঁজিবাদী মিডিয়া ইসলামকে বর্বর, সন্ত্রাসী, জঙ্গি ধর্ম হিসাবে অনবরত প্রচার করে। মৌলবাদ ও সামপ্রদায়িকতার অভিযোগে তাকে অবিরত নিন্দিত হতে হয়। উদ্দেশ্য, কোনো কিছুকে নিন্দিত না বানাতে পারলে তাকে ধরাশায়ী করা যাবে কেমন করে! কেবল শক্তিশালী মিডিয়ার সাহায্যে সাম্রাজ্যবাদীরা ইসলামের সঙ্গে শত্রুতাকে আজ জায়েয করে নিচ্ছে। ইসলাম ও ইসলাম প্রধান জনগোষ্ঠী নিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীদের দৃষ্টিভঙ্গি ভালোভাবে বোঝা দরকার। হামিদ আবদুল করিম তার প্রবন্ধ দি হিপোক্রেসি অব ওয়েস্টার্ণ মিডিয়াতে লিখেছেন : লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি খবরের কিছু অংশ দেখা যাক, ‘একদল আমেরিকান উগ্রপন্থী হিজ ম্যাজেস্টির শান্তিরক্ষী বাহিনীকে আক্রমণ করে অনেক ব্রিটিশ সৈন্যকে হত্যা করেছে। সামপ্রতিকতম এই সন্ত্রাসী হামলার খবরে প্রধানমন্ত্রী সব ধরনের সন্ত্রাসী কার্যকলাপ বন্ধ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন এবং মহামান্য রাজাকে এই বলে আশ্বস্ত করেছেন-যতদিন পর্যন্ত না আমেরিকান সন্ত্রাসীরা তাদের দুষ্কর্ম বন্ধ করে আত্মসমর্পণ করছে,ততদিন তিনি শান্তিতে বিশ্রাম নেবেন না। এই খবর একটু অদ্ভূত শোনাতে পারে : কিন্তু সাম্রাজ্যবাদী প্রভু ব্রিটেনের বিরুদ্ধে আমেরিকার স্বাধীনতা সংগ্রাম চলাকালে হোয়াইট হল থেকে এরকম খবরই পরিবেশন করা হতো। স্বাভাবিকভাবেই এখবর শুনে সেই সময়ের আমেরিকাবাসীরা হেসেছিল। কিন্তু আজকে তারা হুবহু একই ধাঁচে ইসলামী সন্ত্রাসবাদ ও মুসলিম চরমপন্থী নামে অপপ্রচার চালাচ্ছে এবং বিশ্বকে তা বিশ্বাসও করাতে চাচ্ছে। প্রচারণার এই ধরণটা চিরকাল একই রকম। হয় আমাদের সঙ্গে থাক না হলে ভাগাড়ে গিয়ে মরো। পেন্টাগন, হোয়াইট হাউস এবং স্টেট ডিপার্টমেন্টের পছন্দসই হলে টিকবে, নইলে ধ্বংস হয়ে যাবে। স্বাধীনতা সংগ্রামী, মতাদর্শিক যোদ্ধা এতে কিছু আসে যায় না। আমেরিকার জিঘাংসার বিরুদ্ধে, ক্যাপিটালিজমের বিরুদ্ধে, বিশ্বায়ন-বাজার অর্থনীতির বিরুদ্ধে যে-ই দাঁড়াবে, মোকাবিলা করার কথা বলবে, সে-ই রাতারাতি সভ্যতার শত্রু, জঙ্গি, বর্বর, সন্ত্রাসী বনে যাবে। ... এ কথা বলার অপেক্ষা রাখে না, মুসলিম রাষ্ট্র ও জনগণ আজও পাশ্চাত্যের পুঁজিপতিদের নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার উপর ভয়ানকভাবে নির্ভরশীল। এই নির্ভরশীলতা আন্তর্জাতিক দুনিয়ায় প্রতিযোগিতার ক্ষেত্রে মুসলিম জনগণের অবস্থানকে প্রতিনিয়ত দুর্বল করে দিচ্ছে। পুঁজিপতি মিডিয়াগুলোর অবিরত প্রচারণা মুসলিম জনগণের মাঝে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করে। তাদের মধ্যে নৈরাজ্য উৎপাদন করে। এসবের ফলে স্থানীয় ঐতিহ্যবাহী সাংস্কৃতিক ধারণাগুলোর অবলুপ্তি ঘটে। এগুলো ধীরে ধীরে ভিনদেশী ধারণা দ্বারা প্রতিস্থাপিত হয়। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের পথ হচ্ছে মিডিয়াকে ব্যবহার করা। মিডিয়ার প্রচারণাকে মিডিয়া দিয়েই প্রতিহত করতে হবে। এই কৌশল আজ মুসলমানদের আয়ত্ত করতে হবে। পাশ্চাত্যর সুপ্রসিদ্ধ ধর্মবিষয়ক পণ্ডিত ‘Muhammad: The biography of a Prophet’ - এর নন্দিত রচয়িতা কারেন আর্মস্টং-এর একটি উদ্ধৃতি দিতে চাই, যা মিডিয়া জগতে একালের মুসলমানদের দায়িত্ব ও করণীয় সম্পর্কে একটা ধারণা দেয়। একশ শতকে মুসলমানরা এরকম একটা স্ট্রাটেজি ছাড়া পুঁজিবাদ-সাম্রাজ্যবাদ নিয়ন্ত্রিত মিডিয়ার যুদ্ধকে মোকাবিলা করতে পারবে না। মুসলমানদের মিডিয়াকে ব্যবহার করা উচিত ইহুদিদের মতো মুসলমানদের লবিং করতে জানতে হবে এবং তাদের একটি মুসলিম লবির সৃষ্টি করতে হবে। আপনি যদি চান এটাকে জিহাদ বলতে পারেন। এটা এমন একটা প্রচেষ্টা, এমন সংগ্রাম; যেটা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যদি আপনি মিডিয়াকে পরিবর্তন করতে চান, তাহলে মানুষকে আপনার বুঝাতে হবে; ইসলাম রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক দিক দিয়ে একটি শক্তি। কিভাবে মিডিয়াকে ব্যবহার করতে হবে এবং মিডিয়াতে নিজেদের কিভাবে উপস্থাপন করতে হবে তা মুসলমানদের জানতে হবে। মুসলিম উম্মাহকে এই নবতর চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করার বিকল্প কোনো পথ নেই।

 

advertisement