সফর ১৪৩৬   ||   ডিসেম্বর ২০১৪

একটি বই, একটি চিঠি : পর্যালোচনা-২

মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল গাফফার

মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব যোহরের সালাতের ওয়াক্ত নিয়ে আলোচনা করতে গিয়ে বলেছেন, ‘যোহরের সালাত দেরী করে আদায় করার কোনো সহীহ দলীল নেই। উক্ত মর্মে যা বর্ণিত হয়েছে তা ত্রুটিপূর্ণ।’ এরপর প্রথমেই তিনি একটি  হাদীস উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন, ‘বর্ণনাটি জাল।’ তিনি বলেছেন, ‘অনেকে উক্ত বর্ণনা পেশ করে যোহরের ছালাত দেরীতে আদায় করার দাবী করেন।’

            আমার প্রশ্ন হল, কারা এই দাবী করেন। তিনি তাদের নামধাম স্পষ্ট করলেন না কেন?  সাধারণ পাঠক তো আর কিতাব ঘাঁটাঘাঁটি করে কে এই হাদীসকে দলীল হিসাবে পেশ করেন তা বের করতে পারবে না। ফলে তাদের মনে এই প্রশ্ন জাগা স্বাভাবিক যে, আসলেই কেউ এই বর্ণনা পেশ করেন, না লেখক খামাখা একটি জাল হাদীস উল্লেখ করে তার বইয়ের নামটির বৈধতা প্রমাণ করার প্রয়াস চালিয়েছেন?

            যোহরের সালাত গ্রীষ্মকালে দেরী করে আদায় করার পক্ষে সহীহ হাদীস বিদ্যমান আছে। লেখক নিজেও সেই সহীহ হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন। এবং লেখক স্পষ্টরূপে ব্যক্ত না করলেও তার লেখা দ্বারা বুঝা যায় যে, তিনিও  গ্রীষ্মকালে যোহরের সালাত দেরী করে আদায় করার পক্ষপাতী। তাহলে কেন তিনি শর্তনিরপেক্ষভাবে বললেন যে, যোহরের সালাত দেরী করে আদায় করার কোনো সহীহ দলীল নেই? আর কেনই বা লেখক ঐ আমলের পক্ষে জাল হাদীস উল্লেখ করলেন?

            যদি কোনো আমলের পক্ষে সহীহ হাদীস না থাকে তবে জাল হাদীসকে দলীল হিসাবে গ্রহণ করে কোনো আমল চালু করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। যদি কোনো আমলের পক্ষে সহীহ ও জাল উভয় প্রকার হাদীসই বিদ্যমান থাকে তখন ঐ সহীহ হাদীসকেই দলীল হিসাবে বর্ণনা করতে হবে। ঐ আমলের পক্ষের জাল হাদীসটি  বর্ণনা করা বৈধ হবে না। কেউ যদি এরূপ করে তবে তাকে আমরা বলতে পারি যে, জাল হাদীস বর্ণনা করে তাকে দলীল হিসাবে পেশ করা তোমার জন্য বৈধ হয়নি। কিন্তু তার জাল হাদীস বর্ণনার কারণে তার আমলটি জাল হাদীসের কবলে পড়ে গেছে এ কথা বলাও নির্বুদ্ধিতা এবং শরীয়তের দৃষ্টিতে হারাম। কেননা তার আমলের পক্ষে সহীহ হাদীসও তো রয়েছে।

            লেখক এরপর যে হাদীসটি লিখেছেন তা এই:

عَنْ عَبْدِ الْعَزِيْزِ بْنِ رَفِيْعٍ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صلَّى الله عليه وسلم عَجِّلُوْا صَلَاةَ النَّهَارِ فِىْ يَوْمٍ غَيْمٍ وَ أَخِّرُوْا الْمَغْرِبَ

            হাদীসটির অনুবাদ লেখকের ভাষায়: আব্দুল আযীয ইবনু রাফী বলেন, রাসূলুল্লাহ (ছাঃ) বলেছেন, তোমরা মেঘলা দিনে দিনের ছালাত তাড়াতাড়ি আদায় কর এবং মাগরিব দেরীতে আদায় কর।

            এই হাদীসের উপর লেখক মন্তব্য করেছেন এই কথা বলে, ‘বর্ণনাটি দুর্বল। আব্দুল আযীয ইবনু রাফী মুরসাল হওয়া সত্ত্বেও সরাসরি রাসূল (ছাঃ) থেকে বর্ণনা করেছে।

            লেখক আব্দুল আযীযের পিতার নাম লিখেছেন رَفِيْع  (রাফী)। অথচ তিনি رُفَيْع (রুফাই‘)। আব্দুল আযীযকে তিনি মুরসাল বলেছেন অথচ তিনি মুরসিল। মুরসাল নন। মুরসাল হল তাঁর কর্তৃক বর্ণিত এই হাদীসটি। আব্দুল আযীয তাবিঈ হওয়া সত্ত্বেও হাদীস বর্ণনা করেছেন সরাসরি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে। বলেছেন, ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন’। তিনি যেহেতু তাবিঈ সেহেতু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের কোনো হাদীস তিনি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হতে সরাসরি শ্রবণ করতে পারেন না। অন্য কোনো সূত্র হতে তিনি হাদীস শ্রবণ করতে পারেন। সেই সূত্রটি সাহাবীও হতে পারে বা অন্য এমন কোনো তাবিঈও হতে পারে, যে তাবিঈ হাদীসটি শ্রবণ করেছেন কোনো সাহাবী হতে। যেহেতু তিনি সূত্রটি উল্লেখ করেননি এজন্য তাঁর বর্ণিত হাদীসটি হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষায় মুরসাল। আর তার এ কাজটা অর্থাৎ সূত্র উল্লেখ না করা হল ইরসাল। আর তিনি হলেন মুরসিল।  অতএব লেখকের উচিত ছিল আব্দুল আযীযকে মুরসিল বলা। যদি লেখক আব্দুল আযীযকে মুরসাল না বলে মুরসিল বলতেন তাহলে শব্দের প্রয়োগ সঠিক হত। কিন্তু তখনও তাঁর বাক্যটি হত অশুদ্ধ।  কারণ,  আব্দুল আযীয সরাসরি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে বর্ণনা করেছেন বলেই তো তিনি মুরসিল, আর তাঁর বর্ণিত হাদীসটি মুরসাল। সুতরাং ‘মুরসিল হওয়া সত্ত্বেও’ কথাটির কোন অর্থই হয় না। কথাটি যেন হয়েছে বা হত কোনো নির্বোধের এই কথার ন্যায় -‘লোকটি সাক্ষর হওয়া সত্ত্বেও লিখতে পড়তে জানে’ বা ‘লোকটি ইমাম হওয়া সত্ত্বেও ইমামতি করেছে।’

            হাদীস শাস্ত্রে লেখকের জ্ঞান নেহায়েতই অপরিপক্ক বলে অনুমিত হয়। কামনা করি, আমার এই অনুমান সঠিক না হোক। লেখকের গবেষণা বহুলাংশে শায়েখ আলবানী-নির্ভর বলে মনে হয়। কিন্তু শায়খ আলবানীর বক্তব্যও লেখক ভালো করে বোঝেন বলে মনে হয় না। কারণ, শায়খ আলবানী রাহ. এই হাদীসটি সম্পর্কে বলেছেন,

 وهذا اسناد ضعيف ورجاله ثقات وهو مرسل          অর্থাৎ এটা যঈফ সনদ, হাদীসটির রাবীগণ সকলেই ছিকাহ বা নির্ভরযোগ্য এবং হাদীসটি মুরসাল। هو সর্বনামটি ব্যবহৃত হয়েছে হাদীসটির পরিবর্তে, আব্দুল আযীযের পরিবর্তে নয়। আব্দুল আযীযের পরিবর্তে ব্যবহৃত হয়েছে বলে যদি ধরা হয় তবে পরবর্তী শব্দটি হবে মুরসিল, মুরসাল নয়। অর্থ হবে, এবং আব্দুল আযীয মুরসিল। লা ইলাহা ইল্লাল্লাহুল হালীমুল কারীম।

            শায়খ আলবানী রাহ. হাদীসটির সকল রাবী নির্ভরযোগ্য বলে মত প্রকাশ করেছেন। শুধু আব্দুল আযীযের ইরসালের কারণে হাদীসটির সনদকে তিনি যঈফ বললেন। অথচ দেখুন, স্বয়ং আলবানীই তাঁর গ্রন্থ ইরওয়াউল গালীলে ৪৯৬ নং হাদীসের আলোচনার এক পর্যায়ে আব্দুল আযীয ইব্ন রুফাই‘ বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন এবং বলেছেন,       

 أخرجه البيهقى. وهو شاهد قوى فإنه رجاله كلهم ثقات , وعبد العزيز بن رفيع تابعى جليل روى عن العبادلة: ابن عمر وابن عباس وابن الزبير وغيرهم من الصحابة وجماعة من كبار التابعين , فإن كان شيخه ـ وهو الرجل الذى لم يسمه ـ صحابياً فالسند صحيح , لأن الصحابة كلهم عدول فلا يضر عدم تسميته كما هو معلوم , وإن كان تابعياً , فهو مرسل لا بأس به كشاهد , لأنه تابعى مجهول , والكذب فى التابعين قليل , كما هو معروف.

            অর্থাৎ হাদীসটিকে তাখরীজ করেছেন ইমাম বায়হাকী। হাদীসটি শক্তিশালী সাক্ষী ও সমর্থক। কেননা, হাদীসটির সকল রাবী নির্ভরযোগ্য। আর আব্দুল আযীয ইব্ন রুফাই‘ বড় মাপের একজন তাবিঈ। তিনি আব্দুল্লাহগণ হতে তথা আব্দুল্লাহ ইব্ন উমার, আব্দুল্লাহ ইব্ন আববাস, আব্দুল্লাহ ইব্ন যুবাইর প্রমুখ সাহাবী হতে এবং একদল বড় বড় তাবেয়ী হতে হাদীস বর্ণনা করেছেন। তো যদি তাঁর শায়েখ -যাঁর নাম তিনি উল্লেখ করেননি- সাহাবী হন তাহলে সনদটি সহীহ। কারণ, সাহবাগণ সকলেই নির্ভরযোগ্য। সুতরাং তাঁদের নাম উল্লেখ না করা ক্ষতির কোনো কারণ নয়। সকলের নিকট যেমনটা সুবিদিত। আর যদি তাবিঈ হন তাহলে হাদীসটি এমন মুরসাল যা সমর্থক হিসাবে গ্রহণযোগ্য হতে অসুবিধা নেই। কেননা, ঐ তাবিঈ মাজহুল। আর তাবিঈগণের মধ্যে মিথ্যার চর্চা ছিল কম, যেমনটা সকলের নিকট প্রসিদ্ধ।

            এখানে শায়খ আলবানী রাহ.-এর বক্তব্যের নির্যাস হল, হাদীসটির সকল রাবী যেহেতু নির্ভরযোগ্য সেহেতু আব্দুল আযীয যদি সাহাবী থেকে হাদীসটি শ্রবণ করে থাকেন তাহলে হাদীসটির সনদ সহীহ। আর যদি তিনি হাদীসটি শ্রবণ করে থাকেন তাবিঈ হতে তাহলে তা এমন মুরসাল যা সমর্থক হাদীস হিসাবে বিবেচিত হতে পারে। এখানে আব্দুল আযীযের মুরসাল বর্ণনাকে তিনি যঈফ বলছেন না। অথচ আমাদের আলোচ্য ক্ষেত্রে আব্দুল আযীযের মুরসাল বর্ণনাকে তিনি শর্তহীন ভাবে যঈফ বলে দিলেন। তাহলে কি শায়েখ আলবানী রাহ. কোনো বিশেষ মূলনীতির অনুসরণ না করে যেখানে যেমন সুবিধা সেখানে তেমন নীতিই অবলম্বন করে থাকেন? আর আমাদের দেশের লা-মাযহাবী ভাইয়েরাও কি শায়খ আলবানীর অনুসরণ করে তা-ই করেন?

মেঘলা দিনের হাদীসের মর্ম ও পর্যালোচনা

            হাদীসটিতে বলা হয়েছে, মেঘলা দিনে দিনের সালাতকে তাড়াতাড়ি আদায় কর। দিনের সালাত বলতে এখানে আসরের সালাত বুঝানো হয়েছে। মেঘলা দিনে আসরের সালাতকে তাড়াতাড়ি আদায়ের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে যাতে আসরের সালাত মাকরূহ ওয়াক্তে উপনীত না হয় অথবা আসর ফউত না হয়ে যায়। আর মাগরিবকে দেরী করে আদায়ের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে, যাতে মাগরিবের সালাত সূর্যাসেত্মর পূর্বেই আদায় না হয়ে যায়। দিনের সালাত বলে যে আসর বুঝানো হয়েছে তা অন্য একটি হাদীসে স্পষ্টরূপেই ব্যক্ত হয়েছে। হাদীসটি বুরাইদাহ আল-আসলামী রা. কর্তৃক বর্ণিত। মুসান্নাফে ইব্ন আবী শাইবাতেই হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে। হাদীসটির সনদ সহীহ। হাদীসটি এই:  

حَدَّثَنَا وَكِيعٌ ، قَالَ : حدَّثَنَا الأَوْزَاعِيُّ ، عَنْ يَحْيَى بْنِ أَبِي كَثِيرٍ ، عَنْ أَبِي قِلاَبَةَ ، عَنْ أَبِي الْمُهَاجِرِ ، عَنْ بُرَيْدَةَ الأَسْلَمِيِّ ، قَالَ : كُنَّا مَعَهُ فِي غزَاةٍ ، فَقَالَ : سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ : بَكِّرُوا بِالصَّلاَة فِي الْيَوْمِ الْغَيْمِ ، فَإِنَّهُ مَنْ فَاتَتْهُ صَلاَةُ الْعَصْرِ حَبِطَ عَمَلُهُ

            অর্থাৎ আবুল মুহাজির বলেন, আমি এক যুদ্ধে বুরাইদাহ আল-আসলামী রা.-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি বললেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, মেঘলা দিনে তোমরা সালাতকে তাড়াতাড়ি আদায় কর। কেননা, আসরের সালাত যার ফউত হয়ে যায় তার আমল বিনষ্ট হয়ে যায়। -মুসান্নাফে ইব্ন আবী শাইবাহ, হাদীস ৬৩৪৮

            হাদীসটি বুখারী শরীফেও আছে। হাদীসটিতে বুরাইদাহ রা. আসরের সালাতকে আগে আগে আদায় করার কথা বলেছেন। হাদীস ৫৫৩ নং। হাদীসটি এই:

عَنْ أَبِي الْمَلِيحِ قَالَ : كُنَّا مَعَ بُرَيْدَةَ فِي غَزْوَةٍ فِي يَوْمٍ ذِي غَيْمٍ فَقَالَ بَكِّرُوا بِصَلاَةِ الْعَصْرِ فَإِنَّ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم قَالَ : مَنْ تَرَكَ صَلاَةَ الْعَصْرِ فَقَدْ حَبِطَ عَمَلُهُ.

            আবুল মালীহ বলেন, আমরা এক যুদ্ধে মেঘলা দিনে বুরাইদাহ রা.-এর সঙ্গে ছিলাম। তিনি বললেন, আসরের সালাতকে আগে আগে আদায় কর কেননা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আসরের সালাত তরক করে তার আমল বিনষ্ট হয়ে যায়।

            অতএব, লেখক কর্তৃক উদ্ধৃত হাদীসটি যোহরের সাথে সম্পৃক্ত নয়, আসরের সাথে সম্পৃক্ত। হাদীসটিকে যোহরের সালাত দেরী করে আদায় করার পক্ষে কে দলীল হিসাবে পেশ করে থাকে তা স্পষ্টরূপে ব্যক্ত করা লেখকের উচিত ছিল। কেউ যদি তা করেই থাকে তাহলে লেখকের পক্ষে এই জবাব দানই যথেষ্ট ছিল যে, হাদীসটি যোহর সংক্রান্ত নয়। যুক্তিযুক্ত জবাব না দিয়ে লেখক হাদীসটিকে ঢালাওভাবে যঈফ বলে দিয়েছেন যা যুক্তিযুক্ত হয়নি। আসর সংক্রান্ত হাদীসকে যোহরের সালাতের আলোচনায় উল্লেখকরণ অতপর হাদীসটিকে যঈফ বলে মন্তব্যকরণ হাদীসশাস্ত্রে লেখকের দৈন্যদশার চিত্রই স্পষ্ট করে তোলে।

মুহতারাম,

            আশা করি উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্টরূপেই আপনি লেখকের ভুল-ভ্রান্তি সম্পর্কে অবগত হয়েছেন এবং এও বুঝেছেন যে, সেসব ভুল-ভ্রান্তি কত প্রকার ও কী পরিমাণ। আপনার মাধ্যমে লা-মাযহাবী ভাইদেরকে বলব, তাঁরা যেন এইজাতীয় লেখকের অন্ধ তাকলীদ করে না বসেন। তাকলীদ তো তাঁদের মতে শির্কতুল্য। তাঁদের লেখকের বই পুস্তকাদি পাঠ করার সঙ্গে সঙ্গে তাঁরা যেন ভিন্ন মতাবলম্বীর বই পুস্তকও একটু নাড়াচাড়া করে দেখে নেন। অতপর নিরপেক্ষ মস্তিষ্কে একটু চিন্তা করেন।

            লেখক এরপর যোহরের ছালাতের সঠিক সময় শিরোনামে তিনটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। শেষ দুইটি হাদীস দ্বারা স্পষ্ট বুঝা যায় যে, গ্রীষ্মকালে যোহরের সালাত দেরী করে আদায় করা মুস্তাহাব। যোহরের সালাত কখন আদায় করা মুস্তাহাব লেখক তা স্পষ্ট করে বলেননি। হাদীসগুলো উল্লেখ করার পর তিনি লিখেছেন, সুধী পাঠক, হাদীছের প্রতি ভ্রুক্ষেপ না করে সারা বছর এদেশে যোহরের সালাত দেরী করে পড়া হয়। এটা সুন্নাতের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি প্রদর্শন করার শামিল।

            আমি বলব, না ভাই মুযাফফর সাহেব, এদেশে যোহরের সালাত আদায় করার ক্ষেত্রে গ্রীষ্মকাল ও শীতকালের পার্থক্য করা হয়। কে না জানে যে, আমাদের দেশে শীতকালে যোহরের সালাতের জামাআত অনুষ্ঠিত হয় সোয়া একটায় আর গ্রীষ্মকালে হয় দেড়টায়? তবে শীতকালে আরও একটু আগে আদায় করা উচিত বলে আমি মনে করি।

            এরপর লেখক লিখেছেন, রাসূল (ছাঃ) এর অনুসারী হিসাবে একজন মুছল্লীকে যোহরের ছালাত কখন পড়া উচিৎ? গ্রীষ্মকালের হাদীসের আলোকে সে কি সারা বছর দেরী করে আদায় করবে?

            আমি বলব, না সারা বছর দেরী করে আদায় করা উচিত নয়। এ দেশের মানুষ তা করেও না। কিন্তু  মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব গ্রীষ্মকালের হাদীসের আলোকে গ্রীষ্মকালে যোহরের সালাত দেরী করে আদায় করেন কি না তা আমরা জানি না। যদি করেন তাহলে তাঁর নিকট গ্রহণযোগ্য আউয়াল ওয়াক্ত সংক্রান্ত হাদীসগুলোর কী হবে? সেগুলোর সঙ্গে তিনি কী আচরণ করেন? আর যদি না করেন তাহলে গ্রীষ্মকালে যোহরের সালাত দেরী করে আদায় করা সংক্রান্ত সহীহ হাদীসগুলোর কী হবে? সেগুলোর সঙ্গে তিনি কী আচরণ করেন? কথা বলতে বা লিখতে সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। নিজের নিক্ষিপ্ত থুথু যেন নিজের দিকেই ছুটে না আসে তার প্রতি খেয়াল রাখা দরকার।

            যোহরের ছালাতের সঠিক সময় শিরোনামে লেখকের উদ্ধৃত তৃতীয় হাদীসটির তরজমা দেখুন। তরজমার একটি অংশে লেখক লিখেছেন, তখন আবার বললেন, আমরা তালূল দেখা পর্যন্ত দেরী কর। ‘আমরা তালূল দেখা পর্যন্ত’  কথাটিকে তিনি রাসূলের উক্তি বানিয়ে দিয়েছেন। অথচ কথাটি বর্ণনাকারী সাহাবীর। রাসূলের উক্তি হলে আরবী হত এরূপ:

  فقال له أبرد حتى نرى فـيء التلول  

            অথচ হাদীসে বাক্যটি আছে এইরূপ: حتى رأينا فـيء التلول (এমনকি আমরা টিলাসমূহের ছায়া দেখলাম।) সাহাবী বলছেন যে, রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুয়ায্যিনকে বারবার দেরী করতে বললেন, দেরী করতে করতে এতটুকু দেরী হল যে, আমরা টিলাসমূহের ছায়া দেখলাম। মুসলিম শরীফের হাদীস দ্বারা স্পষ্টতই বুঝা যায় যে, এটি সাহাবীর উক্তি। হাদীসটিতে আছে

 قال أبو ذر حتى رأينا فـيء التلول (অর্থাৎ আবূ যার রা. বলেন, এমনকি আমরা টিলাসমূহের ছায়া দেখলাম।)

আরেকটি বিষয় লক্ষ করুন, تلول শব্দটি تلّ -এর বহুবচন। লেখক তরজমায় শব্দটিকে ‘তালূল’-ই রেখে দিয়েছেন। শব্দটি যে বহুবচন তা বোধ হয় লেখকের জানা নাই। তাছাড়া শব্দটি তালূল নয়, তুলূল । আরও দেখুন, হাদীসে আছে فـيء التلول । অর্থাৎ টিলাসমূহের ছায়া দেখলাম। লেখক ফাই শব্দটির কোন তরজমাই করেননি। লিখেছেন, ‘আমরা তালূল দেখা পর্যন্ত দেরী কর।’ লেখকের জ্ঞানের বহরটা এবার পরিমাপ করুন যে, তা কতটুকুন? তালূল দেখা পর্যন্ত দেরী করার কোনো অর্থ হয় কি না লেখক তা একটুও চিন্তা করলেন না!

আছরের ছালাতের ওয়াক্ত

লেখক লিখেছেন, আছরের ছালাত দেরী করে পড়ার যে প্রথা সমাজে চালু আছে তার ছহীহ কোন ভিত্তি নেই। এর পক্ষ যে সমস্ত বর্ণনা প্রচলিত আছে সেগুলো সবই যঈফ ও জাল। এরপর লেখক যে হাদীসটি এনেছেন তা এই :    

 عَنْ عَبْدِ الْوَاحِدِ بْنِ نَافِعٍ قَالَ دَخَلْتُ المَسْجِدَ فَأَذَّنَ المُؤَذِّنٌ بِالْعَصْرِ قَالَ وَشَيْخٌ جَالِسٌ فَلاَمَهُ وَقَالَ إِنَّ أَبِي أَخْبَرَنِي أَنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم كَانَ يَأْمُرُ بِتَأْخِيرِ هَذِهِ الصَّلاَةِ

            হাদীসটির তরজমা হবে এইরূপ: আব্দুল ওয়াহেদ ইব্ন নাফে‘ বলেন, আমি মসজিদে প্রবেশ করলাম। তখন মুয়াযযিন আসরের আযান দিল। তিনি বলেন, তখন এক বৃদ্ধ মসজিদে বসে ছিলেন। বৃদ্ধ লোকটি মুয়াযযিনকে তিরস্কার করলেন এবং বললেন, আমার পিতা আমাকে জানিয়েছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসরের সালাত দেরী করে পড়ার নির্দেশ দিতেন।

            এবার লেখক কর্তৃক কৃত তরজমার সঙ্গে মিলিয়ে নিন এবং দেখুন তিনি কোথায় ভুল করেছেন। নাফে‘ কে তিনি রাফে‘ বানিয়েছেন। হতে পারে এটা মুদ্রণজনিত প্রমাদ। কিন্তু فلامه কথাটির তরজমা তিনি করেছেন ‘তাই মুয়াযযিন তার নিকটে আসল। এটা মুদ্রণজনিত প্রমাদ নয়। তরজমা হবে, ‘বৃদ্ধ লোকটি মুয়াযযিনকে তিরস্কার করলেন।’ লেখক কি আরবীও জানেন না? আপনি লেখকের পরিচয় তুলে ধরতে গিয়ে বলেছেন লেখক ড.। কোন্ বিষয়ে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রী লাভ করেছেন জানতে পারলে ভাল হত। এরপর লেখক হাদীসটিকে যঈফ বলে মন্তব্য করে ইমাম দারাকুতনীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন এইভাবে : ইমাম দারা কুতনী বলেন, এর সনদে আব্দুল্লাহ বিন রাফে‘ বিন খাদীজ বিন রাফে‘ নামে একজন রাবী আছে। সে নির্ভরযোগ্য নয়। লেখক দারা কুতনী কর্তৃক বর্ণিত হাদীস ও তাঁর মন্তব্যের মাঝে গাতরাবূদ করে ফেলেছেন। আরবী ক্বদীম লিখন পদ্ধতিতে দাঁড়ি, কমার ব্যবহার হয় না। আরবী ব্যাকরণ ও ভাষারীতি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকলে দাঁড়ি কমার প্রয়োজনও হয় না। লেখকের দুর্বলতা এ ক্ষেত্রে একটু বেশীই বলে মনে হয়। যা হোক, দারাকুতনীর এই হাদীসের শেষে আছে :

 فسألت عنه فقالوا  هذا عبد الله بن رافع بن خديج ابن رافع هذا ليس بقوي  

            অর্থাৎ বর্ণনাকারী আব্দুল ওয়াহেদ ইব্ন নাফে‘ বলেন, আমি ঐ বৃদ্ধ লোকটি সম্পর্কে লোকদেরকে জিজ্ঞেস করলাম যে, লোকটি কে? লোকেরা বলল, সে আব্দুল্লাহ ইব্ন রাফে‘ ইব্ন খাদীজ। এরপর আন্ডারলাইন করা অংশটুকু ইমাম দারাকুতনীর মন্তব্য। তিনি বলছেন যে, এই ইবনু রাফে‘ শক্তিশালী নয়। কোন্ অংশটুকু কোন্ অংশের সাথে সম্পৃক্ত, কার বক্তব্য কতটুকু এবং কোন্ পর্যন্ত তা না বুঝলে তো বিভ্রাট ঘটে যায়। যেমন এখানে ঘটেছে। লেখক আব্দুল্লাহ ইব্ন রাফে‘র পিতামহ খাদীজের পিতার নামও রাফে‘ বলে দিয়েছেন। অবশ্য এখানকার বিভ্রাটটি মারাত্মক নয়। কিন্তু কোথাও কোথাও বিভ্রাটটি মারাত্মক হতে পারে এবং তা মারাত্মক বিপর্যয় সৃষ্টি করতে পারে। লেখকের প্রতি আমার অনুরোধ তিনি আরও সতর্কতার সাথে কিতাব পাঠ করবেন এবং কোনো কথা লেখার পূর্বে শতবার চিন্তা করবেন।

            এরপর লেখক নাফে‘ কর্তৃক বর্ণিত হযরত ওমর রা.-এর একটি পত্র উদ্ধৃত করেছেন এবং তরজমা শেষে মন্তব্য করেছেন এই বলে: মূলত উক্ত হাদীছে যোহর, আছর ও মাগরিবের ছালাতের সময়কে ছহীহ হাদীছের বিরোধী হিসাবে পেশ করা হয়েছে। বিশেষ করে আছরের সময়।

মুহতারাম,

            হযরত ওমর রা.-এর পত্রে যোহরের সালাতের সময়ের কথা বলা হয়েছে যে, যোহর আদায় করবে যখন ছায়া এক হাত হবে, তোমাদের কারও ছায়া তার সমান হওয়া পর্যন্ত। এটা সহীহ হাদীসের বিরোধী হল কী করে? সম্ভবত লেখক ‘যখন ছায়া এক হাত হবে’ কথাটির অর্থই বোঝেননি। সূর্য যখন মাথার উপর থেকে  একটু ঢলে যায় তখন একজন মানুষের ছায়া সাধারণত এক হাত পরিমাণ হয়। কোনো কোনো সহীহ হাদীসে সূর্য ঢলার মুহূর্তের ছায়ার পরিমাণের কথা বলা  হয়েছে স্যান্ডেলের ফিতার পরিমাণ। তার কারণ, স্থান ও কাল ভেদে ঐ সময়কার ছায়া ভিন্ন ভিন্ন পরিমাণ হতে পারে। তো এক হাত পরিমাণ ছায়ার কথা বলে হযরত ওমর রা. সূর্য ঢলার কথা বুঝিয়েছেন। তাহলে হাদীসটি সহীহ হাদীসের বিরোধী হল কী করে?

            মাগরিবের সালাতের কথা বলা হয়েছে যে,  এবং মাগরিব আদায় করবে যখন সূর্য ডুবে যাবে। এটা কি সহীহ হাদীসের বিরোধী? লেখক কি আমাদেরকে জানাবেন, সহীহ হাদীসে কী আছে? লেখকের আলোচ্য বইয়ের ১২৭ নং পৃষ্ঠায় ফজরের সালাতের আলোচনায় লেখক হযরত আনাস ও হযরত জাবির রা. কর্তৃক বর্ণিত যে দুইটি সহীহ হাদীস উল্লেখ করেছেন তাতে তো একই কথা বলা হয়েছে। হাদীস দুইটিতে বলা হয়েছে, والمغرب اذا غربت الشمس  (এবং মাগরিব আদায় করতেন সূর্য যখন ডুবে যেত।) সম্ভবত লেখক হযরত ওমরের পত্রে غابت  শব্দ দেখেছেন এবং উক্ত হাদীস দুইটিতে غربت  শব্দ দেখেছেন। তাই মনে করেছেন যে, হযরত ওমরের পত্রে মাগরিবের সালাতকে সহীহ হাদীসের বিরোধী হিসাবে দেখানো হয়েছে। তা-ই যদি হয় তাহলে পাঠকবৃন্দের উচিত লেখককে করুণা করা। তাঁর ন্যুনতম ভাষাজ্ঞান না থাকার কারণে। কারণ, শব্দ দুইটির মর্ম এক ও অভিন্ন। একটির আক্ষরিক অর্থ হল, সূর্য যখন অদৃশ্য হয়ে যেত। সূর্য অদৃশ্য হওয়ার অর্থ হল, অস্ত যাওয়া। অপরটির আক্ষরিক অর্থই হল, সূর্য যখন অস্ত যেত। তাহলে বিরোধ কোথায়?

            আসরের ওয়াক্ত সম্পর্কে লেখক বলেছেন যে, হযরত ওমর রা.-এর পত্র সম্বলিত এই হাদীসে বিশেষ করে আসরের সময়কে সহীহ হাদীসের বিরোধী হিসাবে দেখানো হয়েছে। এর কারণ তিনি বলেছেন যে, ছহীহ হাদীছে চার মাইলের কথা এসেছে। যে ছহীহ হাদীছের কথা তিনি বললেন, তা বুখারীর ৫৫০ নং হাদীস। হাদীসটি তিনি তাঁর বইয়ের ১৩৪ নং পৃষ্ঠায় ‘আছরের ছালাতের সঠিক সময়’ শিরোনামে প্রথমেই উল্লেখ করেছেন। দেখুন, ঐ হাদীসে অওয়ালীয়ে মদীনার সর্বোচ্চ দূরবর্তী স্থানের কথা বলা হয়েছে যে, তা মদীনা হতে চার মাইল দূরে বা অনুরূপ দূরে। আওয়ালীয়ে মদীনার দূরত্বের কথাটি হযরত আনাস রা. বলেছেন অথবা ইমাম যুহরী বলেছেন। সুনানে আবূ দাঊদ, মুসনাদে আহমাদ ও বায়হাকীসহ বিভিন্ন কিতাবে স্পষ্টই ব্যক্ত হয়েছে যে, কথাটি ইমাম যুহরীর। যেই বলুননা কেন  তিনি নির্দিষ্ট করে দেননি যে, তা চার মাইল দূরে। বরং বলেছেন, চার মাইল বা অনুরূপ দূরে। সুতরাং চার মাইলও হতে পারে আবার তিন মাইলও হতে পারে। উপরিউক্ত কিতাবগুলোর বর্ণনায় ইমাম যুহরী বলেছেন, মদীনা হতে আওয়ালীর দুরত্ব দুই মাইল বা তিন মাইল। বর্ণনাকারী বলেন, আমার যতদূর মনে পড়ে তিনি চার মাইলের কথাও বলেছেন। দ্বিতীয়ত এই হাদীসে কোনো কোনো স্থানের কথা বলা হয়েছে। গোটা আওয়ালীয়ে মদীনার কথা বলা হয়নি এবং তা বলা যুক্তিযুক্তও নয়। কারণ, আওয়ালী কোনো সুনির্দিষ্ট একটি পাহাড় কিংবা একটি খাম্বা, পুকুর বা এই জাতীয় কোনো বস্তুর নাম নয়। সম্ভবত লেখক আওয়ালী বলতে এই জাতীয় কিছু বুঝেছেন। মুহতারাম, আপনি জানেন যে, আওয়ালী হচেছ মদীনা হতে পূর্ব-উত্তরে নাজদের দিকে একটি বিসত্মীর্ণ জনবসতির নাম। তো সেই জনবসতির কোনো কোনো স্থান ছিল মদীনা হতে দুই মাইল দূরে, কোনো কোনো স্থান তিন মাইল দূরে, কোনো কোনো স্থান চার মাইল দূরে। সুতরাং হযরত ওমর রা.-এর পত্র সম্বলিত হাদীসটি কোনোভাবেই হযরত আনাস রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের বিরোধী নয় এবং কোনো সালাতের ওয়াক্তের ক্ষেত্রেই তা ঐ হাদীসের বিরোধী নয়।

            লেখক হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন। ‘সুবিধাবাদী নীতির অনুসরণ’ শিরোনামে একটু পূর্বে আমি আব্দুল আযীয ইব্ন রুফাই‘ সম্পর্কে শায়েখ আলবানীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছি। বক্তব্যটি আবার পাঠ করুন। ঐ বক্তব্যের আলোকেই নাফে‘ সম্পর্কে আমার বক্তব্য হল, নাফে‘ রাহ. বড় বড় তাবিঈগণের একজন। হাদীস শাস্ত্র সম্পর্কে যাঁর একটু জানা শোনা আছে তিনিও জানেন যে, নাফে‘ ছিলেন হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন ওমর রা.-এর বিশিষ্ট শাগ্রিদ। সফরে হযরে সর্বদা তিনি হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন ওমর রা.-এর সঙ্গে থাকতেন। এখানে যথেষ্ট সম্ভাবনা এই যে, পত্রটির বক্তব্য তিনি হযরত ওমর রা.-এর পুত্র হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন ওমর রা.-এর নিকট থেকেই শুনেছেন। অথবা  অন্য কোনো সাহাবী হতে শুনেছেন। কমক্ষে এমন কোনো তাবিঈ হতে শুনেছেন যিনি হযরত ওমর রা.-এর পত্র সম্পর্কে ছিলেন সরাসরি ওয়াকিফহাল। যদি তিনি আব্দুল্লাহ ইব্ন ওমর রা. বা অন্য কোনো সাহাবী হতে শুনে থাকেন তাহলে তো কথাই নেই। কারণ, আলবানী সাহেবের বক্তব্য অনুযায়ী তখন সনদ সহীহ। আর যদি তাবিঈ হতে শুনে থাকেন তাহলেও তা সমর্থক হাদীস হিসাবে গ্রহণযোগ্য হতে সমস্যা নেই যেমনটা আলবানী সাহেব নিজেই আব্দুল আযীয বর্ণিত মুরসাল হাদীস সম্পর্কে বলেছেন। অতএব হাদীসটিকে শর্তনিরপেক্ষভাবে বা ঢালাওভাবে যঈফ বলে দেওয়া লেখকের জন্য কতটুকু সমীচীন হয়েছে তা আপনিই ভেবে দেখুন।

            এরপর লেখক যিয়াদ ইব্ন আব্দুল্লাহ নাখাঈ কর্তৃক বর্ণিত একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন এবং যঈফ বলে মন্তব্য করেছেন। লেখকের ভাষায় : সনদ যঈফ। হাকেম একে ছহীহ বলে উল্লেখ করলেও তা যঈফ। ইমাম দারা কুতনী এর ত্রুটি বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, যিয়াদ বিন আব্দুল্লাহ নাখঈ অপরিচিত। আববাস বিন যুরাইহ ছাড়া অন্য কেউ তার থেকে হাদীস বর্ণনা করেনি।

তাহকীক ও পর্যালোচনা

শব্দটি নাখঈ নয়, নাখাঈ (‘খ’ বর্ণে আকারসহ)। আববাস বিন যুরাইহ নয়, আববাস বিন যারীহ। যিয়াদ বিন আব্দুল্লাহ নাখাঈ একজন তাবিঈ। তাঁর হাদীসটিকে হাকেম সহীহ বলেছেন এবং এক্ষেত্রে আল্লামা যাহাবী হাকেমের সঙ্গে সহমত পোষণ করেছেন।[1] ইমাম বুখারী রাহ. তাঁর আত-তারীখুল কাবীর গ্রন্থে[2] এবং ইব্ন আবূ হাতেম তাঁর আল-জারহু ওয়াত তা‘দীল গ্রন্থে[3] যিয়াদ বিন আব্দুল্লাহ নাখাঈর প্রসঙ্গ উল্লেখ করেছেন কিন্তু তাঁদের কেউই তাঁর সম্পর্কে ভাল মন্দ কিছুই বলেননি। তাছাড়া ইব্ন হিববান তাঁকে তাঁর কিতাবুছ ছিকাতে উল্লেখ করেছেন।[4] বাকী রইল ইমাম দারাকুতনী কর্তৃক যিয়াদ বিন আব্দুল্লাহ নাখাঈকে মাজহুল বলে উল্লেখকরণের বিষয়টি। তো ইমাম দারাকুতনী রাহ. তাঁর সূনানে তাঁকে মাজহুল বলে উল্লেখ করলেও অন্যত্র তিনি বলেছেন :

 وزياد بن عبد الله النخعي هو نخعي يعتبر به لم يحدث به فيما اعلم غير العباس بن ذريح

(টিকা

انتهى، و قوله : "لم يحدث به"، صوابه: "لم يحدث عنه"، كما يعلم من كلامه في السنن.)

            অর্থাৎ ‘যিয়াদ বিন আব্দুল্লাহ নাখাঈর হাদীস সমর্থক হিসাবে গ্রহণযোগ্য। আমার জানামতে আববাস বিন যারীহ ব্যতীত আর কেউ তাঁর বরাতে হাদীস বর্ণনা করেননি।’[5]

            এখানে ইমাম দারাকুতনী রাহ. একদিকে বলছেন যে, আববাস বিন যারীহ ব্যতীত আর কেউ যিয়াদ বিন আব্দুল্লাহর বরাতে হাদীস বর্ণনা করেননি, অপরদিকে বলছেন যে,يعتبر به  (তাঁর হাদীস সমর্থক হিসাবে গ্রহণযোগ্য)। বুঝা যাচ্ছে যে, ইমাম দারাকুতনী রাহ. যিয়াদ বিন আব্দুল্লাহকে মাজহুল হওয়ার কারণে অগ্রহণযোগ্য বলতে দ্বিধা করছেন। মাজহুল হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে বা তাঁর হাদীসকেيعتبر به  বলছেন। এর কারণ সম্ভবত এই যে, মুতাকাদ্দিমীন বিশেষজ্ঞগণ মাজহুল রাবীকে ঢালাওভাবে অগ্রহণযোগ্য মনে করতেন না। তাঁরা তখনই তাঁকে অগ্রহণযোগ্য মনে করতেন যখন তাঁর থেকে বর্ণনাকারী হত যঈফ। তাঁর থেকে যিনি বর্ণনা করছেন তিনি যদি ছিকাহ হতেন তাহলে তাঁরা তাঁকে ই‘তিবারের পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য মনে করতেন। এ সম্পর্কে শুধু আবূ হাতেম আর-রাযীর একটি উক্তি উদ্ধৃত করাকেই যথেষ্ট মনে করছি। ইব্ন আবূ হাতেম বলেন,

سألت أبي عن رواية الثقات عن رجل غير ثقة مما يقويه؟ قال: إذا كان معروفا بالضعف لم تقوه روايته عنه، وإذا كان مجهولا نفعه رواية الثقة عنه (الجرح والتعديل، الجزء الأول، الصفحة ٣٢٣)

‘আমি আমার পিতাকে ছিকাহ ব্যক্তির রেওয়ায়েত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলাম যে, গায়রে ছিকাহ (ছিকাহ নয় এমন) ব্যক্তি হতে তাঁর বর্ণনা গায়রে ছিকাহকে শক্তিশালী করে কি? তিনি বললেন, গায়রে ছিকাহ ব্যক্তি যদি সুবিদিত যঈফ হয় তবে তার থেকে ছিকাহ ব্যক্তির বর্ণনা তাকে শক্তিশালী করে না। আর যদি সে মাজহুল হয় তবে তার থেকে ছিকাহ ব্যক্তির বর্ণনা তার উপকার করে।’

            সম্ভবত ইমাম দারাকুতনী এই বিষয়টি মাথায় রেখেই যিয়াদ ইব্ন আব্দুল্লাহ মাজহুল হওয়া সত্ত্বেও তাঁর বর্ণনাকে ই‘তিবারের পর্যায়ে গ্রহণযোগ্য বলছেন। কারণ, তাঁর থেকে বর্ণনাকারী আববাস ইব্ন যারীহ ছিকাহ রাবী। তাছাড়া আল্লামা ইব্ন হিববান তাঁর কিতাবুছ ছিকাতে যিয়াদ বিন আব্দুল্লাহকে অন্তর্ভুক্ত করে প্রকারান্তরে তাঁকে ছিকাহ হিসাবে মত প্রদান করেছেন। এদিকে ইমাম বুখারী রাহ. এবং ইব্ন আবূ হাতেম যথাক্রমে আত-তারীখুল কাবীরে এবং আল-জারহু ওয়াত তা‘দীল গ্রন্থে যিয়াদ বিন আব্দুল্লাহ সম্পর্কে ভাল মন্দ কিছুই বলেননি। তাঁর সম্পর্কে তাঁদের এই নীরবতা ইব্ন হিববান কর্তৃক তাঁকে ছিকাহ হিসাবে মত প্রদানের বিষয়টিকে আরও শক্তিশালী করে। অতএব এক ইমাম দারাকুতনীর মন্তব্যকে, তাও আবার অর্ধেক মন্তব্যকে উল্লেখ করে হাদীসটিকে যঈফ বলে দেওয়া লেখকের একপ্রকার খিয়ানত বলা চলে।

            লেখক এরপর হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসঊদ রা.-এর একটি আছর উল্লেখ করেছেন।

عن ابن مسعود أنه كان يؤخر العصر

            ইবনু মাসঊদ রা. থেকে বর্ণিত, তিনি আছরের ছালাত দেরী করে আদায় করতেন। (লেখকের অনুবাদ)

            লেখক এরপর ‘তাহক্বীক্ব ’ শিরোনামে লিখেছেন: বর্ণনাটি যঈফ। এর সনদে আবু ইসহাক নামে ত্রুটিপূর্ণ রাবী আছে। সে আব্দুর রহমান ইব্ন ইয়াযীদ থেকে সঠিকভাবে হাদীছ বর্ণনা করেনি।

 

পর্যালোচনা

লেখক তাঁর উপরিউক্ত মন্তব্যের বরাত দিয়েছেন ‘তুহফাতুল আহওয়াযী’ ও তানকীহুল কালামের। মুহতারাম, তুহফাতুল আহওয়াযীর বরাতটি অসত্য। কিতাবটিতে আবূ ইসহাক সম্পর্কে এই জাতীয় কোনো আলোচনাই করা হয়নি। আর তানকীহুল কালাম কিতাবটির লেখক যাকারিয়া ইব্ন গোলাম কাদের পাকিস্তানী। তিনি একজন গোঁড়াপন্থী লা-মাযহাবী। কিন্তু তিনিও আবূ ইসহাক সম্পর্কে ঐরূপ কথা লেখেননি। তিনি যা লিখেছেন তা এই: 

وهذا اسناد رجاله ثقات، إلا أن أبا إسحاق لم يصرح بالتحديث من عبد الرحمن بن يزيد

            অর্থাৎ এই সনদটি এরূপ একটি সনদ যার সকল বর্ণনাকারী নির্ভরযোগ্য। তবে আব্দুর রহমান ইব্ন ইয়াযীদ থেকে বর্ণনা করতে গিয়ে আবূ ইসহাক তাহদীছের তাসরীহ করেননি। (অর্থাৎ তিনি স্পষ্টভাবে বলেননি যে, আব্দুর রহমান ইবন ইয়াযীদ তাঁর নিকট সরাসরি হাদীস বর্ণনা করেছেন।)

            তানকীহুল কালামের লেখক  বোঝাতে চেয়েছেন যে, আবূ ইসহাক নির্ভরযোগ্য রাবী। তবে তিনি কখনও কখনও তাদলীস করে থাকেন। আর মুদাল্লিস রাবীর রেওয়ায়েত গ্রহনযোগ্য হওয়ার জন্য শর্ত হল যার বরাতে তিনি হাদীস বর্ণনা করছেন তার নিকট হতে তিনি হাদীস সরাসরি শ্রবণ করেছেন বলে স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করা। আর আবূ ইসহাক তা করেননি। (মুদাল্লিস সম্পর্কে আমি ফজরের আলোচনার শেষের দিকে বিস্তারিত আলোচনা করেছি।)

            এবার আপনি নিজেই বিচার করুন লেখক কতটুকু সত্যাশ্রয়ী, কতটুকু মিথ্যাশ্রয়ী? লেখকের মন্তব্য হল, আবূ ইসহাক ত্রুটিপূর্ণ রাবী। সুবহানাল্লাহ! তিনি তো বুখারী ও মুসলিমসহ কুতুবে সিত্তার (সিহাহ সিত্তার) রাবী। সকলেই তাঁকে নির্ভরযোগ্য বলে জ্ঞান করেছেন এবং তাঁর বর্ণিত হাদীস তাঁরা স্ব স্ব গ্রন্থে সন্নিবেশিত করেছেন। হাফেজ ইবন হাজার আসকালানী রাহ. তাঁর ফাতহুল বারীর মুকাদ্দিমায় তাঁকে আখ্যায়িত করেছেন أحد الأعلام الأثبات  বলে। যাঁদেরকে বলা হয় মাদারে সনদ  (مدار السند) বা সনদের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব, বহু শাখা সনদের মিলনস্থল যাঁরা, এই আবূ ইসহাক তাঁদের অন্যতম। যেমন ইমাম ইব্ন শিহাব যুহরীও একজন মাদারে সনদ।  তো এইরূপ ব্যক্তিত্ব যদি লেখকের দৃষ্টিতে ‘ত্রুটিপূর্ণ রাবী’ হন তাহলে বুখারী ও মুসলিমসহ হাদীসের গ্রন্থসমূহে তাঁর কর্তৃক বর্ণিত হাজারো সহীহ হাদীস যঈফ হিসাবে পরিগণিত হবে। এরই নাম কি হাদীসের তাহকীক?! আমার আপত্তিটি দেখার পরে হয়ত মুযাফ্ফর বিন মুহসিন সাহেবের বোধোদয় ঘটবে এবং তিনি এই জবাব দিতে চেষ্টা করবেন যে, আমি ‘ত্রুটিপূর্ণ’ বলে তিনি যে মুদাল্লিস সেটাই বুঝাতে চেয়েছি। কিন্তু তিনি কি বুকে হাত দিয়ে বলবেন যে, তাঁর ভাষা দ্বারা কি পাঠক তা-ই বুঝবে, না পাঠকের অন্তরে এই আবূ ইসহাক সম্পর্কে অন্য কোনো মন্দ ধারণার সৃষ্টি হবে?  লেখকের পরবর্তী বাক্য হল, সে (আবূ ইসহাক) আব্দুর রহমান ইব্ন ইয়াযীদ থেকে সঠিকভাবে হাদীছ বর্ণনা করেনি। আবূ ইসহাক সম্পর্কে তিনি সর্বনাম ব্যবহার করেছেন ‘সে’। সর্বনামটি আবূ ইসহাকের প্রতি তাঁর তাচ্ছিল্যই প্রকাশ পায়। এর কী জবাব দেবেন তিনি? তাছাড়া ‘সে আব্দুর রহমান ইব্ন ইয়াযীদ থেকে সঠিকভাবে হাদীছ বর্ণনা করেনি।’ লেখকের  এই বাক্যটি আবূ ইসহাক সম্পর্কে বহু মন্দ ধারণা ব্যক্ত করে। যেমন: আব্দুর রহমান যে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন আবূ ইসহাক সেই হাদীসটিকে বিকৃত করে বর্ণনা করেছেন বা তিনি হাদীসটি যথাযথভাবে মুখস্থ রাখতে পারেননি, ফলে ভুল বর্ণনা করেছেন ইত্যাদি। ত্রুটিপূর্ণ রাবী বলে তিনি মুদালিস্নস বুঝাতে চেয়েছেন তাঁর শেষোক্ত এই বাক্যটি তা সমর্থন করে না। একে তো তাঁকে ত্রুটিপূর্ণ রাবী আখ্যায়িত করণ সেই সঙ্গে তাঁর এই বাক্য।  তাহলে লেখক কী করে নিজের অজ্ঞতা বা জ্ঞানপাপীতার দায় থেকে নিজেকে মুক্ত করবেন?

            এখন আবূ ইসহাকের তাদলীস বিষয়ে এবং তাঁর কর্তৃক বর্ণিত এই হাদীস নিয়ে  আলোচনায় আসা যাক। এ সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা একটু বিরক্তির কারণ হতে পারে বিধায় সংক্ষেপে শুধু এতটুকু বলব, আবূ ইসহাক সাবীয়ী-এর তাদলীস কিন্তু এপর্যায়ের নয় যে, তাঁর মু‘আন‘আন হাদীসকে সন্দেহযুক্ত বলা যায়। সে কারণে সহীহ বুখারী, সহীহ মুসলিমসহ সহীহ হাদীসের গ্রন্থগুলোতে তাঁর অনেক মু‘আন‘আন হাদীস রয়েছে। শেষ বয়সে তাঁর স্মৃতিতে বড় সমস্যা দেখা দিয়েছিল- কেউ এমন কথা বলে থাকলেও সিয়ারু আ‘লামিন নুবালাগ্রন্থে ইমাম শামসুদ্দিন যাহাবী শক্তভাবে তা খণ্ডন করেছেন। বিশেষভাবে আবূ ইসহাক থেকে যখন শু‘বা অথবা সুফিয়ান ছাওরী রেওয়ায়েত করেন তো তার ভিন্ন গুরুত্ব রয়েছে।

            বর্তমানকালের লা-মাযহাবীদের চিন্তাগুরু শায়েখ আলবানী রাহ.-এর কিতাবটিও মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব ভাল করে পাঠ করেননি। শায়েখ আলবানী রাহ.-ও কিন্তু শেষ পর্যন্ত আবূ ইসহাক হতে সুফইয়ান ও শু‘বার বর্ণনাকে ব্যতিক্রম বলে উল্লেখ করছেন। বলছেন যে, তাঁর নিকট হতে এঁদের দুজনের বর্ণনা হুজ্জত বা মূল দলীল হিসাবে গৃহীত হওয়ার উপযুক্ত। (সিলসিলাতুল আহাদীসিস সহীহাহ, ১৫০৯ নং হাদীসের অধীনে)

            এবার দেখুন, লেখক হাদীসটির বরাত দিয়েছেন মুসান্নাফে আব্দুর রায্যাক ও তাবারানী কাবীরের। এই উভয় কিতাবে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে সুফইয়ানের বরাতে। অতএব হাদীসটি হুজ্জত বা দলীল হিসেবে গৃহীত হতে কোনো বাধা নেই।

আছরের ছালাতের সঠিক সময়

‘আছরের ছালাতের সঠিক সময়’[6] শিরোনামে লেখক লিখেছেন, কোন বস্তুর ছায়া যখন মূল ছায়ার সমপরিমাণ হবে তখন আছরের ছালাতের সময় শুরু হবে। আর দ্বিগুণ হলে শেষ হবে। তবে কোন সমস্যাজনিত কারণে সুর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত পড়া যাবে।

 

পর্যালোচনা

‘কোন বস্তুর ছায়া যখন মূল ছায়ার সমপরিমাণ হবে’ বাক্যটির অর্থ কী, তা লেখকই ভাল জানেন। তিনি যা  বোঝাতে চাচ্ছেন তা বোঝাতে বাক্যটি হবে এরূপ: ‘কোনো বস্তুর ছায়া যখন ঐ বস্তুর সমপরিমাণ হবে তখন আসরের সালাতের সময় শুরু হবে।’  লেখক লিখেছেন, আর দ্বিগুণ হলে শেষ হবে। এরপর তিনি ছয়টি  হাদীস উল্লেখ করেছেন (ক) থেকে শুরু করে (চ) পর্যন্ত চিহ্ন যুক্ত করে। কিন্তু এর মধ্য হতে কোন্ হাদীস দ্বারা ‘দ্বিগুন হলে শেষ হবে’ কথাটি প্রমাণিত হয় লেখক তা স্পষ্ট করেননি। ছয়টি হাদীসের মধ্য হতে একটি হাদীস ব্যতীত কোনোটিতেই দ্বিগুণের কোনো কথাই নেই। হাঁ, চতুর্থ হাদীসটিতে দ্বিগুণের কথা আছে। যেটিতে জিব্রাঈল আ.-এর ইমামতির কথা ব্যক্ত হয়েছে। লেখক ঐ হাদীসের তরজমা শেষে লিখেছেন: জ্ঞাতব্য: উক্ত ছালাত আদায়ের মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা রাসূল (ছাঃ) কে ছালাতের আউয়াল ও আখের দুইটি ওয়াক্ত সম্পর্কে অবহিত করেছেন। এর দ্বারা প্রমাণিত হল যে, বস্তুর ছায়া তার দ্বিগুণ হলে আছরের ছালাতের শেষ ওয়াক্ত চলে আসবে। অথচ অধিকাংশ মুছল্লী এই শেষ ওয়াক্তে আদায় করে থাকে, যা রাসূল (ছাঃ)-এর ভাষায় গর্হিত অন্যায়।

মুহতারাম,

            জিব্রাইল আলাইহিস সালামকে দিয়ে  ইমামতি করানোর মাধ্যমে আল্লাহ তা‘আলা সালাতের আউয়াল ও আখের ওয়াক্ত সম্পর্কে অবহিত করেছেন- মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের এই দাবী আমি সমর্থন করি না।  কারণ, মাগরিবের সালাত জিব্রাইল আ. প্রথম ও দ্বিতীয় উভয় দিনই সূর্যাস্তের পর পরই আদায় করেছেন। তাহলে মাগরিবের সালাতের আখের বা শেষ ওয়াক্ত কি তা-ই যা তার আউয়াল বা শুরু ওয়াক্ত? সূর্যাস্তের পর সালাত আদায় করতে যতটুকু সময়ের প্রয়োজন হয় সেই সময়ের পরই কি মাগরিবের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায়? মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের জবাব এখানে নেতিবাচকই হবে। তিনি বলতে বাধ্য হবেন যে, না শেষ হয় না; আকাশের লালিমা ডুবে যাওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মাগরিবের ওয়াক্ত থাকে। তিনি তাঁর বইয়ের ১৩৮ নং পৃষ্ঠায় ‘মাগরিবের ছালাতের সঠিক সময়’ শিরোনামে লিখেছেন, ‘সূর্য ডুবার পরেই মাগরিবের ছালাতের সময় শুরু হয়। আর সূর্যের লালিমা থাকা পর্যন্ত এর সময় অবশিষ্ট থাকে।’ বোঝা গেল যে, এই হাদীসে মাগরিবের শেষ ওয়াক্ত সম্পর্কে অবহিত করা হয়নি, মাগরিবের শেষ ওয়াক্ত সম্পর্কে জানতে অন্য হাদীসের শরণাপন্ন হতে হবে। তদ্রূপ দ্বিতীয় দিন এশার সালাত জিব্রাইল আ. রাতের এক তৃতীয়াংশ পূর্ণ হওয়া পর্যন্ত বিলম্বিত করে আদায় করেছেন। তাহলে কি এশার সালাতের সময় রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত? মুযাফফর সাহেবের দাবী তো এশার সালাতের ওয়াক্ত থাকে মধ্যরাত পর্যন্ত। এশার সালাতের আলোচনায় তিনি মধ্যরাত পর্যন্ত এশার ওয়াক্ত অবশিষ্ট থাকা সংক্রান্ত হাদীসও উদ্ধৃত করেছেন। বোঝা গেল যে, এই হাদীসে এশার সালাতের শেষ ওয়াক্ত সম্পর্কে অবহিত করা হয়নি, এশার সালাতের শেষ ওয়াক্ত সম্পর্কে জানতে আমাদেরকে অন্য হাদীসের শরণাপন্ন হতে হবে। কাজেই এই হাদীসে সব সালাতের আউয়াল ও আখের ওয়াক্ত সম্পর্কে অবহিত করা হয়েছে বলে লেখক যে দাবী করেছেন তা ধোপে টেকে না। অতএব, আমরা বলতে পারি যে, আসরের সালাতের শেষ ওয়াক্ত সম্পর্কেও এই হাদীসে অবহিত করা হয়নি। আসরের সালাতের শেষ ওয়াক্ত সম্পর্কে জানতেও আমাদেরকে অন্য হাদীসের শরণাপন্ন হতে হবে। বাকী রইল এই প্রশ্ন যে, তাহলে জিব্রাইল আ. মাগরিব ব্যতীত অন্যান্য সালাতকে দুই দিন দুই সময়ে আদায় করে কী বোঝাতে চেয়েছেন এবং কেনই বা মাগরিবের সালাতকে উভয় দিনই একই সময়ে আদায় করলেন। এটি একটি প্রশ্ন বটে। এর উত্তর কী তা নিয়ে পরে আলোচনা করব। আগে আসরের ব্যাপারটা সুরাহা করে নেই।

            হাদীসের ভা-ার তালাশ করে আমরা কিছু হাদীস পেলাম যা প্রমাণ করে যে, কোনো বস্ত্তর ছায়া দ্বিগুণ হলে আসরের সালাতের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায় না। একটি হাদীস এই :

 

  حَدَّثَنَا هَنَّادٌ حَدَّثَنَا مُحَمَّدٌ بْنُ فُضَيْل عَنِ الْأَعْمَشِ عَنْ أَبِيْ صَالِحٍ عِنْ أِبِيْ هُرَيْرَةَ قَالَ : قَالَ رَسُوْلُ الله صلى الله عليه و سلم إِنَّ لِلصَّلَاةِ أَوَّلًا وَآخِرًا وَإِنَّ أَوَّلَ وَقْتِ صَلَاةِ الظُّهْرِ حِيْنَ تَزُوْلُ الشَّمْسُ وَآخِرَ وَقْتِهَا حِيْنَ يَدْخُلُ وَقْتُ الْعَصْرِ وَإِنَّ أَوَّلَ صَلَاةِ الْعَصْرِ حِيْنَ يَدْخُلُ وَقْتُهَا وَإِنَّ آخِرَ وَقْتِهَا حِيْنَ تَصْفَرُّ الشَّمْسُ وَإِنَّ أَوَّلَ وَقْتِ الْمَغْرِبِ حِيْنَ تَغْرُبُ الشَّمْسُ وَإِنَّ آخِرَ وَقْتِهَا حِيْن يَغِيْبُ الْأُفُقُ وَإِنَّ أَوَّل وَقْتِ الْعِشَاءِ الْآخِرَةِ حِيْنَ يَغِيْبُ الْأُفُقُ وَإِنَّ آخِرَ وَقْتِهَا حِيْنَ يَنْتَصِفُ اللَّيْلُ وَإِنَّ أَوَّلَ وَقْتِ الْفَجْرِ حِيْنَ يَطْلُعُ الْفَجْرُ وَإِنَّ آخِرَ وَقْتِهَا حِيْنَ تَطْلُعُ الشَّمْسُ

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, নিশ্চয়, সালাতের রয়েছে প্রথম ও শেষ ওয়াক্ত। এবং নিশ্চয়, যোহরের আউয়াল ওয়াক্ত হল ‘যখন সূর্য ঢলে যায় এবং তার আখের ওয়াক্ত হল’ যখন আসরের ওয়াক্ত চলে আসে। আর আসরের আউয়াল ওয়াক্ত হল, যখন তার ওয়াক্ত আসে আর তার আখের ওয়াক্ত হল, যখন সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করে। এবং মাগরিবের আউয়াল ওয়াক্ত হল, যখন সূর্য ডুবে যায় এবং তার আখের ওয়াক্ত হল যখন আকাশের প্রান্ত অদৃশ্য হয়ে যায়। এবং এশার আউয়াল ওয়াক্ত যখন আকাশের প্রান্ত অদৃশ্য হয়ে যায় এবং তার আখের ওয়াক্ত হল যখন মধ্যরাত হয়। আর ফজরের আউয়াল ওয়াক্ত যখন ফজর উদিত হয় আর তার আখের ওয়াক্ত যখন সূর্য উদিত হয়।[7]

            হাদীসটিতে বলা হয়েছে যে, আসরের আখের ওয়াক্ত হল যখন সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করে। আর সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করে কোনো বস্তুর ছায়া তার দ্বিগুণ হওয়ার অনেক পরে। হাদীসটিকে শায়খ আলবানী রাহ. সহীহ বলেছেন। শুআইব আলআরনাউত বলেছেন,

  إسناده صحيح رجاله ثقات رجال الشيخين  

(হাদীসটির সনদ সহীহ, এর রাবীগণ নির্ভরযোগ্য, বুখারী ও মুসলিমের রাবী।)

তাহকীক : কিন্তু হাদীসটিকে আ‘মাশের শাগরেদগণের মধ্য হতে একমাত্র মুহাম্মাদ ইব্ন ফুযাইল ব্যতীত আর কেউ মারফু‘ ও মুত্তাসিলরূপে বর্ণনা করেন না। এই কারণে ইমাম বুখারী রাহ. ও ইমাম দারাকুতনী হাদীসটিকে মা‘লূল সাব্যস্ত করেছেন। ইমাম দারাকুতনী রাহ. বলেন:

   هَذَا لاَ يَصِحُّ مُسْنَدًا وَهِمَ فِي إِسْنَادِهِ ابْنُ فُضَيْلٍ وَغَيْرُهُ يَرْوِيهِ عَنِ الأَعْمَشِ عَنْ مُجَاهِدٍ مُرْسَلاً

            অর্থাৎ হাদীসটি মুসনাদরূপে সঠিক নয়। এটাকে মুসনাদরূপে বর্ণনা করণে মুহাম্মাদ ইব্ন ফুযাইলের ভ্রান্তি হয়েছে। ইবন ফুযাইল ব্যতীত অন্যান্যরা এটিকে আ‘মাশের বরাতে মুজাহিদ হতে মুরসালরূপে বর্ণনা করেছেন। 

ইমাম বুখারী রাহ. বলেন:

حديث الأعمش عن مجاهد في المواقيت أصح من حديث محمد بن فضيل عن الأعمش، وحديث محمد بن فضيل خطأ أخطأ فيه محمد بن فضيل حدثنا هناد حدثنا أبو أسامة عن [أبي إسحاق] الفزاري عن الأعمش عن مجاهد قال : كان يقال إن للصلاة أولا وآخرا، فذكر نحو حديث محمد بن فضيل عن الأعمش نحوه بمعناه.

            অর্থাৎ ওয়াক্ত সম্পর্কে মুজাহিদের বরাতে আ‘মাশের বর্ণনা আ‘মাশের বরাতে মুহাম্মাদ ইবন ফুযাইলের বর্ণনা অপেক্ষা অধিকতর সহীহ। মুহাম্মাদ ইবন ফুযাইলের হাদীসটি ভুল। মুহাম্মাদ ইবন ফুযাইল এতে ভুল করেছেন। আমাদের নিকট হান্নাদ বর্ণনা করে বলেন, আমাদের নিকট আবূ ইসহাক আল ফাযারী হতে আবূ উসামাহ বর্ণনা করেছেন আ‘মাশের বরাতে, আর আ‘মাশ মুজাহিদকে উদ্ধৃত করে যে, মুজাহিদ বলেন, বলা হত, ‘সালাতের আছে আউয়াল ও আখের ওয়াক্ত। অতপর (অবশিষ্ট অংশটুকু) তিনি বর্ণনা করেন মুহাম্মাদ ইব্ন ফুযাইল যেরূপ আ‘মাশের বরাতে বর্ণনা করেছেন তদনুরূপ।

মুসনাদে বায্যারে বলা হয়েছে:

وهذا الحديثُ لاَ نَعْلَمُ رَوَاهُ , عَنِ الأَعْمَشِ عَنْ أَبِي صَالِحٍ  عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ  إلا مُحَمَّد بن فضيل ولم يتابع عليه، وإنما يرويه زائدة بن قدامة عن الأعمش عن مجاهد موقوفا من قوله

            অর্থাৎ হাদীসটিকে মুহাম্মাদ ইব্ন ফুযাইল ব্যতীত আর কেউ ‘আ‘মাশ আবূ সালেহ হতে আর আবূ সালেহ আবূ হুরায়রা হতে’ - এই সনদে বর্ণনা করেছেন বলে আমাদের জানা নাই। এক্ষেত্রে মুহাম্মাদ ইব্ন ফুযাইলের কোনো অনুগামীও নাই। হাদীসটিকে যায়েদাহ ইব্ন কুদামাহ আ‘মাশের বরাতে মুজাহিদের উক্তিরূপে বর্ণনা করেছেন।

            উপরিউক্ত তিনজন ইমামের মন্তব্যের সারকথা হল, হাদীসটিকে মারফু‘ হাদীস রূপে বর্ণনা করণের ক্ষেত্রে মুহাম্মাদ ইবন ফুযাইল নিঃসঙ্গ। যায়েদাহ ইব্ন কুদামাহ, আবূ ইসহাক আল ফাযারীসহ আ‘মাশের অন্যান্য বর্ণনাকারী শাগরেদগণ আ‘মাশের বরাতে হাদীসটিকে মুজাহিদের বক্তব্যরূপে বর্ণনা করেছেন এবং এটিই সঠিক। হাদীসটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি নয়।

এসত্ত্বেও আমি এই হাদীসটিকে এখানে কেন উল্লেখ করলাম এবং এই আলোচনা পর্যালোচনাই বা কেন করলাম এই প্রশ্ন আপনি আমাকে করতে পারেন। এর উত্তর হল, আমার উদ্দেশ্য হল তিনটি। এক: এটা দেখানো যে, কোনো হাদীসের সকল রাবী ছিকাহ বা নির্ভরযোগ্য হলেই হাদীসকে মুহাদ্দিসগণ সহীহ বলেন না। হাদীস সহীহ হওয়ার জন্য শায বা দল-বিচ্ছিন্ন বর্ণনা না হওয়াও জরুরী। কারণ ছিকাহ বা নির্ভরযোগ্য রাবীও ভুল করতে পারেন। তবে এটাও স্মরণে রাখা প্রয়োজন যে, নির্ভরযোগ্য রাবীর ভুল প্রমাণ করতেও শক্তিশালী দলীল ও লক্ষণের প্রয়োজন। যেমন শায বা দল-বিচ্ছিন্ন বর্ণনা হওয়া রাবীর ভুলের একটি শক্তিশালী লক্ষণ। দুই: সঙ্গে এই দৃষ্টিভঙ্গীটাও প্রকাশ করা উদ্দেশ্য ছিল যে, হাদীসের শুদ্ধতা, অশুদ্ধতা নির্ণয়ে এই শাস্ত্রে যাঁরা বিশেষজ্ঞ সেই সকল পূর্ববর্তী ইমামগণের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া উচিত। যদি না তাদের মতামতের বিপক্ষে কোনো শক্তিশালী প্রমাণ ও যুক্তি থাকে। অতএব শায়খ আলবানী ও শুআইব আলআরনাঊত হাদীসটিকে সহীহ বললেও আমি উপরিউক্ত তিনজন ইমামের বক্তব্যকে প্রাধান্য দান করে হাদীটিকে যঈফ বলতে চাই। যদিও সহীহ বললে আমার দাবীর পক্ষে সেটাকে দলীল হিসাবে ব্যবহার করা যেত। তিন: সহীহরূপে প্রমাণিত মুজাহিদের উক্তিটিকে আমি আমার দাবীর পক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করতে হাদীসটিকে উল্লেখ করেছি।

            কারণ, উপরের আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়েছে যে, উপরিউক্ত হাদীসটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উক্তি নয়। তবে এটি যে মুজাহিদের উক্তি তা সহীহভাবে প্রমাণিত। সকলেই তা স্বীকার করছেন। মুজাহিদ বলেন, ‘বলা হত যে, সালাতের রয়েছে আউয়াল ও আখের ওয়াক্ত।’ এরপর প্রতিটি সালাতের আউয়াল ও আখের ওয়াক্তের বিবরণ বর্ণিত হয়েছে। আমার বক্তব্য হল, মুজাহিদ একজন বিখ্যাত তাবিঈ। তো নিশ্চয়ই সালাতের ঐ বিবরণ সম্বলিত বক্তব্যটি সাহাবায়ে কেরামের। তাঁদের মাঝে এই কথার চর্চা ছিল যে, আসরের আখের ওয়াক্ত হল, সূর্য যখন হলুদ বর্ণ ধারণ করে। কিন্তু সালাতের আউয়াল ও আখের ওয়াক্তের বিষয়টি মুদরাক বিল কিয়াস বা যুক্তি ও বুদ্ধি দ্বারা অবগত হওয়ার মত কোনো বিষয় নয়। সুতরাং বলতেই হবে যে, সাহাবায়ে কেরাম বিষয়টি নিশ্চয়ই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম থেকে শুনেছিলেন। অতএব বক্তব্যটিকে মারফূয়ে হুকমী বা পরোক্ষ মারফূ বলতেই হবে। অতএব হাদীসটিকে আমাদের দাবীর সপক্ষে দলীল হিসাবে উপস্থাপন করা অযৌক্তিক কিছু হবে না। তা ছাড়া সহীহ মুসলিমসহ বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত আব্দুল্লাহ ইব্ন আম্র রা. কর্তৃক বর্ণিত একটি সহীহ মারফূ হাদীস মুজাহিদ কর্তৃক বর্ণিত উক্ত মুরসাল হাদীসকে সমর্থন করে এবং আমাদের দাবীকে স্পষ্টভাবে প্রমাণ করে। মুসলিম শরীফে হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে এইভাবে :

وَحَدَّثَنِى أَحْمَدُ بْنُ إِبْرَاهِيمَ الدَّوْرَقِىُّ حَدَّثَنَا عَبْدُ الصَّمَدِ حَدَّثَنَا هَمَّامٌ حَدَّثَنَا قَتَادَةُ عَنْ أَبِي أَيُّوبَ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ : وَقْتُ الظُّهْرِ إِذَا زَالَتِ الشَّمْسُ وَكَانَ ظِلُّ الرَّجُلِ كَطُولِهِ مَا لَمْ يَحْضُرِ الْعَصْرُ، وَوَقْتُ الْعَصْرِ مَا لَمْ تَصْفَرَّ الشَّمْسُ، وَوَقْتُ صَلاَةِ الْمَغْرِبِ مَا لَمْ يَغِبِ الشَّفَقُ، وَوَقْتُ صَلاَةِ الْعِشَاءِ إِلَى نِصْفِ اللَّيْلِ الأَوْسَطِ، وَوَقْتُ صَلاَةِ الصُّبْحِ مِنْ طُلُوعِ الْفَجْرِ مَا لَمْ تَطْلُعِ الشَّمْسُ، فَإِذَا طَلَعَتِ الشَّمْسُ فَأَمْسِكْ عَنِ الصَّلاَةِ، فَإِنَّهَا تَطْلُعُ بَيْنَ قَرْنَيْ شَيْطَانٍ

            হাদীসটিতে আসর সম্পর্কে বলা হয়েছে যে, আসরের ওয়াক্ত যতক্ষণ না সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করে।[8]

            শরহু মাআ‘নিল আছারে হাদীসটি এই সনদে বর্ণিত হয়েছে :

حَدَّثَنَا سُلَيْمَانُ بْنُ شُعَيْبٍ، قَالَ: ثنا الْخَصِيبُ بْنُ نَاصِحٍ، قَالَ: ثنا هَمَّامُ بْنُ يَحْيَى، عَنْ قَتَادَةَ، عَنْ أَبِي أَيُّوبَ، عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ عَمْرٍو، أَنَّ النَّبِيَّ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ: " وَقْتُ الْعَصْرِ مَا لَمْ تَصْفَرَّ الشَّمْسُ

            আব্দুল্লাহ ইবন আম্র রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, আসরের ওয়াক্ত (অবশিষ্ট থাকে) যতক্ষণ না সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করে।[9]

            মুসনাদে আবী আওয়ানায় হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে এই সনদে :[10]

حدثنا علي بن حرب قال ثنا أبو عامر عن شعبة عن قتادة عن أبي أيوب عن عبد الله بن عمرو عن النبي صلى الله عليه وسلم قال وقت العصر ما لم تصفر الشمس

আবূ আওয়ানাহ বলেন,

 ورواه الدستوائي عن قتادة  

            অর্থাৎ কাতাদাহ থেকে আরও বর্ণনা করেছেন হিশাম আদ-দাসতাওয়াঈ।

            হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন আমর রা. কর্তৃক বর্ণিত সহীহ মুসলিমের আরেকটি হাদীস দেখুন, যা বর্ণিত হয়েছে এইভাবে

 حَدَّثَنَا أَبُو غَسَّانَ الْمِسْمَعِىُّ وَمُحَمَّدُ بْنُ الْمُثَنَّى قَالاَ حَدَّثَنَا مُعَاذٌ - وَهُوَ ابْنُ هِشَامٍ - حَدَّثَنِى أَبِي عَنْ قَتَادَةَ عَنْ أَبِي أَيُّوبَ عَنْ عَبْدِ اللَّهِ بْنِ عَمْرٍو أَنَّ نَبِيَّ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- قَالَ : إِذَا صَلَّيْتُمُ الْفَجْرَ فَإِنَّهُ وَقْتٌ إِلَى أَنْ يَطْلُعَ قَرْنُ الشَّمْسِ الأَوَّلُ، ثُمَّ إِذَا صَلَّيْتُمُ الظُّهْرَ فَإِنَّهُ وَقْتٌ إِلَى أَنْ يَحْضُرَ الْعَصْرُ، فَإِذَا صَلَّيْتُمُ الْعَصْرَ فَإِنَّهُ وَقْتٌ إِلَى أَنْ تَصْفَرَّ الشَّمْسُ، فَإِذَا صَلَّيْتُمُ الْمَغْرِبَ فَإِنَّهُ وَقْتٌ إِلَى أَنْ يَسْقُطَ الشَّفَقُ، فَإِذَا صَلَّيْتُمُ الْعِشَاءَ فَإِنَّهُ وَقْتٌ إِلَى نِصْفِ اللَّيْلِ.

            হাদীসটিতে বলা হয়েছে যে, যখন তোমরা যোহরের সালাত আদায় করবে তখনকার ওয়াক্তটি যোহরের ওয়াক্ত, আসরের ওয়াক্ত উপস্থিত হওয়া পর্যন্ত। অতপর যখন আসরের সালাত আদায় করবে তখন তা আসরের ওয়াক্ত, সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করা পর্যন্ত।...[11]

            হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন আম্র রা.-এর এই হাদীস দুইটি আমাদেরকে জানান দেয় যে, আসরের ওয়াক্ত কোনো বস্তুর ছায়া দ্বিগুণ হলেই শেষ হয়ে যায় না, বরং সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত থাকে। আরও একটি হাদীস দেখুন, যেটি সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে বর্ণিত হয়েছে। সালাতের ওয়াক্ত সম্পর্কে এক ব্যক্তি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে প্রশ্ন করলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুখে কোনো উত্তর না দিয়ে প্রতিটি সালাতকে দুই দিনে দুই সময়ে আদায় করে কর্মের মাধ্যমে প্রশ্নকারীকে সালাতের ওয়াক্ত সম্পর্কে জানান দেন। সাহাবী হযরত আবূ মূসা আশআরী রা. ঘটনাটির দ্বিতীয় দিনের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন,

 ثم أخر العصر حتى انصرف منها والقائل يقول قد إحمرت الشمس  

            (অতপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসরের সালাতকে দেরী করে আদায় করলেন এবং সালাত সম্পন্ন করলেন এরূপ সময়ে যখন কেউ বলছিল, সূর্য তো লাল হয়ে গেছে।)[12]  হাদীসটি আমাদের পূর্বোক্ত কথাই প্রমাণ করে যে, আসরের সালাতের ওয়াক্ত কোনো বস্তুর ছায়া দ্বিগুণ হলেই শেষ হয়ে যায় না বরং সূর্য হলুদ বা লাল বর্ণ ধারণ করার পূর্ব পর্যন্ত আসরের ওয়াক্ত থাকে। কিন্তু আরও কিছু হাদীস আমাদেরকে বলে যে, আসরের ওয়াক্ত আরও প্রলম্বিত হয় এবং সূর্যাসেত্মর পূর্ব পর্যন্ আসরের ওয়াক্ত থাকে। একটি হাদীস তো বুখারী শরীফসহ হাদীসের বিভিন্ন কিতাবে আছে। হাদীসটি আবূ হুরায়রাহ রা. কর্তৃক বর্ণিত। হাদীসটি এই :

مَنْ أَدْرَكَ رَكْعَةً مِنَ الصُّبْحِ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ فَقَدْ أَدْرَكَ الصُّبْحَ وَمَنْ أَدْرَكَ رَكْعَةً مِنَ الْعَصْرِ قَبْلَ أَنْ تَغْرُبَ الشَّمْسُ فَقَدْ أَدْرَكَ الْعَصْرَ

            অর্থাৎ যে ব্যক্তি সূর্যোদয়ের পূর্বে ফজরের সালাতের এক রাকআত পেল সে ফজর পেল আর যে ব্যক্তি সূর্যাসেত্মর পূর্বে আসরের এক রাকআত পেল সে আসর পেল।[13]

            সহীহ বুখারীর অন্য বর্ণনায় হাদীসটি অতিরিক্ত একটি বক্তব্যসহ ব্যক্ত হয়েছে। বলা হয়েছে :

إِذَا أَدْرَكَ أَحَدُكُمْ سَجْدَةً مِنْ صَلاَةِ الْعَصْرِ قَبْلَ أَنْ تَغْرُبَ الشَّمْسُ فَلْيُتِمَّ صَلاَتَهُ، وَإِذَا أَدْرَكَ سَجْدَةً مِنْ صَلاَةِ الصُّبْحِ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ فَلْيُتِمَّ صَلاَتَهُ.

            যখন তোমাদের কেউ সূর্যাস্তের পূর্বে আসরের সালাতের এক রাকআত পায় সে যেন তার সালাত পূর্ণ করে নেয়। আর যখন সূর্যোদয়ের পূর্বে ফজরের সালাতের এক রাকআত পায় সে যেন তার সালাত পূর্ণ করে নেয়।[14]

            হাদীসটি স্পষ্টরূপেই ব্যক্ত করে যে, আসরের সালাতের ওয়াক্ত সূর্যাস্তের পূর্ব পর্ন্ত থাকে। আরেকটি হাদীস দেখুন। হাদীসটি আবূ কাতাদাহ রা. কর্তৃক বর্ণিত। হাদীসটি সহীহ মুসলিম, নাসাঈ,  দারাকুতনী ও সহীহ ইব্ন হিববানসহ বিভিন্ন হাদীসের কিতাবে সন্নিবেশিত হয়েছে। হাদীসটি এই :

 إِنَّهُ لَيْسَ فِى النَّوْمِ تَفْرِيْطٌ إِنَّماَ التَّفْرِيْطُ عَلَى مَنْ لَمْ يُصَلِّ حَتَّى يَجِيْءَ وَقْتُ الصَّلَاةِ الْأُخْرَى  

            (নিদ্রায় কোনো গুনাহ নেই। গুনাহ ঐ ব্যক্তির উপর যে আরেকটি সালাতের ওয়াক্ত না আসা পর্যন্ত সালাত আদায় করেনি।)[15]  অর্থাৎ যে ব্যক্তি নিদ্রার কারণে সালাতের ওয়াক্তে সালাত আদায় করতে পারেনি, নিদ্রার কারণে সালাত কাযা হয়ে গেছে, তার ত্রুটি হয়েছে বলে বলা হবে না। কিন্তু যে ব্যক্তি জাগ্রত থাকা সত্ত্বেও সালাত আদায় করেনি, এমনকি আরেকটি সালাতের ওয়াক্ত চলে এসেছে ফলে তার সালাত কাযা হয়ে গেছে তার সম্পর্কে বলা হবে যে, তার অপরাধ হয়েছে।

            এই হাদীস দ্বারা বোঝা যায় যে, প্রতিটি সালাতের ওয়াক্ত পরবর্তী সালাতের ওয়াক্ত আসার পূর্ব পর্যন্ত বহাল থাকে। ব্যতিক্রম শুধু ফজরের ওয়াক্ত। কারণ, ফজরের ওয়াক্ত বহাল থাকে সূর্যোদয় পর্যন্ত। যোহরের ওয়াক্ত আসার পূর্ব পর্যন্ত নয়। ফজরের ওয়াক্ত ব্যতিক্রম কেন সে সম্পর্কে আগামীতে এশার সালাতের ওয়াক্ত সংক্রন্ত আলোচনায় ইমাম মুসলিম রাহিমাহুল্লাহর বক্তব্যটি পাঠ করুন।

            তো কিছু হাদীস দ্বারা বোঝা যায় যে, আসরের ওয়াক্ত সূর্য হলুদ বা লাল বর্ণ ধারণ করা পর্যন্ত থাকে আর কিছু হাদীস দ্বারা বোঝা যায় যে, সূর্যাস্ত পর্যন্ত থাকে। এই উভয় প্রকার হাদীসই যেহেতু সহীহ সেহেতু এই উভয় প্রকার হাদীসের মাঝে সমন্বয় সাধন জরুরী। সমন্বয় সাধন করতে গিয়ে উলামায়ে কেরাম বলেছেন, সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার পূর্ব পর্যন্ত আসরের সালাতের ওয়াক্ত মাকরূহবিহীন বা দোষমুক্ত ওয়াক্ত। সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করলে মাকরূহ ওয়াক্ত চলে আসে। কিন্তু তখনও আসরের ওয়াক্ত থাকে এবং সূর্যাসেত্মর পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত থাকে।

            এখানে উদ্ধৃত সহীহ মুসলিমের ১৪১৬ নং হাদীসের ব্যাখ্যায় আল্লামা নববী রাহ. তেমনটাই বলেছেন। তিনি বলেছেন: 

معناه فإنه وقت لأدائها بلا كراهة، فإذا اصفرت صارت وقت كراهة وتكون أيضا أداءً حتى تغرب الشمس، للحديث السابق "من أدرك ركعة من العصر قبل أن تغرب الشمس فقد أدرك العصر" وفى هذا الحديث رد على أبي سعيد الإصطخرى رحمه الله تعالى في قوله: إذا صار ظل الشيء مثليه صارت العصر قضاء

            অর্থাৎ (অতপর যখন আসরের সালাত আদায় করবে তখন তা আসরের ওয়াক্ত, সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করা পর্যন্ত) ‘কথাটির অর্থ হল, ঐ ওয়াক্তটি আসরের ‘আদা’-এর মাকরূহবিহীন ওয়াক্ত। অতপর যখন সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করবে তখন তা মাকরূহ ওয়াক্ত হয়ে যাবে। তবে তখনও তা ‘আদা’-এর ওয়াক্ত বলে বিবেচিত হবে যতক্ষণ না সূর্য অস্ত যায়। পূর্ববর্তী হাদীস ‘‘যে ব্যক্তি সূর্যাস্তের পূর্বে এক রাকআত পেল সে আসর পেল’’-এর কারণে। এবং এই হাদীসে আবূ সাঈদ আল-ইস্তাখ্রী রাহিমাহুল্লাহর বক্তব্যের খণ্ডন রয়েছে। তিনি বলেছেন, যখন বস্তুর ছায়া তার দ্বিগুণ হয় তখন আসর কাযা হয়ে যায়।’

            এসব হাদীস দ্বারা বুঝা যায়, কেউ যদি সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার পর আসরের সালাত আদায় করে তাহলে তার সালাত মাকরূহ ওয়াক্তে আদায় হয়েছে বলে বলা যাবে কিন্তু এ কথা বলা যাবে না যে, তার সালাত কাযা হয়ে গেছে। সালাত কাযা হয়ে গেছে বলা যাবে তখন যখন সূর্য অস্তমিত হওয়া সত্ত্বেও আসরের সালাত আদায় না করা হয়। সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার পর যেহেতু মাকরূহ ওয়াক্ত চলে আসে সেহেতু বিনা ওজরে কেউ যদি সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করা পর্যন্ত দেরী করে আসরের সালাত আদায় করে তাহলে সে গুনাহগার হবে।

            সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করলে মাকরূহ ওয়াক্ত চলে আসা এবং বিনা ওযরে তখন ঐ সময়ে সালাত আদায় করার কারণে ব্যক্তির  গুনাহগার হওয়ার দলীল নিম্নোক্ত হাদীসটি । যেটিতে ঐ সময়ে আদায়কৃত সালাতকে মুনাফিকের সালাত বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। বলা হয়েছে :

تلك صلاة المنافقين، تلك صلاة المنافقين، تلك صلاة المنافقين، يجلس أحدهم حتى إذا اصفرت الشمس وكانت بين قرني الشيطان أو على قرن الشيطان قام فنقر أربعا لا يذكر الله فيها إلا قليلا.

            ওটা মুনাফিকদের সালাত, ওটা মুনাফিকদের সালাত, ওটা মুনাফিকদের সালাত। তাদের কেউ বসে থাকে, এমনকি যখন সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করে এবং সূর্য শয়তানের দুই শিংয়ের মাঝখানে চলে যায় অথবা (বলেছেন,) শয়তানের শিংয়ের উপর চলে যায় তখন সে দাঁড়ায়, তারপর চারটি ঠোকর মারে। ঐ সালাতে সে আল্লাহর স্মরণ খুব কমই করে।[16] হাদীসটি সহীহ মুসলিমসহ হাদীসের একাধিক গ্রন্থে বর্ণিত হয়েছে। লেখকও হাদীসটিকে সহীহ মুসলিমের বরাতে এই অনুচ্ছেদে উল্লেখ করেছেন।

আলোচনার সার দাঁড়ালো এই যে, আসরের আখের ওয়াক্ত সম্পর্কে লেখকের দাবী সঠিক নয়। কোনো বস্তুর ছায়া দ্বিগুণ হলে আসরের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায় না। বরং সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত আসরের ওয়াক্ত থাকে। হাঁ, সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করলে আসরের মাকরূহ ওয়াক্ত চলে আসে। ইমাম শাফিঈ রাহ. ও ইব্ন খুযাইমাহ প্রমুখ যে সকল ফকীহ ও মুহাদ্দিস এই কথা বলেছেন যে, ‘ওজর থাকার কারণে বা সালাতের কথা বিস্মৃত হওয়ার কারণে যারা সালাত যথা সময়ে আদায় করতে পারেনি সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার পরের ওয়াক্তটি তাদের জন্য, সাধারণভাবে সকলের জন্য নয়’ তাঁদের এই কথা দ্বারা বোঝা যায় যে, তাঁরাও সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়কে আসরের ওয়াক্ত বলে মনে করেন এবং সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার পর থেকে নিয়ে সূর্যাস্ত পর্যন্ত সময়কে মাকরূহ সময় বলে মনে করেন। সূর্যাস্ত পর্যন্ত যদি আসরের ওয়াক্ত না থাকে তাহলে তাঁদের উপরিউক্ত কথার কোনো অর্থ হয় না। কারণ, ওজর বা বিস্মৃত হওয়ার কারণে তো সূর্যাস্তের পরে হলেও সালাত আদায় করা যাবে, করতে হবে। যেমনটি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম খন্দকের যুদ্ধকালে সূর্যাসেত্মর পরে আদায় করেছিলেন। হাঁ যেকোনো কারণেই হোক, সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার পর সূর্যাস্তের পূর্ব পর্যন্ত সময়ের মধ্যে যদি কেউ সালাত আদায় করে তবে তার সালাত ফউত হয়ে গেছে বলা হবে না। বলা হবে তার সালাতটি মাকরূহ ওয়াক্তে আদায় হয়েছে। আর সূর্যাস্তের পর যদি কেউ আদায় করে তখন বলা হবে যে, তার সালাত ফউত হয়ে গেছে, কাযা হয়ে গেছে।

            লেখক কর্তৃক উদ্ধৃত ছয়টি হাদীসের মধ্য হতে ‘(ঘ)’ চিহ্নযুক্ত চতুর্থ হাদীস নিয়ে আমরা এতক্ষণ আলোচনা করলাম। আলোচনাকালে ‘(গ)’ চিহ্নযুক্ত তৃতীয় হাদীসটির প্রসঙ্গও এসেছে। হাদীসটিতে সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার পর আসরের সালাত আদায় করাকে মুনাফিকদের সালাত আদায় করার সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে। ‘(চ)’ চিহ্নযুক্ত ষষ্ঠ হাদীস এবং এই তৃতীয় হাদীস মূলত একই হাদীস। সেটিতেও সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার পর আসরের সালাত আদায়কে মুনাফিকদের সালাত বলে আখ্যা দেওয়া হয়েছে। কিন্তু হাদীস দুটি দ্বারা এ কথা বোঝা যায় না যে, কোন বস্তুর ছায়া দ্বিগুণ হলে আসরের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায়। বরং বোঝা যায় যে, আসরের সালাতের মাকরূহবিহীন ওয়াক্ত সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার পূর্ব পর্যন্ত তথা কোনো বস্তুর ছায়া তার দ্বিগুণ হওয়ার বেশ কিছু সময় পর পর্যন্ত বহাল থাকে। ‘(ঙ)’ চিহ্নযুক্ত পঞ্চম হাদীসটিতেও আসরের সালাতের ওয়াক্ত কখন শুরু হয় বা শেষ হয় তা ব্যক্ত করা হয়নি। হাদীসটিতে ফজর ও আসরের সালাতের গুরুত্ব ব্যক্ত করা হয়েছে শুধু। আপনার সুবিধার্থে হাদীসটি এখানে লিখে দিচ্ছি। হাদীসটি এই :

عَنْ جَرِيرٍ قَالَ : كُنَّا عِنْدَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم فَنَظَرَ إِلَى الْقَمَرِ لَيْلَةً ، يَعْنِي الْبَدْرَ - فَقَالَ: إِنَّكُمْ سَتَرَوْنَ رَبَّكُمْ كَمَا تَرَوْنَ هَذَا الْقَمَرَ لاَ تُضَامُّونَ فِي رُؤْيَتِهِ، فَإِنِ اسْتَطَعْتُمْ أَنْ لاَ تُغْلَبُوا عَلَى صَلاَةٍ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ غُرُوبِهَا فَافْعَلُوا، ثُمَّ قَرَأَ : وَسَبِّحْ بِحَمْدِ رَبِّكَ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ وَقَبْلَ الْغُرُوبِ.

            বাকী রইল, ক ও খ চিহ্নযুক্ত প্রথম দুইটি হাদীস। হাদীস দুইটির প্রথমটি হল এই হাদীস : [17]

كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم يُصَلِّي الْعَصْرَ وَالشَّمْسُ مُرْتَفِعَةٌ حَيَّةٌ فَيَذْهَبُ الذَّاهِبُ إِلَى الْعَوَالِي فَيَأْتِيهِمْ وَالشَّمْسُ مُرْتَفِعَةٌ وَبَعْضُ الْعَوَالِي مِنَ الْمَدِينَةِ عَلَى أَرْبَعَةِ أَمْيَالٍ ، أَوْ نَحْوِه

            রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সূর্য উঁচুতে ও জীবন্ত থাকা অবস্থায় আসরের সালাত আদায় করতেন। অতপর কোনো চলে যেতে ইচ্ছুক ব্যক্তি আওয়ালীর দিকে চলে যেত এবং সূর্য উঁচুতে থাকাকালেই আওয়ালীতে পৌঁছে যেত। আর আওয়ালীর কোনো কোনো স্থান ছিল মদীনা হতে চার মাইল বা অনুরূপ দূরে।

দ্বিতীয়টি এই :[18]

 عن رَافِع بْن خَدِيجٍ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، قَالَ : كُنَّا نُصَلِّي مَعَ النَّبِيِّ صلى الله عليه وسلم الْعَصْرَ فَنَنْحَرُ جَزُورًا، فَتُقْسَمُ عَشْرَ قِسَمٍ، فَنَأْكُلُ لَحْمًا نَضِيجًا قَبْلَ أَنْ تَغْرُبَ الشَّمْسُ.

            রাফে‘ ইব্ন খাদীজ রা. বলেন, আমরা নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গে আসরের সালাত আদায় করতাম অতপর একটি উট যবেহ করতাম ও তার গোশতকে দশ ভাগ করা হত। অতপর সূর্য ডুবার পূর্বেই আমরা পাকানো গোশত খেতাম।

            এই হাদীস দুইটিতেও বলা হয়নি যে, কোন বস্তুর ছায়া দ্বিগুণ হলে আসরের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যায়। লেখক হাদীস দুইটিকে সম্ভবত উল্লেখ করেছেন এই কথা বোঝানোর জন্য যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আসরের সালাত আগে আগে আদায় করতেন, দেরী করে আদায় করতেন না।

            দেখার বিষয় হল, আমাদের দেশের মসজিদসমূহে যে সময়ে আসরের সালাত আদায় করা হয় তা জাল হাদীস কিংবা যঈফ হাদীসের অনুসরণ করে আদায় করা হয়, না এর পক্ষে সহীহ হাদীস আছে। আমরা উপরের আলোচনায় দেখিয়েছি যে, সহীহ হাদীস অনুযায়ী সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার পূর্ব পর্যন্ত আসরের মাকরূহবিহীন ওয়াক্ত বহাল থাকে। আমাদের দেশের মসজিদসমূহে যে সময়ে আসরের সালাত আদায় করা হয় তার অনেক পরে সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করে। অতএব মুনাফিকদের সালাত সম্পর্কে যে হাদীস দুইটি লেখক উল্লেখ করেছেন তা এই দেশে আদায়কৃত সালাতের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হয় না। আমার ধারণায় লেখকও বিষয়টি ভাল করেই জানেন। তবুও হাদীস দুইটিকে তিনি উল্লেখ করেছেন সম্ভবত পাঠককে বিভ্রান্ত করার প্রয়াসেই। আমার ধারণা ভুল হলে আল্লাহ আমাকে ক্ষমা করুন। না হলে লেখককে ক্ষমা করুন।

মুহতারাম,

            আমাদের দেশে যে সময়ে আসরের সালাত আদায় করা হয় সে সময়ে আসরের সালাত আদায় করা আলোচ্য হাদীস দুইটির বিরোধী নয়। কারণ, আলোচ্য হাদীস দুইটির প্রথমটিতে ব্যক্ত হয়েছে যে, আসরের সালাত আদায়ের পর কোনো ব্যক্তি আওয়ালীয়ে মদীনায় পৌঁছে যেত সূর্য উঁচুতে থাকতেই। আওয়ালীয়ে মদীনার কোনো কোনো স্থান চার মাইল বা অনুরূপ দূরে। তথা কোনো স্থান দুই মাইল দূরে, কোনো স্থান তিন মাইল দূরে। সূর্য কত উঁচুতে থাকতে পৌঁছে যেত হাদীসে তা নির্দিষ্ট করে বলা হয়নি। তবে আমি মনে করি হযরত আনাস রা. বোঝাতে চেয়েছেন, সূর্য এতটুকু উঁচুতে থাকত যে, সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করত না। আমার এই মনে করার কারণ হল, সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করলে যেহেতু আসরের সালাতের মাকরূহ ওয়াক্ত চলে আসে তাই হযরত আনাস রা. বোঝাতে চেয়েছেন যে, রাসূলের যুগে সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করার অনেক পূর্বে আসরের সালাত আদায় করা হত। এতটুকু পূর্বে যে, আসরের সালাত আদায় করার পর একজন ব্যক্তি আওয়ালীয়ে মদীনায় গমন করার পরও সূর্য হলুদ বর্ণ ধারণ করত না। তো আসরের সালাতের পর সূর্য অতটুকু উঁচুতে থাকা অবস্থায় অতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করার বিষয়টি আপেক্ষিক। ব্যক্তির উচ্চতা ও গতি যদি বেশী থাকে তবে আমাদের দেশে যে সময়ে আসরের সালাত আদায় করা হয় সেই সময়ে সালাত আদায় করে সূর্য অতটুকু উঁচুতে থাকতে অতটুকু দূরত্ব অতিক্রম করা সম্ভব। এই যে আমি। পাঁচ ফুট দুই ইঞ্চির একজন মানুষ। আমিও তো স্বাভাবিক গতিতে হেঁটে আঠারো মিনিটে এক মাইল দূরত্ব অতিক্রম করতে পারি। কাজেই আমাদের দেশে আসরের সালাত যে সময়ে আদায় করা হয়ে থাকে সেই সময়ে আসরের সালাত আদায় করা এই হাদীসের বিরোধী বলা যায় না। আর দ্বিতীয় হাদীসটিতে বলা হয়েছে যে, আসরের সালাত আদায়ের পর তাঁরা উট যবেহ করে গোশত বানিয়ে সূর্য ডুবার পূর্বেই রান্না করা গোশত খেতেন। এই হাদীসটিও সুনির্দিষ্ট ওয়াক্ত বর্ণনা করছে না। কারণ, এই বিষয়টিও আপেক্ষিক। উট যবেহ করে গোশত বানানো, তারপর তা রান্না সম্পন্ন করতে কত স্বল্প ও অধিক সময়ের প্রয়োজন তা নির্ভর করে গোশত বানানেওয়ালা ও রান্না করনেওয়ালার দক্ষতা ও অদক্ষতার উপর। দক্ষ কসাই ও দক্ষ বাবুর্চি হলে আমাদের দেশে যে সময়ে আসরের সালাত আদায় করা হয়ে থাকে সেই সময়ের পর থেকে সূর্য ডুবা পর্যন্ত সময়ের মধ্যে এই কাজগুলো করা সম্ভব। এটিও প্রণিধানযোগ্য যে, তাঁরা কিন্তু আমাদের মত গোশতকে ছোট ছোট টুকরা করতেন না। আবার আমাদের মত নানা রকম মসলাসহ গোশত কষিয়ে তাঁরা রান্না করতেন না। ফলে তাঁদের রান্না হত দ্রুত।

            জাল হাদীসের কবলে রাসূলুল্লাহর ছালাত নামক বইয়ের লেখকের উচিত ছিল, সুনির্দিষ্টভাবে ব্যক্ত করা যে, কোন্ জাল হাদীসের উপর ভিত্তি করে এ দেশে সালাতের ওয়াক্ত নির্ধারণ করা হয়েছে এবং দেখানো উচিত ছিল যে, এ দেশে অমুক সালাতটি যে ওয়াক্তে আদায় করা হয় সেই ওয়াক্তে সালাত আদায় করার পক্ষে কোনো সহীহ হাদীস নেই এবং সেই ওয়াক্তে সালাত আদায় করলে সালাত কাযা হয়ে যায়। কিয়ামত পর্যন্ত গবেষণা করেও লেখক এই কাজটি করতে পারবেন না। তাহলে কেন তিনি ঐ উদ্ভট নাম তাঁর বইয়ের জন্য নির্বাচিত করলেন? আল্লাহর ভয় কি একটুও নাই তাঁর?  



[1] . মুস্তফা আব্দুল কাদের আতা-এর তাহকীকসহ দারুল কুতুবিল ইলমিয়্যাহ প্রকাশিত মুস্তাদরাক আলাস সহীহাইন, খ- ১ পৃষ্ঠা ৩০৫ হাদীস ৬৯০

[2] আত-তারীখুল কাবীর, ভুক্তি নং ১২১৯

[3] আল জারহু ওয়াত তা‘দীল,  ক্রমিক নং ২৪১৭

[4] আছ ছিকাত ইব্ন হিববান ক্রমিক নং ২৭৯০

সুআলাতুল বারকানী লিদ্দারাকুতনী ক্রমিক নং ১৬১

[6]. মুহতারাম, আমি যখন লেখকের বক্তব্য উদ্ধৃত করি তখন তাঁর ব্যবহৃত বর্ণ ও বানানকেই বহাল রাখি। যেমন আসর শব্দটিতে আমি দন্ত স ব্যবহার করেছি কিন্তু লেখক যেহেতু ‘আছর’ লিখেছেন তাই তাঁর বক্তব্যে তাঁর বর্ণটিই আমি ব্যবহার করেছি। ঠিক ‘ছালাত ও হাদীছে’র ক্ষেত্রেও আমি লিখি সালাত ও হাদীস। আর এই কারণেই একই শব্দের বানানে ভিন্নতা দেখতে পাচ্ছেন। আমার নিজের বক্তব্যে আমি সর্বত্র একই বানান ব্যবহার করতে চেষ্টা করেছি।

[7] . জামে তিরমিযী, হাদীস ১৫১ । মুসনাদে আহমাদ, হাদীস ৭১৭২। মুসনাদে বায্যার, হাদীস ৯২১০

[8] . সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪১৯

[9] . শরহু মাআনিল আছার, হাদীস ৯০৯

[10] . মুসনাদে আবী আওয়ানাহ, হাদীস ১০৫৭

[11] . সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪১৬, উপমহাদেশীয় ছাপা কিতাবের পৃষ্ঠা ২২২

[12] . সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪২৪, উপমহাদেশীয় কপির ২২৩ পৃষ্ঠা; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ৫২৩; দারাকুতনী, হাদীস ১০৩৭,১০৩৮; বায়হাকী, হাদীস ১৫৯২,১৬০৯; মুসান্নাফে ইব্ন আবি শাইবা হাদীস ৩২৪০

[13] .সহীহ বুখারী, হাদীস  ৫৭৯, সহীহ মুসলিম হাদীস ১৪০৪, মুআত্তা মালেক হাদীস ৫, শরহু মাআনিল আছার হাদীস ৯১১ ও ৯১৩

[14] . সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫৬

[15] . সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৫৯৪, উপমহাদেশীয় কিতাবের পৃষ্ঠা ২৩৯; সুনানে নাসাঈ, হাদীস ১৫৯৬; দারাকুতনী, হাদীস ১৪৪২; সহীহ ইব্ন হিববান, হাদীস ১৪৬০

[16] . মুআত্তা মালেক, হাদীস ৫১; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪৪৩

[17]. সহীহ বুখারী, হাদীস ৫৫০; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪৩৯

[18]. সহীহ বুখারী, হাদীস ২৪৮৫; সহীহ মুসলিম, হাদীস ১৪৪৬

 

 

advertisement