মুহাররম ১৪৩৬   ||   নভেম্বর ২০১৪

মাসবূক হলাম তো হেরে গেলাম

আবূ আহমাদ

যে ব্যক্তি জামাতের নামাযের এক বা ততোধিক রাকাত পায় না তাকে মাসবূক বলে। মাসবূক অর্থ, পিছে পড়া ব্যক্তি, যেন সে হেরে গেল; তাকে পিছে ফেলে অন্য কেউ আগে চলে গেল। কেউ কি হেরে যেতে চায়? পিছে পড়তে চায়? কচ্ছপও তো খরগোশের কাছে হারতে রাজি নয়। আর আমি তো আশরাফুল মাখলুকাত, সৃষ্টির সেরা; আমি কি হার মানতে পারি? শয়তানের কাছে হার মানতে পারি? তাও আবার সর্বশ্রেষ্ঠ আমল নামাযের বিষয়ে! কিয়ামতের দিন তো সর্বপ্রথম নামাযেরই হিসাব নেওয়া হবে।

  মসজিদে ইমাম সাহেব সালাম ফিরানোর পর যখন মাসবূক মুসুলস্নীরা বাকি নামাযের জন্য দাঁড়ায়, তাদের মাঝে নিজেকে দেখতে বড় লজ্জা লাগে। মনে হয়, আমি হেরে যাওয়ার দলে। শয়তানের কাছে হেরে গেছি। ছোট বেলায় যেমন খেলায় যারা হেরে যেত তাদের আমরা বলতাম, হারু পার্টি! 

  তাই বলে মাসবূক হওয়ার লজ্জায় কখনো জামাত ছাড়ি না। হেরে গেছি তাই কী হয়েছে। জামাতে তো নামাযটা হল। একাকী নামায থেকে সাতাশ গুণ বেশি সওয়াব তো পেলাম। নবীজী তো আর বলেননি যারা মাসবূক হবে তারা এই সাওয়াব পাবে না। ঘরে নামায পড়ার চেয়ে এক রাকাত পেলেও মসজিদে জামাতের নামাযে অনেক শান্তি। কলিজাটা ঠাণ্ডা হয়ে যায়! হাঁ, তাকবীরে উলার ফযীলত পেলাম না, সে দুঃখ অবশ্য রইল। 

  যাইহোক, শয়তান কিন্তু আমাদের মাসবূক বানাতে চায়। শয়তানের প্রথম চেষ্টা মানুষকে নামায তরককারী বানানো। অর্থাৎ সে যেন একেবারেই নামায না পড়ে। এরপরের চেষ্টা, নামায কাযা করানো। অর্থাৎ নামায যদি পড়েও যেন সময়ের পরে পড়ে। এরপরের চেষ্টা জামাত ত্যাগ করানো। অর্থাৎ সময়ের ভিতরে পড়লেও যেন একা পড়ে, জামাতে না যায়। এরপরের চেষ্টা, মাসবূক বানানো। নিয়তে রিয়া ঢোকানো খুশু-খুযু নষ্ট করা ইত্যাদি। সুতরাং মাসবূক হওয়া মানেও এক পর্যায়ের হার। এই সকল ক্ষেত্রের একটিতে শয়তানের কাছে হেরে যাওয়া। আমি কি শয়তানের কাছে হেরে যাব? এটা বড় লজ্জার বিষয়! একদিন না হয় হেরে গেলাম বা এক ওয়াক্ত হেরে গেলাম, কিন্তু প্রতিদিন প্রতি ওয়াক্তে আমি শয়তানের কাছে হেরে যাব! আর শয়তান আমার পরাজয় দেখে মিটিমিটি হাসবে? নাহ! এখনই প্রতিজ্ঞা করি, আর নয়। এখন থেকেই সচেতন হব। আর সুযোগ দেব না শয়তানকে।

  সে বিভিন্নভাবে আমাদের মাসবূক বানাতে চায়। সে নতুন নতুন পন্থা আবিষ্কার করে। নেক ছুরতে ধোঁকা দেয়। আমাকে বুঝতে হবে কোন্ কোন্ পথে শয়তান আমাকে ধোঁকা দিয়ে মাসবূক বানাচ্ছে। ফজরের সময় যখন আযান শুনি শয়তান তখন বলে, কেবল তো আযান হল, নামাযের বেশ বাকি, আরেকটু পর ওঠ, ঘুমের রেশটা কাটিয়ে নাও। যদি উঠেই যাই তাহলে শয়তান বলে, পাঁচ মিনিট আগে গেলেই চলবে। শুধু তো দুই রাকাত সুন্নত পড়তে হবে। তখন যেতে যেতে জামাত দাঁড়িয়ে যায়। আর সুন্নত পড়তে পড়তে এক রাকাত ছুটে যায়।

  অন্য নামাযের সময় আযান হওয়ার সাথে সাথেই সে পড়াশোনায় এমন মনোযোগ বসিয়ে দিতে চেষ্টা করে যে, এখনই (নামাযের পাঁচ/দশ মিনিট আগে) যেন পড়াশোনার আসল সময়। এ পৃষ্ঠাটা বা এ অধ্যায়টা শেষ করে উঠি, এখনো বেশ সময় আছে। হাতের লেখাটা পাঁচ মিনিটের মধ্যে শেষ করেই ওযু করতে যাব, এখনো পনের মিনিট বাকি। আর বিকেলে খেলার সময় তো কথাই নেই। শয়তান তখন কত পথ বের করে, কীভাবে মাগরিবের নামাযে মাসবূক বানানো যায়!  

  সুন্দর কোনো বিষয় নিয়ে লিখতে বসলে নামাযের সময় যত ঘনিয়ে আসে শয়তান তত সুন্দর সুন্দর বাক্য মনে করিয়ে দেয়। তত প্রসঙ্গ থেকে প্রসঙ্গান্তরে নিয়ে যায়। আর বলে, এইতো আরেকটু লিখেই যাবে। এই বিষয়টি দ্রম্নত লিখেই মসজিদে রওয়ানা হবে। এভাবে অগণিত পন্থায় শয়তান আমাকে মাসবূক বানাতে চায়। একটি থেকে বেঁচে গেলে আরেকটি ফাঁদ পাতে। আমাকে তখন বলতে হবে, বিনা দলীলে আল্লাহ এক! (অর্থাৎ শয়তানের সব যুক্তি ফেলে মসজিদের দিকে এগোতে হবে।)

একটা কাজ করা যায়, যে নামাযে সুন্নত আছে তার ন্যূনতম ১৫ মিনিট আগে সব বাদ। আর যে নামাযে সুন্নত নেই তার ১০ মিনিট আগে। আসলে ফিকির থাকলে আমি নিজেই বিভিন্ন পথ বের করতে পারব। আল্লাহ তাওফীক দিন। আমীন

  এখানে অবশ্য একটি কথা মনে রাখতে হবে। তা এই যে, এই মূল্যায়নটা যেন হয় আমার নিজের কর্ম সম্পর্কে। অর্থাৎ আমার মাসবূক হওয়া সম্পর্কে। অন্যের বিষয়ে এভাবে মূল্যায়ন করা ঠিক নয়। কারণ আমার বিষয়টি আমার জানা আছে। আমি শরীয়তসম্মত কোনো ওযরের কারণে মাসবূক হয়েছি না শুধু মনের বাহানায়, তা আমি জানি। কিন্তু অন্যের বিষয়টি তো আমার জানা নেই। হতে পারে তার কোনো ওযর ছিল যা শরীয়তসম্মত।

  হে পাঠক! আমার জন্য দুআ করম্নন। আল্লাহ যেন আমাকে মাসবূক না বানান। দুনিয়াতেও না, আখেরাতেও না। আমিও আপনার জন্য দুআ করি।

আমি সবচেয়ে বেশি মাসবূক হই। এজন্য আমার মনে অনেক কষ্ট। সে কষ্ট থেকেই এ লেখা। তাই আপনাদের কাছে দুআ চাই, আল্লাহ যেন আমাকে নিয়মিত পাঁচ ওয়াক্ত নামায জামাতে তাকবীরে উলার সাথে আদায় করার তাওফীক দান করেন।

 

 

 

advertisement