যিলহজ্ব ১৪৩৫   ||   অক্টোবর ২০১৪

তিনি ছিলেন তালিবুল ইলমের খাদেম

আবু সাঈদ মুজীব

সেদিন দরসে ছিলাম, সংবাদ এল পাকিস্তানি খাদেম সাহেব ইন্তেকাল করেছেন। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রজিউন। আমাদের মাদরাসায় তিনজন খাদেম। মাতবাখের খাদেম দু’জন। একজনকে পাকিস্তানি খাদেম নামে ডাকা হয়। হাসি-খুশি চেহারার একজন মানুষ। দৈনিক তাহাজ্জুদ নামায পড়েন। নিয়মিত আল্লাহর দরবারে কান্নাকাটি করেন। শেষ রাতে ঘুম ভাঙলেই শোনা যায় কান্নার গুনগুন আওয়াজ। নীরব-নিস্তব্ধ রাতের আওয়াজ বেশ দূর থেকেও শোনা যায়। মাতবাখের কাছেই আমাদের ওযুখানা। সেখান থেকে স্পষ্ট শোনা যায়। ‘আল্লাহ! আপনি আমায় মাফ করে দিন। এই মাদরাসার সকল ছাত্র-উস্তাযকে কবুল করে নিন... ’।

আমাদের তিনজন খাদেমই তিন চিল্লার সাথী। নামাযি ও তাহজ্জুদগুজার। পাকিস্তানে দীর্ঘদিন মাতবাখের খেদমতের ফলে আমরা তাকে পাকিস্তানি খাদেম বলে ডাকি। মাতবাখে গিয়ে তার সাথে যে যত রাগই করে তিনি কখনো রাগ করতেন না। আমরা সবসময় তার হাসি-খুশি চেহারাই দেখেছি। সবাইকে ভালোবাসতেন। কাউকে কখনো কষ্ট দিতেন না। মানবিক ত্রুটি বা ভুল বোঝাবুঝির কারণে কেউ কষ্ট পেলে মাফ চেয়ে নিতে দেরি করতেন না। তিনি প্রায়ই বলতেন ‘কদিন আর বাঁচব, আল্লাহর বান্দাদের  কষ্ট দিলে আল্লাহ অসন্তুষ্ট হবেন’। স্বীকারোক্তির সাবলিলতা থেকেই অনুমান করা যায় কতটা মুখলিস  তিনি। তার এখলাস ও নিঃস্বার্থ খেদমতের বদৌলতে আল্লাহ তাকে অনেক উঁচু মাকাম দান করেছেন।

আমাদের এক উস্তায সেদিন রাতে স্বপ্নে দেখেন, পাকিস্তানি খাদেম সাহেব জান্নাতে অবস্থান করছেন। জিজ্ঞাসা করলে তিনি উত্তরে বলেন, ‘সারা জীবন  তাহাজ্জুদ পড়েছি এবং তালিবুল ইলমদের খেদমত করেছি ফলে আল্লাহ আমাকে জান্নাত দিয়েছেন’।

আমাদের মুহতামিম ছাহেব দৈনিক সকাল ১০টার দিকে ঘুমান। এটা তার রুটিন। সেদিন স্বপ্নে দেখেন, পাকিস্তানি খাদেম সাহেব মুহতামিম ছাহেবের কাছে এসে বলছেন, ‘হাফেয সাব! একটু বাড়ি যাব, ছুটি দরকার’। মুহতামিম ছাহেব ছুটি দিলেন। সাথে সাথে মোবাইলের আওয়াজে ঘুম ভাঙলো। অপরপ্রান্ত থেকে বলা হল, ‘হুযুর! পাকিস্তানি খাদেম ইন্তেকাল করেছেন’। শারাফাতের দাবিই হল, মৃত্যুর পূর্বে সব ধরনের আপত্তি থেকে নিজেকে মুক্ত করা। খাদেম সাহেব তাই করেছেন। ‘আলআমালু বি খাওয়াতিমিহি’ শেষ ভালো যার সব ভালো তার। পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন, সাথে সাথে মাদরাসা থেকেও বিদায় নিয়েছেন। মাদরাসা থেকে বাড়ি যেতে হলে ছুটি নিয়ে যাওয়াই নিয়ম। তিনি তাও নিয়েছেন। জানাযার পর চিরদিনের জন্য নিজের বাড়ি চলে গেছেন।

কত সৌভাগ্য তার! একজন বে-নামাযিও নেই তার জানাযায়। কারণ, জানাযা হয়েছে মাদরাসায়। সকল ছাত্র-উস্তায ও পার্শববর্তী কয়েকজন নামাযী মানুষ শরিক হয়েছেন। জীবদ্দশায় নিজে কখনো নামায ছাড়েননি। মৃত্যুর পরও আল্লাহ তাকে বে-নামাযির জানাযা দেননি। ফযরের নামায মসজিদে জামাতের সাথে পড়েছেন। জোহরের ওয়াক্ত হওয়ার আগেই সকাল ১০ টায় মৃত্যুবরণ করেন। এক ওয়াক্ত নামাযও কাযা থাকল না তার জিম্মায়। গোসল করিয়েছেন এক তালিবুল ইলম। হাদীসে তালিবুল ইলমের মর্যাদার কথা অনেক। সেই তালিবুল ইলমের হাতে গোসল! খোশ নসীব তার।

এত সুন্দর মৃত্যুর তামান্না কার না মনে জাগে। মাটির নিচে যাওয়ার আগেই সকল ছাত্র-উস্তায মিলে তিন খতম কুরআন শরীফ এবং সূরা ইয়াসিন তিলাওয়াত করেছেন তার জন্য। কবরে গিয়ে দেখবেন আমার আগে আমার সাহায্যকারী পৌঁছে গেছে। মেহমান আসার পূর্বেই মেহমানদারি উপস্থিত।

চেহারা দেখে বোঝার উপায় নেই যে, তিনি মৃত। মনে হচ্ছে অন্যান্য দিনের মত আজও তিনি ঘুমিয়ে আছেন। মৃত্যুকালীন কষ্ট-ক্লেশের কোনো ছাপ নেই চেহারায়; আরামের ঘুম ঘুমাচ্ছেন। সবচেয়ে প্রিয় রাবেব কারীমের দরবারে উপস্থিত হবেন। তাই চেহারায় মুচকি হাসি ও আনন্দের আভাস।

দুই-তিন দিন পূর্বে সামান্য জ্বর-কাশি হয়েছে। মাদরাসার পাশে বোনের বাসায় গিয়েছেন বিশ্রাম নিতে। জ্বর-কাশি তো আমাদেরও হয়। কিন্তু মৃত্যুর দুয়ারে প্রবেশ করে ক’জন? পাকিস্তানি খাদেম সাহেব এই সামান্য জ্বর-কাশিতেই মারা গেলেন। জ্বর-কাশি হল একটি উসিলা। মৃত্যুই তার আসল অসুস্থতা। মৃত্যু এভাবেই আসে। কেউ আমরা মৃত্যু থেকে বাঁচতে পারব না। তাই মৃত্যুর জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা চাই।

 

খাদেম সাহেব আগের দিনও মাদরাসায় এসেছিলেন। চতুর্দিকে ঘুরে ঘুরে দেখেছিলেন। কী যেন প্রিয় বস্তু হারাতে চলেছেন। কিন্তু আরো বড় কিছু পাওয়ার আশাও কি বুকে ছিল? তাই শুধু তাকিয়ে দেখেছিলেন। মুখে কিছু বলেননি। ঠিক পরদিনই চলে গেলেন মহান আল্লাহ তাআলার কাছে। আমাদের মৃত্যুও যেন এমন হয়; বরং আরো সুন্দর হয়। আমীন। ইয়া রাববাল আলামীন। 

 

 

advertisement