যিলহজ্ব ১৪৩৫   ||   অক্টোবর ২০১৪

‘একটি বই, একটি চিঠি’ আমাকে কী দিয়ে গেল?

মাসিক আল-কাউসার আগস্ট ২০১৪ সংখ্যায় ‘একটি বই, একটি চিঠি’ শিরোনামে হযরত মাওলানা আবদুল গাফফার ছাহেবের লেখাটি পড়ে খুব তৃপ্ত হলাম, মুগ্ধ হলাম। পরিচিত অনেক পাঠকের সঙ্গে আলাপচারিতায় জানতে পারলাম তারাও লেখাটি পড়ে মুগ্ধ হয়েছেন। তাঁর লেখার অনেক সৌন্দর্য রয়েছে যার সবটুকু হয়ত আমি ব্যক্ত করতে পারব না। তবে যে সৌন্দর্য আমার সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে তা হল, ভিন্নমতাবলম্বীর উগ্রতা, মাত্রাতিরিক্ত বাড়াবাড়ি, অসংযত বক্তব্য ও মিথ্যাচার ও অপবাদ আরোপ ইত্যাদির মোকাবেলায় তাঁর সহিষ্ণুতা এবং সংযত বক্তব্য। তিনি অত্যন্ত সুন্দর ও শালীন ভাষায় তাঁর কথাগুলো তুলে ধরেছেন। দাওয়াতের ময়দানে ও সত্যের প্রচারে কার্যকরী ফল লাভের জন্য যা অন্যতম ও অপরিহার্য অনুষঙ্গ। লেখাটি আমাকে প্রতিপক্ষের বক্তব্য খণ্ডন করার সময়ও সংযত থেকে নিজের বক্তব্যকে ইনসাফের মানদ-- বিচার করতে শিক্ষা দেয়। যদিও প্রতিপক্ষ না-হকপন্থী হয় তবুও। আর হক্বপন্থী হলে তো কোনো কথা-ই নেই!

  হযরত তাঁর চিঠির শেষ দিকে ইমাম ও ফকীহগণের মধ্যকার মতপার্থক্যকে দ্বীন ইসলাম কীভাবে মূল্যায়ন করতে শিক্ষা দেয় বিষয়টি সংক্ষিপ্তাকারে অত্যন্ত চমৎকারভাবে ব্যক্ত করেছেন। আলেম ও নায়েবে নবীগণের কি উচিত সহনীয়, স্বীকৃত ও অনিবার্য মতপার্থক্যকে ইচ্ছাকৃতভাবে অসহনীয় বিভেদের রূপ দিয়ে বিবাদ-বিসম্বাদ সৃষ্টি করা এবং এর পিছনেই নিজেদের সমুদয় শক্তি ক্ষয় করে ফেলা, নাকি ব্যাপক ইরতিদাদ ও নাস্তিকতার শিকার মুসলিম উম্মাহকে রক্ষা করার পেছনেই তাদের সকল শক্তি নিয়োজিত করা। অত্যন্ত দরদী ভাষায় বিষয়টি ভেবে দেখার প্রতি হযরত আমাদের সকলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন।

  ‘আহলে হাদীস’ সম্প্রদায়- যারা দাবী করে যে, একমাত্র তারাই হাদীসের অনুসরণে সালাত আদায় করে থাকে, পক্ষান্তরে এই দেশসহ বিভিন্ন দেশে বিপুল জনগোষ্ঠী যে সালাত আদায় করে তা হাদীসের অনুসরণে নয় বরং মাযহাবের অনুসরণে - তারা বিভিন্নভাবে প্রচার প্রচারণা চালিয়ে সাধারণ জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। বিশেষত পুস্ত পুস্তিকা ও লিফলেটের মাধ্যমে। তাদেরই একজন মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব লিখেছেন ‘জাল হাদীসের কবলে রাসূলুল্লাহর ছালাত’ নামক একটি বই। যে বইতে তিনি প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, এই দেশে যে সালাত আদায় করা হয় তার ভিত্তি জাল ও যঈফ হাদীস। বইটি পাঠ করে সাধারণজন নিজেদের সালাতের ব্যাপারে সংশয়ে নিপতিত হয়েছেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন! আলহামদুলিল্লাহ, বইটির একটি অধ্যায়ের অংশবিশেষের যে পর্যালোচনা হযরত করেছেন তাতেই পরিষ্কার হয়ে গেছে যে, বইটি কেবলই নামসর্বস্ব! মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের দাবি বাস্তবতা বিবর্জিত ও অন্তসারশূন্য! তিনি এ বইটির মাধ্যমে মারাত্মক ধোঁকা ও প্রতারণার জাল বিছিয়ে দিয়েছেন। অতএব তার এ বইটির নাম পাল্টে দিয়ে কেউ যদি বলেন, বইটির নাম হওয়া উচিত ‘মুযাফফর বিন মুহসিনের কবলে রাসূলুল্লাহর সালাত’ তাহলে বোধহয় অন্যায় হবে না।

  হযরতের লেখা এ চিঠিতে আমাদের দেশের আহলে হাদীস ভাইদের জন্যও চিন্তার খোরাক রয়েছে প্রচুর। লেখাটি পাঠ করে তারা যদি চিন্তা করেন তাহলে তাদের সামনে স্পষ্ট হয়ে যাবে যে, হাদীসের অনুসরণের কথা বলে তাদেরকে মাযহাবের গণ্ডি থেকে বের করে নেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এরপর কি তারা আসলেই কেবল হাদীসের অনুসরণ করতে পারছেন? নাকি প্রসিদ্ধ ও সুশৃঙ্খল ও সুসমৃদ্ধ মাযহাব পরিত্যাগ করে হাদীসের নামে অপ্রসিদ্ধ ও বিশৃঙ্খল ও অপরিপূর্ণ মাযহাবের জালে আটকা পড়ে যাচ্ছেন? তারা বুঝতে পারবেন যে, আসলে তারা হাদীস অনুসরণের চিরাচরিত স্বীকৃত ও নিরাপদ পন্থা ছেড়ে নব আবিস্কৃত বিপদসঙ্কুল পথ বেছে নিয়েছেন! তারা প্রয়োজন অনুভব করতে পারবেন, ইসলামে হাদীস অনুসরণের ইতিহাস খুঁজে দেখার। একেবারে নবীজীর হাতে গড়া সাহাবীদের আমল থেকে শুরু করে বর্তমান কাল পর্যন্ত 

  বাংলাদেশের আহলে হাদীস আলেম মুযাফফর বিন মুহসিন রচিত ‘জাল হাদীসের কবলে রাসূলুল্লাহর ছালাত’ বইয়ের একটি অধ্যায়ের অংশবিশেষ নিয়ে মাওলানা আবদুল গাফফার ছাহেবের পর্যালোচনায় উঠে এসেছে যে, মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেব ও তাঁর মতাদর্শীরা হাদীসের অনুসরণের নামে কী করছেন? হযরতের পর্যালোচনাটি পাঠ করে তাদের যে কীর্তিগুলো আমার সামনে স্পষ্ট হয়েছে তা সংক্ষেপে তুলে ধরছি।

১. নিজের বক্তব্যকে হাদীস বানানোর অপচেষ্টা।

২. কুরআনের আয়াত ও হাদীসের নিজস্ব ব্যাখ্যা বা তাবীলকে হাদীস নামে চালিয়ে দেয়ার জন্য বরাতে হাদীস বা আয়াতের নাম্বার উল্লেখ করা- যাতে পাঠক আয়াত বা হাদীস নাম্বার দেখে মনে করেন হাদীসে এ কথাটাই আছে। অথচ এ কথাটা হাদীসের একাধিক সম্ভাব্য ব্যাখ্যার একটি ব্যাখ্যা হতে পারে মাত্র।

৩. নির্দ্বিধায় যঈফ হাদীসকে সহীহ আর সহীহ হাদীসকে যঈফ বা জাল আখ্যায়িত করা। অথচ সহীহ হাদীসকে জাল আখ্যায়িত করা নবীজীর নামে জাল হাদীস রচনা করার চাইতে কোনো অংশে কম নয়।

৪. প্রতিপক্ষের পক্ষে ইচ্ছাকৃত জাল দলিল পেশ করে প্রতিপক্ষের উপর অপবাদ আরোপ করা যে, প্রতিপক্ষ এই জাল হাদীস অনুযায়ী আমল করে থাকে। (এ কাজটি তিনি ছাড়া তাদের ফেরকার অনেক মানুষই করে থাকেন।)

৫. হাদীসের ইচ্ছাকৃত বা অজ্ঞতাবসত মারাত্মক ভুল ব্যাখ্যা বা অপব্যাখ্যা করা।

৬. হাদীসের সঠিক ব্যাখ্যাকে অথবা সম্ভাব্য ব্যাখ্যাকে জোরপূর্বক অপব্যাখ্যা দাবি করা।

৭. প্রতিপক্ষের ফিকহের কিতাবের বক্তব্যকে বিকৃত করে উপস্থাপন করা। উদ্দেশ্য, ফিকহী গ্রন্থগুলোর প্রতি পাঠককে বীতশ্রদ্ধ করে তোলা।

৮. কোনো হাদীসের সম্ভাব্য একাধিক ব্যাখ্যার মধ্য হতে যেটিকে তারা নিজেরা প্রাধান্য দিয়েছেন সেটিকেই একমাত্র সহীহ ব্যাখ্যা বলা এবং তাদের মত গ্রহণ না করে দলীলের আলোকে সম্ভাব্য অপর ব্যাখ্যাটি গ্রহণ করার কারণে প্রতিপক্ষের উপর হাদীস অমান্য করার অপবাদ দেয়া। অথচ প্রতিপক্ষও যুক্তিসঙ্গত দলীলের ভিত্তিতে ভিন্ন আরেকটি ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করে প্রকারান্তরে এ হাদীসকেই গ্রহণ করছেন।

৯. সাহাবী ও তাবেয়ীর আসার বা তাঁদের আমল ও ফতোয়ার বিরুদ্ধে অসংযত ও অশালীন ভাষা ব্যবহার করা। যা মূলত সাহাবী ও তাবেঈগণের উপর থেকে উম্মতের আস্থা উঠিয়ে দেয়ার কাজ দেয়।

১০. প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার জন্য একই হাদীসকে একাধিক হাদীস বোঝানোর উদ্দেশ্যে কৌশলে বারবার উল্লেখ করা।

১১. দাবি ও দলীলের অসংগতি ও সামঞ্জস্যহীনতা- যা মূলত তাফাক্কুহ ফিদ্দীন ও হাদীস বুঝার ক্ষেত্রে লেখকের অযোগ্যতার প্রমাণ বহন করে।

১২. হাদীসের মারাত্মক ভুল তরজমা। যদি ইচ্ছাকৃত হয় তাহলে তো তা নবীজীর নামে জাল হাদীস রচনা করার শামিল। দ্বীনের ক্ষেত্রে এমন ব্যক্তির কথার উপর নির্ভর করা তো বৈধ হওয়ার প্রশ্নই আসে না। আর যদি অনিচ্ছায় হয়ে থাকে, তাহলে আহলে হাদীস ভাইরা সাবধান! এমন লোকের সাহায্যে হাদীস অনুসরণ মানে হল অনভিজ্ঞ নাবিকের জাহাযে সাগর পারি দিতে যাওয়া। যা আপনাকে সাগরেই ডুবিয়ে ছাড়বে। হাদীস অনুসরণের নামে সে যে আপনাকে কোথায় নিয়ে যাবে তা সে নিজেও জানে না। কারণ, সে সঠিক তরজমা করল, না ভুল তরজমা করল, তা সে নিজেই জানে না।

আর লেখকের আরবী ভাষাজ্ঞানের পরিধি নির্ণয়ের জন্য তার বইয়ের আরবী নামটির অশুদ্ধতাই যথেষ্ট। (লেখাটির ভূমিকায় যার প্রতি ইঙ্গিত করা হয়েছে।)

১৩. নাসীরুদ্দীন আলবানী সাহেবসহ (রাহ.) তাদের মতাদর্শী আলেমদের অন্ধ তাকলীদ।

১৪. হাদীস বর্ণনাকারীদের সম্পর্কে জারহ্-তা‘দীলের ইমামগণের বক্তব্য ও মন্তব্যের উদ্দেশ্যমূলক ভুল তরজমা, ভুল উপস্থাপন ও ভুল ব্যবহার। বিশেষত, যে বক্তব্য ও মন্তব্য মুহাদ্দিসগণের নিকট অগ্রহণযোগ্য বা যথাযথ নয়, সেগুলির উদ্দেশ্যমূলক ব্যবহার এবং অশালীন ভাষায় তরজমা করা। যা হাদীস বর্ণনাকারীদের প্রতি মানুষের আস্থা বিনষ্ট করে দেয়। এটা ইলমে দ্বীনের প্রতি জঘন্য হামলা ছাড়া আর কিছু নয়।

  পাঠকবৃন্দের নিকট অনুরোধ, আমার এই লেখাটির বাস্তবতা যাচাই করতে এটিকে সামনে নিয়ে হযরতের লেখাটি আবার পাঠ করুন। আর আমার জানা মতে ও দেখা মতে, মুযাফফর বিন মুহসিনের এ বইটির অন্যান্য অধ্যায়গুলোতে এ ধরনের সমস্যা আরো বেশি পরিমাণে হয়েছে। আশা করি, হযরত মাওলানা আবদুল গাফফার ছাহেবের আগামী লেখাগুলোতে বিষয়গুলো উঠে আসবে ইনশাআল্লাহ।

  মুযাফফর বিন মুহসিন সাহেবের বইটির সত্যাসত্য জানতে যিনি হযরতকে প্রশ্ন করেছিলেন সেই প্রশ্নকারী ও উত্তরদাতা উভয়কে আল্লাহ তাআলা জাযায়ে খায়র দান করুন। সিহ্হাত ও আফিয়াতের সাথে উত্তম ও দীর্ঘ জীবন দান করুন। আমীন! 

 

বিনীত

আবু আব্দুর রহমান তাহমীদুল মাওলা

তেজগাঁও, ঢাকা

 

 

advertisement