শাওয়াল ১৪৩৫   ||   আগস্ট ২০১৪

আমার আববাজান-৩

হযরত মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

পাহাড়পুর এমদাদুল উলূম ইসলামিয়া মাদরাসা

মাদরাসাই যেন ছিল আববাজানের যিন্দেগীর একমাত্র ধ্যানখেয়াল। আখেরাত অর্জনের লাভজনক উৎস হিসেবে আববাজান মাদরাসাকেই বেছে নিয়েছিলেন। আববা মনে করতেন, মাদরাসা হল ব্যবসাকেন্দ্র। আখেরাতের ব্যবসা এখান থেকেই করতে হয়। এ চিন্তা থেকেই আববা মাঝেমধ্যেই ঘরের আসবাবপত্র মাদরাসায় নিয়ে লাগিয়ে দিতেন। আমাদের বাড়ির ধান চাল রাখার যে জায়গাটা ছিল তার উপর একটা টিনের ছাউনি ছিল। একদিন আম্মা দেখলেন টিনের ছাউনিটা নাই। আম্মা পেরেশান হয়ে টিনটা তালাশ করতে থাকলেন। আববা তো বুঝে ফেললেন, আম্মা কী খুঁজছেন। আববা বললেন, টিনটা আমি এক জায়গায় জমা দিয়ে এসেছি। সেখানে একটা জমা দিলে দশটা পাওয়া যায়। আম্মা যা বুঝার বুঝে নিলেন এবং তৃপ্তির হাসি হাসলেন।

জীবনভর আববা যা কিছু করেছেন সবই মাদরাসার জন্য। নিজের জন্য এক খন্ড জায়গাও তিনি কোনোদিন ক্রয় করেননি। আমার দাদা মুুন্সি আব্দুল জলীল সাহেবকে পাহাড়পুরেরই এক লোক এক খন্ড জায়গা দিয়েছিল। সেখান থেকে দাদা আববাজানকে কিছু জায়গা দিয়েছিলেন। আববার নিজস্ব সম্পত্তি বলতে তখন ওটাই। পাহাড়পুর মাদরাসা সংলগ্ন জায়গা। মাদরাসার পুকুর কাটার সময় আববা তাঁর একমাত্র সম্বল সেই জায়গাটাও মাদরাসায় দান করে দিয়ে পুকুরের মধ্যে নিয়ে এলেন।  

আববাজানের যিন্দেগীর এ দিকটি আমরা যারা পাহাড়পুর মাদরাসায় পড়তাম আমাদের মধ্যেও প্রভাব বিস্তার করেছিল। মাদরাসার প্রতি এবং মাদরাসার যেকোনো কাজের প্রতি আমাদের মনে মুহববত ও আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। যার ফলে আমাদের হাত দিয়েও পাহাড়পুর মাদরাসার এমন কিছু কাজ সংঘটিত হয়েছিল যা আববার মত ব্যক্তিত্বের অনুপস্থিতিতে কিছুতেই সম্ভব ছিল না। অন্তত আমার এমনটাই

মনে হয়।

পাহাড়পুর মাদরাসা যখন পুকুরের পশ্চিমে ঈদগাহ ময়দানে ছিল, মাদরাসার একটা ঘর উঠানোর প্রয়োজন দেখা দিল। ঘর তোলার সব সরঞ্জাম তৈরি। এখন দরকার মাটি কাটা, মাটি টানা ও ঘর তোলার লোক। মিস্ত্রি লাগিয়ে কাজ করলে ঘরটি তুলতে সময় লাগবে কমসে কম টানা পনেরো দিন। অথচ ঘরটি তোলা দরকার খুব অল্প সময়ের মধ্যেই। আমরা ছাত্ররা সব এক হলাম। আমাদের উস্তায মাওলানা রুকনুদ্দীন ছাহেবের নেতৃত্বে আমরা ছাত্ররাই ঘর তোলার কাজে নেমে পড়লাম। এশার নামাযের পর কাজ শুরু হল। আমরা তিনটি দলে বিভক্ত হলাম। একটি গরু কেনা হল। একটি দল গরু জবাই ও রান্নার কাজে লেগে গেল। আরেক দল মাটি কেটে মাটি ভরাট করার কাজে লাগল। অপর দলটি বাঁশ কেটে ঘর তৈরি করার কাজে নিয়োজিত হল। মনে পড়ে আমাদের কাজে উৎসাহ দেওয়ার জন্য আমাদের উস্তায রুকনুদ্দীন ছাহেব ব্যতিক্রমী পদ্ধতি অবলম্বন করলেন। শরহে মিআতে আমেলের পংক্তিগুলো তিনি সুর করে করে পড়ছিলেন আর আমরা সমবেতভাবে পরম উৎসাহে কাজ করে যাচ্ছিলাম। এভাবে কখন যে ফজরের সময় হয়ে গেল এবং আমাদের কাজও শেষ হল আমরা টেরও পেলাম না। এদিকে ঘর নির্মাণও সমাপ্ত হল ওদিকে ভাত গোস্ত রান্নাও শেষ হল। আমরা গোসল করলাম। লম্বা দস্তরখান বিছানো হল। পেট ভরে পরম তৃপ্তির সাথে খানা খেলাম। এরপর ফজরের নামায পড়ে লম্বা ঘুম দিলাম। এক রাতেই এতবড় একটা কাজ শুরু করা এবং শেষ করা সহজ ব্যাপার ছিল না। তবুও আমাদের ছাত্রদের পক্ষে এ কাজ সম্ভব হয়েছিল আববাজানের মত মানুষের যিন্দেগী থেকে নেওয়া শিক্ষার বদৌলতেই। এতে মাদরাসার খরচ কতটা বেচে গেল এবং আমরা ইহকাল ও পরকালে কতইনা লাভবান হলাম।

আলহামদুলিল্লাহ এটা আমাদের জন্য এক পরম সৌভাগ্য ছিল। আববাজানের মত ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্য আমরা পেয়েছিলাম, যারা বলার চেয়ে করতেই বেশি ভালবাসতেন। আববাজানের যিন্দেগীর প্রত্যেকটি কথা ও কাজ তাঁর আমলের দ্বারা সুসজ্জিত ছিল। সেটা দুনিয়াবী বিষয়ে হোক আর আখেরাতের বিষয়েই  হোক। তাই আববাজানের অন্যরকম একটা আনন্দ অনুভব হত। অনেক সময় আমরা আববাজানের নির্দেশের অপেক্ষায় থাকতাম। আববাজানের নির্দেশে কষ্ট করতে আমাদের তীব্র আনন্দ হত।

পাহাড়পুরে একবার বন্যা হল। বন্যার পানিতে আমাদের নির্মাণ করা এ ঘরটি তলিয়ে গেল। আমরা ভীষণ দুশ্চিন্তায় পড়লাম। আববা নির্দেশ দিলেন মুলি বাশ ফেড়ে মাচা তৈরি কর। ঘরের ভিতর কোমর পানি। এর উপর মুলির মাচা তৈরি হল। বন্যার পুরো সময়টা এই মাচার উপরই মহা সমারোহে চলত আমাদের পড়াশোনা ও পাঞ্জেগানা নামায।

সেইসব দিনের কথা এখনো কেমন

জীবন্ত। মনে হয় এই তো সেদিনের কথা। চারিদিকে থৈথৈ পানি। মাঝখানে এতগুলো মানুষ আমরা আমাদের কাজগুলো কত স্বাচ্ছন্দ্যেই না চালিয়ে যাচ্ছি। জীবন যদি কোনো যুদ্ধের নাম হয় এ যুদ্ধে আববা কোনোদিন পরাজিত হননি। আববার চারপাশে আমরা যারা ছিলাম আমাদেরকেও আববা পরাজিত হতে দেননি।

পাহাড়পুর মাদরাসার উপর দিয়ে ঝড় তুফান তো কম আসেনি। কিন্তু একজন মানুষ এখানে ছিলেন যিনি পাহাড় ছিলেন। বাতাসের প্রচন্ড ঝাপটা এখানে এসে গতি হারাতো। পাহাড়সম ঢেউ এখানে এসে আছড়ে পড়ত। ঈমান আমল তাকওয়া তাহারাত এখলাস ও একনিষ্ঠতার মজবুত ভিতের উপর দাঁড়িয়ে তিনি পাহাড়পুর মাদরাসাকে জীবনভর আগলে রেখেছেন। আল্লাহ রাববুল আলামীনও তাঁর মাহবুব বান্দাকে জীবনে বহুবার অচিন্তনীয় অলৌকিকতায় হেফাযত করেছেন।

৭১-এর যুদ্ধের সময় কিছু দুষ্ট লোক আববাকে হত্যা করার ষড়যন্ত্র করল। এরা সমস্ত কৌশল ঠিকঠাক করে আববাকে হত্যা করার জন্য খুব ভোরে তৈরি হল। আববা তখন মাদরাসার কামরায় ঘুমিয়ে ছিলেন। মাথার কাছে খোলা জানালা। চারিদিকে সুনসান নিরবতা। ঘাতক দলটি নিরবে পা টিপেটিপে জানালার সামনে এসে দাঁড়ালো। আববার দিকে বন্দুক তাক করল। দুয়েক সেকেন্ডের কাজ। এমন সময় আববার চোখ খুলে গেল। আববার চোখ খোলার সাথে সাথে তাদের হাত-পা থরথর করে কাঁপতে শুরু করল। কোত্থেকে যেন একটা ভয় এসে তাদেরকে ঘিরে ধরল। কাঁপতে কাঁপতে তাদের হাত থেকে অস্ত্র পড়ে গেল। এরা দৌড়ে পালালো। অনেক বছর পর এই ছেলেগুলো আববাজানের কাছে এসে এ ঘটনা স্বীকার করে ক্ষমা চেয়েছিল। আববা তাদেরকে ক্ষমা করে দিয়েছিলেন।     

হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর ডাকে তখন খেলাফত আন্দোলনের কাজ সারাদেশে ব্যাপক ও বিশাল আকারে চলছিল। কুমিল্লা জেলায় খেলাফত আন্দোলনের যিম্মাদার ছিলেন আমার আববাজান। একবার হাফেজ্জী হুযুর রাহ. পাহাড়পুর তাশরীফ রাখলেন। সেই সফরে হযরতের সাথে আমি ছিলাম। মাওলানা ফযলুল হক আমিনী ছাহেবও (রাহ.) ছিলেন। হাফেজ্জী হুযুর আববাজানকে প্রশ্ন করলেন, আপনার এখানে খেলাফতের কাজ কেমন চলছে? আববাজান বললেন, আলহামদুলিল্লাহ খুব ভালো চলছে। হাফেজ্জী হুযুর রাহ. তখন খুব খুশী হলেন এবং হঠাৎ করেই বলে উঠলেন, খেলাফতের কাজ ভালো চলছে! আচ্ছা, আমি আপনাকে খেলাফত দিয়ে দিলাম। হযরতের যবানে আকস্মিক এ কথা শুনে আববা একেবারে খামুশ হয়ে গেলেন। হাফেজ্জী হুযুর বললেন, কী, কিছু বললেন না তো, কবূল করলেন কি করলেন না? আববাজান বললেন, আমি নিজেকে তো লায়েক মনে করি না, হযরতের সঙ্গে রূহানী নিসবতের আশায় কবূল করলাম।

হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর সাথে আববাজানের এক পরম হৃদ্যতাপূর্ণ সম্পর্ক ছিল। একদিন হাফেজ্জী হুযুর রাহ. আমাকে বললেন, মৌলভী আবদুল হাই, আপনি কি জানেন লালবাগ মাদরাসার প্রথম মুহতামিম কে? আমি বললাম, না হযরত আমি তো জানি না। হাফেজ্জী হুযুর রাহ. তখন হেসে জবাব দিলেন, আপনার আববাজান। আপনার আববাজান ছিলেন লালবাগ মাদরাসার প্রথম মুহতামিম। আমি শুনে বেশ অবাক হলাম। এই কথা তো আগে কোনো দিন শুনিনি। হাফেজ্জী হুযুর রাহ. জানালেন, আববা যখন বড় কাটারা মাদরাসায় শিক্ষকতা করেন, তখন একদিন হাফেজ্জী হুযুর আববাকে বললেন, আপনি তো বড় কাটারায় দিনের বেলা পড়ান, রাতের সময়টা আপনি আমার সঙ্গে লালবাগ মাদরাসায় সময় দেন। তখন লালবাগ মাদরাসার একেবারে প্রথম অবস্থা। তখনও জামেয়া হয়নি। শুধু মাদরাসা ছিল। মকতব, হেফযখানা ও প্রাথমিক কয়েকটি শ্রেণী ছিল। তখন থেকে আববা সারাদিন বড় কাটারা মাদরাসায় খেদমত করার পর রাতে হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর সাথে লালবাগ মাদরাসায় চলে আসতেন। মাদরাসার যাবতীয় যিম্মাদারী হযরত হাফেজ্জী হযুর আববাজানের উপরই ন্যস্ত করে দিয়েছিলেন।

এ বিষয়টাকেই হাফেজ্জী হুযুর আমার কাছে এভাবে ব্যক্ত করলেন। পরে আববাজানকে আমি একদিন বললাম, আববা! আপনি নাকি লালবাগ মাদরাসার প্রথম মুহতামিম? আববা আমার দিকে বিস্ময়ের নযরে তাকালেন এবং বললেন, তোমাকে এ কথা কে বলল? আমি বললাম, হাফেজ্জী হুযুর বলেছেন। আববা তখন আমার দিকে এমনভাবে তাকালেন যেন বিষয়টা জেনে ফেলে আমি বড় কোনো অন্যায় করে ফেলেছি। আমার আববাজান এমনই ছিলেন। নিজেকে লুকিয়েই যেন তিনি আনন্দ পেতেন। প্রকৃতই তিনি নিজেকে প্রকাশ করার যোগ্য মনে করতেন না। প্রকৃত তাওয়াযু তো একেই বলে।

বড় কাটারা মাদরাসায় পড়ানোর যমানা থেকেই আববাজানের প্রতি হযরত হাফেজ্জী হুযুরের মুহববতের সম্পর্কের শুরু। এ সম্পর্কের সূত্র ধরেই হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর সাথে আমার আত্মিক ও পারিবারিক বন্ধন। আমি পাহাড়পুর মাদরাসায় জালালাইন জামাত পর্যন্ত পড়লাম। তারপর আববাজানের কাছে আমার মনের ইচ্ছা ব্যক্ত করলাম, আমার ঢাকায় লালবাগ মাদরাসায় পড়ার খেয়াল। আববা বললেন, হাফেজ্জী হুযুরের সাথে যদি পুরোপুরি সম্পর্ক রেখে চলতে পার তাহলে ঢাকা যাও। আর নয়ত তুমি হাটহাজারী মাদরাসায় ভর্তি হও।

আববাজানের নির্দেশে ঢাকায় এসেই আমি প্রথম যে কাজটি করলাম তা হল, আমি নিজেকে পুরোপুরি হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-এর হাতে সঁপে দিলাম। আমার যিন্দেগীর রাহবার ও পথপ্রদর্শক বানিয়ে নিলাম হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ.- কে। এখান থেকে শুরু হয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস, যার কিছু অংশ হাফেজ্জী হুযুর রাহ. স্মারক গ্রন্থে আমি উল্লেখ করেছি। আমার দিলের একান্ত তামান্না, হাফেজ্জী হুযুর রাহ.-কে আমি যেমন দেখেছি,  কাগজের পাতায় তার একটা পরিষ্কার চিত্র যদি আমি এঁকে যেতে পারতাম।

সুদীর্ঘ আঠার বছর হযরত হাফেজ্জী হুযুরের কদমের নিচে কাটানোর তাওফিক আল্লাহ তাআলা আমাকে দিয়েছিলেন। এ দীর্ঘ সফরে হযরত হাফেজ্জী হুযুরকে দেখার, বোঝার ও হৃদয় দিয়ে অনুভব করার সুযোগ আমার হয়েছিল। আমার যিন্দেগীর এ এক অমূল্য নেয়ামত। আমার আববার মত এমন একজন পিতা যদি আমি না পেতাম তাহলে হযরত হাফেজ্জী হুযুর পাওয়া আমার পক্ষে সম্ভব হত কি না আমি জানি না। আমার যিন্দেগীর এ মহা সৌভাগ্য লাভের পিছনে একমাত্র অবদান আমার আববাজানের। একেই বলে পিতৃত্বের মহান দান। সন্তানের প্রতি জন্মদাতার মহা অনুগ্রহ। আমি এখন ভাবি, যদি আমার যিন্দেগীতে হাফেজ্জী হুযুরের ছায়া না থাকত, যদি আমার অস্তিত্বের মাঝে হাফেজ্জী হুযুর নামে কোনো ব্যক্তির উপস্থিতি না থাকত, তাহলে আমি আজ কোথায় থাকতাম। আববা আমাকে যখন হাফেজ্জী হুযুরের কাছে পাঠিয়েছিলেন তখন কি আমার বয়স হয়েছিল হাফেজ্জী হুযুর চেনার? একজন খালেস ও মুখলেস আল্লাহওয়ালাকে চেনার যোগ্যতা কি তখন আমার মধ্যে তৈরি হয়েছিল? আববাজান যদি তখন আমাকে আমার একক সিদ্ধান্তের উপর ছেড়ে দিতেন তাহলে আজ আমি নিজেকে কোন পরিচয়ে পরিচিত করতাম? আজ আমি কতই না আনন্দের সাথে একথা ভাবতে পারি যে, আমার একজন হাফেজ্জী হুযুর ছিলেন। আমি হাফেজ্জী হুযুরের কদমের নিচে সময় কাটানোর সুযোগ পেয়েছি। আমি হাফেজ্জী হুযুরের দুআ পেয়েছি। আমি হাফেজ্জী হুযুরের সেণহ পেয়েছি। আমি এখন বলতে পারি হযরত হাফেজ্জী হুযুর আমাকে কাছে টেনেছেন, বুকে জড়িয়েছেন। হাফেজ্জী হুযুর আমাকে অমুক কথা বলেছেন, হাফেজ্জী হুযুর আমাকে অমুক কাজের নির্দেশ দিয়েছেন, আমি অমুক কাজটা হাফেজ্জী হুযুরের নির্দেশে করেছি। অমুক কাজটা আমার করতে ইচ্ছা হয়েছে, কিন্তু হাফেজ্জী হুযুর নিষেধ করেছেন, তাই করিনি। আমার জীবনের সকল অঙ্গনে আমি কেমন গর্ব করে বলতে পারি, আমার এ সিদ্ধান্ত হযরতের ইচ্ছায় হয়েছে। আমি কেমন আনন্দ চিত্তে বারবার হাফেজ্জী হুযুর নামটি উচ্চারণ করতে পারি। আমার জীবনের এ এক অমূল্য পাওনা। এক পরম সান্ত্বনা।

আমি যতবার হাফেজ্জী হুযুর নামটি উচ্চারণ করি, মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি হাফেজ্জী হুযুর হলেন আমাকে আমার আববাজানের দেওয়া সেরা উপহার। পিতার পথপ্রদর্শন ছাড়া সন্তানের বড় কিছু প্রাপ্তি সহজ নয়। আমার জীবনের যে সময়টাকে আমি মনে করি পরিবর্তনের সময়, যেকোনো কিছুতেই প্রভাবিত হওয়ার সময়, ঠিক সেই সময়টিতেই আমার আববাজান আমাকে হযরত হাফেজ্জী হুযুরের হাতে তুলে দিয়েছিলেন। এখন আমার মনে হযরত হাফেজ্জী হুযুরের সান্নিধ্য প্রাপ্তির যত গর্ব ও আনন্দ তার পুরোটাই তো আমার আববাজানের দান।

উজানীর কারী ইবরাহীম ছাহেব রাহ. ঘোড়ায় চড়ে পাহাড়পুর এলেন। এখন যেখানে পাহাড়পুর মাদরাসা এ জায়গাটায় এসে ঘোড়া থামালেন। জায়গাটা দেখে তিনি বললেন, আমি এখানে ইলমের গন্ধ পাচ্ছি। আববা তখন বড় কাটারা মাদরাসায় পড়ান। মাওলানা আলতাফ সাহেব রাহ. আববাজানের সাথে পরামর্শ করলেন, এখানে তো দ্রুত মাদরাসার কার্যক্রম শুরু করা দরকার। আববাজান বললেন, পীরজি হুযুর অনুমতি না দিলে তো আমি বড় কাটারা ছেড়ে আসতে পারি না। আববা পীরজি হুযুরকে বিষয়টা জানালেন। হুযুর শুনে খুব খুশি হলেন এবং আববাকে এ কথা বলে খুশি মনে অনুমতি দিলেন, শহরের নামকরা মাদরাসায় পড়ানোর থেকে গ্রামে দ্বীনের খেদমতের এখন বেশী প্রয়োজন। তুমি গ্রামে গিয়েই দ্বীনের খেদমত কর।

শুরু হল আববাজানের পাহাড়পুর মাদরাসায় দ্বীনি খেদমত। নাম যশ খ্যাতি, শহরের মাদরাসায় পড়ালে সবকিছুই আববাজান অর্জন করতে পারতেন। শুধু শহর বলেই কথা না, আববাজানকে আল্লাহ তাআলা যে বহুমুখী যোগ্যতা দান করেছিলেন, শহর ও শহরের প্রতিষ্ঠানই ছিল সেইসব প্রতিভা বিকাশের বিস্তৃত ময়দান।  একমাত্র আল্লাহ তাআলার রেযামন্দীর উদ্দেশ্যেই আববাজান এই ত্যাগ স্বীকার করেছেন। এটা কুরবানী। এই কুরবানীর হাকিকত সবাই বোঝে না। একে বলে প্রতিভার কুরবানী। ইখলাস ও লিল্লাহিয়্যাতের শক্তিতে আববা বলিয়ান ছিলেন। এই শক্তি ছাড়া কুরবানী সম্ভব না। বড় কাটারা মাদরাসা তখন দেশের মধ্যে নামকরা মাদরাসা। পীরজি হুযুর, হাফেজ্জী হুযুর ও সদর সাহেব হুযুরের মত বড় বড় ব্যাক্তিত্ব সেখানে উপস্থিত। এমন একটি জায়গায় শিক্ষকতা করার সুযোগ পাওয়া ভাগ্যের কথা। উপরন্তু আববাজান এই তিন বুযুর্গের বিশেষ মুহববতের পাত্র ছিলেন। বড় কাটারা মাদরাসার তখনকার তালিবে ইলমদের কাছেও আববার সীমাহীন কদর ছিল। নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার একটা সুবর্ণ সুযোগ ছিল আববার সামনে। ওয়াজ নসীহত, পীর মুরীদি কিংবা সামাজিক নেতৃত্ব, যে কোনো অঙ্গনেই এক অনন্য উচ্চতায় পৌঁছার যোগ্যতা আববাজানের মধ্যে পুরোমাত্রায় বিদ্যমান ছিল। নিঃসন্দেহে সেটাও হত খালেস দ্বীনি খেদমত। সেখানেও নিজের যশখ্যাতির দিকে আববার কখনো নযর যেত না। সমাজের ব্যাপক কল্যাণ হত। আরো ব্যাপক আকারে দ্বীনের খেদমত করা সম্ভব হত। সবই হত। কিন্তু গ্রাম? গ্রামের মধ্যেও যে ব্যাপক আকারে দ্বীনী মারকায কায়েম হওয়া দরকার, এই দরকারটা কার দ্বারা পুরা হবে? আববা নিজেকে বিলীন করলেন। এইযে আমি বারবার বিলীন করার কথা বলছি, আমার বিশ্বাস, আববাজানের মধ্যে এই চিন্তাটাও আসেনি যে, তিনি নিজেকে বিলীন করছেন। বরং এইসব চিন্তা থেকে আববাজানের অন্তরের অবস্থান এত উর্ধ্বে ছিল যার নাগাল পাওয়া আমাদের পক্ষে সম্ভব না। চূড়ান্ত লক্ষ্য যাদের একমাত্র মাওলায়ে পাকের রেযামন্দী তাদের মধ্যে ত্যাগের অনুভূতি তৈরি হয় না। তাদের চিন্তায় একটাই বিষয়, রেযায়ে মাওলার পথে আমার কতটুকু পথচলা হল। আল্লাহ পাকের সন্তুষ্টি আমার কতটুকু অর্জিত হল। রেযায়ে মাওলার জন্য যেখানে জীবন পর্যন্ত উৎসর্গ করেও তৃপ্তি হয় না, বারবার উৎসর্গিত হতে ইচ্ছা করে, সেখানে এই ত্যাগ তো কোনো ত্যাগই না। তাফবীযতাসলীমের এ এমন এক মাকাম, আল্লাহ তাআলার বিশেষ মেহেরবানী ছাড়া যেখানে পৌঁছানো কোনোদিনও সম্ভব না। দৃষ্টি ও দৃষ্টিভঙ্গির এ এমন উচ্চতা যেখানে সবাই পৌঁছতে পারে না। যারা পারেন তারা সন্দেহ নাই আল্লাহ তাআলার বিশেষ বান্দা।

আমার আববাজান রাহ. দ্বীনের খেদমতে  নিজেকে এতটাই নিমগ্ন করতে পেরেছিলেন যে, আববাজানের কাছে  আপন অস্তিত্ব বলতে কিছু ছিল না। দ্বীনের খেদমতে আববা আক্ষরিক অর্থেই নিজেকে বিলীন করতে পেরেছিলেন। দুনিয়ার যিন্দেগীর প্রয়োজনে যতটুকু না হলেই নয়, আববা আজীবন তার উপরই সন্তুষ্ট থেকেছেন। যুহদ ও দুনিয়াবিমুখতার এক অনন্য উদাহরণ ছিলেন আমার আববাজান। আববার মৃত্যুর সময় আববার নিজস্ব সম্পত্তি বলতে কিছুই ছিল না। নিজের জন্য একখন্ড জমি কেনার চিন্তাও আববা কোনোদিন করেননি। পাহাড়পুরে আমরা যে জায়গাটায় থাকতাম এ জায়গাটাও কুদরতীভাবে আল্লাহ তাআলা আমাদের জন্য ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। আমার নানাজান আববাজানকে ছোট্ট এক খন্ড জায়গা দিয়েছিলেন। জায়গাটা ছিল ধামতিতে, নানার বাড়ির কাছে। আমরা থাকি পাহাড়পুর গ্রামে। ধামতিতে আববাজানের জায়গাটা কোনো কাজে লাগানোর মত সুযোগ ছিল না। পরে নানাজান নিজেই সেই জায়গাটা আববাজানের কাছ থেকে কিনে নিয়েছেন। সেই টাকা দিয়ে আববাজানকে পাহাড়পুরে একটা জায়গা কিনে দিয়েছেন। জায়গাটা পাহাড়পুর মাদরাসা থেকে বেশ খানিকটা দূরে ছিল। আমরা তখন দাদার বাড়িতে থাকতাম। পাহাড়পুর মাদরাসা থেকে দাদার বাড়ি কমছে কম আধ ঘণ্টার পথ। আববাতো সবসময় মাদরাসায় থাকতেন। মাঝেমধ্যে বাড়িতে আসতেন। একদিন আম্মা আমাকে বললেন, বাবা, তোর আববা তো সবসময় মাদরাসায় পড়ে থাকে। বাড়িটা যদি মাদরাসার কাছাকাছি হত তোর আববার খেদমত করার সুযোগ পেতাম। আম্মার কথাটা আমার দিলে দাগ কাটল। আমি আববার কাছে এসে পরামর্শ করলাম। আববাকে বললাম, মাদরাসার উত্তর দিকের জমিটা যদি আমরা রাখতে পারি খুব সুন্দর হয়। আববা সম্মতি দিলেন। আমি তখন আববার অনুমতি নিয়ে পাশের জমিনওয়ালার সাথে কথা বললাম।

পাহাড়পুর মাদরাসা থেকে দূরে আববার যে জায়গাটা আছে আমি তাকে বললাম, আপনি সেই জমিনটার বদলে আপনার এই জমিনটা আববাজানকে দিয়ে দিন। লোকটা খুশি মনে রাজি হয়ে গেল। এভাবে জায়গা বদল করে নতুন জায়গায় আমাদের ঘর তোলা হল। এভাবেই হল। সবটাই আল্লাহ তাআলার খাস মেহেরবানী। আববা ব্যস্ত ছিলেন আল্লাহর দ্বীনের খালেস খেদমতে। আববার দুনিয়ার প্রয়োজন আল্লাহ তাআলা এভাবেই পুরা করে দিলেন।

আল্লাহ তাআলা যার জন্য দুনিয়ার যতটুকু অংশের ফায়সালা করে রেখেছেন তার জন্য দুনিয়া ততটুকুই হবে। দুনিয়া অর্জনের প্রতি উচ্চাকাঙ্খা, দুনিয়া নিয়ে নিদারুন ব্যস্ততা কারো দুনিয়ার অংশকে বাড়িয়ে দিতে পারে না। আববা দ্বীন নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন। আববার দুনিয়ার যা কিছু প্রয়োজন আল্লাহ গায়েব থেকেই ইন্তেজাম করে দিয়েছেন। আববা তো আববার মাদরাসা নিয়েই পড়ে ছিলেন। কিন্তু আমাদের ভবিষ্যত আল্লাহ তাআলাই গড়ে দিয়েছেন। সন্তানদের ভবিষ্যতের চিন্তা দুনিয়ার সমস্ত পিতা মাতার যিন্দেগীর সবচেয়ে বড় চিন্তা। আববা আমাদের ভবিষ্যত বলতে বুঝেছিলেন আখেরাত। দুনিয়াকে আববা কখনো ভবিষ্যত হিসেবে কল্পনা করেননি। আমাদের আখেরাত নির্মাণের চিন্তা আববা করেছেন। আববার সমস্ত দৌড়ঝাঁপ সেজন্যই ছিল।

নবীজীর হাদীস

من جعل الهموم هما واحدا هم آخرته كفاه الله هم دنياه

যে ব্যক্তি তার সমস্ত চিন্তা ও পরিকল্পনার কেন্দ্রবিন্দু আখেরাতকে বানাবে, তার দুনিয়ার চিন্তার জন্য আল্লাহ তাআলাই যথেষ্ট হয়ে যাবেন। (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদীস : ২৫৭; মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা, হাদীস : ৩৪৩১৩; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস : ১৭৪৪)

নবীজির এই হাদীস আববাজানের যিন্দেগীর মৌলিক আদর্শ ছিল। আববাজানের এ আদর্শের সুফল আমরা জীবনভর লাভ করেছি। আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি, আমার দ্বীনী যিন্দেগীর পাশাপাশি আল্লাহপাক দুনিয়ার সামান যা কিছু আমাকে দিয়েছেন, এর পুরোটাই নবীজীর এ হাদীসেরই বহিঃপ্রকাশ এবং সুন্নতে নববীর চেতনায় আববাজানের প্রেরণায় উজ্জীবিত হওয়ারই বাস্তব ফলাফল।

আববাজানের এ আখিরাতমুখিতা আমাদের মধ্যে তৈরি করেছিল আল্লাহ তাআলার উপর অফুরন্ত তাওয়াক্কুল। যিন্দেগীতে তাই আমাদের কখনো মানুষের মুহতাজ হতে হয়নি। হযরত হাফেজ্জী হুযুর রাহ. একদিন আমাকে বললেন, মৌলভী আবদুল হাই! আপনার তো নিজস্ব কোনো জমিন নেই। আপনি একটা জমিন কিনে রাখেন। পরে কাজে লাগবে। আমি বললাম, হযরত, আমার তো জমিন কেনার মোটেও সামর্থ্য নাই। হযরত বললেন, আপনি জমিন দেখেন। দেখে আমাকে জানান। আমি জমিন দেখলাম। দেখে হযরতকে জানালাম। হযরত নিজে সেই জমিনে এলেন। কিছুক্ষণ সেখানে হাটাহাটি করলেন। এরপর বললেন, হাঁ, এই জমিনটা নিতে পারেন। বরকত হবে ইনশাআল্লাহ।

হযরত আমাকে দশ হাজার টাকা করজ দিলেন। বললেন, আপনি এখন এটা কাজে লাগান। পরে আমাকে শোধ করে দিয়েন। আমি হযরতের কাছ থেকে দশ হাজার টাকা করজ নিলাম। হযরত নিজে জমিনের মালিককে ডাকালেন। হযরতের নির্দেশে জমিনওয়ালা নিজেই সমস্ত কাগজপত্র দলিল-টলিল করে হযরতের হাতে পৌঁছে দিয়ে গেল। কয়েক বছর পরই আমি জমিনটার কিছু অংশ বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে নূরিয়া মাদরাসার পাশে আরেকটা জমিন কিনলাম এবং হযরতের দশ হাজার টাকা করজও পরিশোধ করলাম। হযরত সেখান থেকে আবার আমাকে দুই হাজার টাকা হাদিয়াও দিয়ে দিলেন। পরবর্তীতে আমার যখন কামরাঙ্গীরচর ছেড়ে আসার বাধ্যবাধকতা তৈরি হল, নূরিয়া মাদরাসার পাশের জমিনটা বিক্রি করে মিরপুরে একটা বাড়ি কিনলাম। নূরিয়া মাদরাসার পাশে আমার বিবির কিছু জায়গা আছে। সেখানে ঘর তোলার প্রয়োজন হল। হাফেজ্জী হুযুরের নির্দেশে কেনা সেই জায়গাটা বিক্রি করে বিবির জায়গায় ঘর তুললাম। এখন যেখানে থাকি সেই ঘরটা। আমি এখন চিন্তা করি আমাকে আল্লাহ তাআলা এই যে দুনিয়ার সামান এতকিছু দান করলেন, এই সবকিছুই আমার আববাজানের যুহদ ও দুনিয়াবিমুখতার ফলেই আল্লাহ তাআলা নিজ দায়িত্বে করে দিয়েছেন।

আববাজান তার সন্তানের আখেরাত নির্মাণের ফিকির করেছেন

كفاه الله هم دنياه

আল্লাহ তাআলা তার সন্তানদের দুনিয়ার জরুরতগুলোও গায়েব থেকে ইন্তেজাম করে দিয়েছেন।

দুআ ছিল আববাজানের একটি চিরন্তন অভ্যাস। যেকোনো সমস্যায় আববা নামাযে দাঁড়িয়ে যেতেন। নামাযের মধ্যেই সমস্যার সমাধান তালাশ করতেন।  আববার এক আজীব হায়আত ছিল দুআর। আববা ভোর রাতে তাহাজ্জুদের পর যখন দুআ করতেন, প্রথমে হাত তুলে দুআ করতে থাকতেন। এভাবে দীর্ঘক্ষণ হাত তুলে কান্নাকাটি করতে থাকতেন। কাঁদতে কাঁদতে সামনের দিকে ঝুকে যেতেন। ঝুঁকতে ঝুকতে আববা একপর্যায়ে সেজদায় চলে যেতেন। সেজদায় গিয়ে আরো বেশি রোনাজারি করতে থাকতেন। আববাজানের দুআর এ আজীব হায়আতের কথা আমাকে শুনিয়েছিলেন পাহাড়পুর সরকার বাড়ির সাআদাত সরকার সাহেব। আববার থেকে বয়সে অনেক ছোট ছিলেন। পাহাড়পুর মাদরাসার যখন প্রাথমিক অবস্থা আববা তখন মাঝেমাঝে মাদরাসা থেকে কিছু দূর পশ্চিমে অবস্থিত এই সরকার বাড়িতে রাতে থাকতেন। সাআদাত সরকার আমাকে একদিন বললেন, একদিন আমার আগ্রহ হল হুযুরের গভীর রাতের ইবাদত দেখব। একদিন রাতে হুযুর আমাদের বাড়িতে ছিলেন। আমি হুযুরের ইবাদত দেখার বাসনায় রাতের শেষ প্রহরে উঠে গেলাম। হুযুর ছিলেন কাছারি ঘরে। আমি কাছারি ঘরে গেলাম। এক কোণে দাঁড়িয়ে নিরবে হুযুরের ইবাদত বন্দেগী মনভরে দেখতে থাকলাম। একসময় দেখলাম, হুযুর মুনাজাত শুরু করেছেন। কিছুক্ষণ দুহাত তুলে মুনাজাত করলেন। তারপর পরম কাকুতি মিনতির সাথে আল্লাহ তাআলার কাছে কী যেন চাইতে থাকলেন। তারপর দেখলাম, একটা শিশু বাচ্চা যেমন মা বাবার কাছে কোনো কিছু আবদার করতে করতে একসময় শুয়ে পড়ে কাঁদতে থাকে, ঠিক সেরকম হুযুরও কিছুক্ষণ দুহাত তুলে মুনাজাত করার পর সেজদায় লুটিয়ে পড়ে মাসুম বাচ্চার মত কাঁদতে থাকলেন।

তাহাজ্জুদের আদত আববাজানের সেই ছাত্র যামানা থেকেই। মুহাদ্দিস সাঈদ আহমদ ছাহেবের বাড়িতে যখন থাকতেন, আববা সবসময় চেষ্টা করতেন মুহাদ্দিস ছাহেব হুযুরের আগে উঠার। কিন্তু আববা যখনই জাগতেন দেখতেন, মুহাদ্দিস ছাহেব দুআ ও মুনাজাতে ব্যস্ত আছেন। সেখান থেকেই হয়ত আববাজানের দুআর প্রতি এমন অনন্ত টান। আল্লাহই যে বান্দার একমাত্র আশ্রয় -আববাজান এ বিশ্বাসের তীব্র অনুভূতি হয়ত সেখান থেকেই লাভ করেছিলেন।

আববা যখন বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছেন তখনও আববার দুআর এ আজীব কাইফিয়্যত বাকি ছিল। তখন আববাকে দেখে মনে হত জগৎ সংসারের সাথে এ মানুষটির কোনোই সম্পর্ক নাই। দুআর সময়টা আববা অন্য এক জগতের বাসিন্দা হয়ে যেতেন। কোনো এক অসীম শক্তির টানে আববা কোনো অজানা জগতে হারিয়ে যেতেন। অনেক অনেক্ষণ পর আববা যখন দুআ শেষ করতেন, আববার মুখমন্ডলে আসমানী দ্যুতি ঝলমল করে উঠত। তখন যারা তাঁকে দেখত, তারাও হৃদয় মনে পবিত্রতার সিণগ্ধ পরশ অনুভব করত। আল্লাহ রাববুল আলামীনের শানে রহমত শানে মাগফেরাতের এক বিস্ময়কর প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠত আববাজানের চেহারায়।

আববাজানকে দেখলে নবীজির সেই হাদীস মনে পড়ত,

الذين إذا رؤوا ذكر الله

যাদেরকে দেখলে আল্লাহর কথা মনে পড়ে তারাই তো আল্লাহর মুকাররাব বান্দা।

(মুসনাদে আহমাদ, হাদীস : ২৭৫৯৯; শুআবুল ঈমান, বায়হাকী, হাদীস : ৬২৮২: আলআদাবুল মুফরাদ, বুখারী, হাদীস : ৩২৩)

 আল্লাহ ওয়ালাতো তারাই যাদের চেহারায় আল্লাহ তাআলার নূরের তাজাল্লী হতে থাকে। স্বচ্ছ টলটলে শান্ত পুকুরে চাঁদের  প্রতিচ্ছবি পড়ে। আমি আমার আববাজানের চেহারায় যা দেখেছি, আমি আমার সমগ্র অস্তিত্বের মাঝে অনুভব করেছি এটা আল্লাহ তাআলার সেই নূর যে নূর আল্লাহ তাআলা কেবল তাঁর নেক বান্দাদেরই দিয়ে থাকেন-

يَسْعَى نُورُهُمْ بَيْنَ أَيْدِيهِمْ وَبِأَيْمَانِهِمْ بُشْرَاكُمُ الْيَوْمَ جَنَّاتٌ تَجْرِي مِنْ تَحْتِهَا الْأَنْهَارُ خَالِدِينَ فِيهَا

(তরজমা) তাদের সামনে এবং ডানে তাদের নূর ছুটতে থাকবে। বলা হবে, আজ তোমাদের জন্য সুসংবাদ জান্নাতের, যার পাদদেশে নদী প্রবাহিত। সেখানে তোমরা স্থায়ী হবে। এটাই মহাসাফল্য। (সূরা হাদীদ ৫৭ : ১২)

আরবের কোনো শায়ের বড় হৃদয়স্পর্শী ভাষায় আল্লাহওয়ালাদের পরিচয় তুলে ধরেছেন এভাবে,

إذا سكن الغدير على صفاء

                                                  وجنب أن يحركه النسيم

بدت فيه السماء بلا امتراء

                                              كذاك الشمس تبدو والنجوم

كذاك وجوه أرباب التجلي

                                                                          يرى في صفوها الله العظيم

স্বচ্ছ শান্ত পুকুরে যেমন আকাশের প্রতিচ্ছবি ফুটে উঠে, সূর্য্য নক্ষত্রের ছবি ভেসে উঠে, আল্লাহওয়ালাদের চেহারারও এমন, তাদের চেহারার স্বচ্ছ আয়নায় মহান আল্লাহ তাআলা (তাঁর কুদরত ও ছিফাত) দৃষ্টিগোচর হন।

আমি তখন পাহাড়পুর মাদরাসার ছাত্র। মাদরাসার বার্ষিক মাহফিল। মাদরাসায় অনেক মেহমান। শীতের রাত। মেহমানদের জন্য আমরা আমাদের বিছানা ছেড়ে দিলাম। আববা যে কামরায় থাকতেন আমি সেই কামরায় চলে এলাম আববার সাথে থাকার নিয়তে। শীতের কাপড় গায়ে না জড়িয়েই শুয়ে পড়লাম। রাতে একসময় ঘুম ভাঙল। আমি দেখলাম, আমার গায়ে লেপ। লেপ কোত্থেকে এল? আমি তো লেপ গায়ে দিয়ে শুইনি! বেশ অবাক হলাম। হঠাৎ আববার দিকে নযর গেল। চমকে উঠলাম। আববাকে দেখলাম লেপছাড়া গুটিসুটি হয়ে আছেন। আমি ঘুমানোর পর আববা নিজের লেপটা আমার গায়ে দিয়ে নিজে খালি দেহে শুয়ে আছেন। আমি তাড়াতাড়ি উঠে লেপটা আবার আববার গায়ে দিয়ে দিলাম। রাতের শেষ প্রহরে আমার আবার ঘুম ভাঙল। দেখলাম, আবারো আমার গায়ে লেপ। চট করে তাকালাম আববাজানের দিকে। দেখলাম, তিনি নামায পড়ছেন।

এভাবে একটা রাত কাটল আববাজানের কামরায়। আববাজানের খুব কাছাকাছি। সন্তানের প্রতি বাবার অকৃত্রিম সেণহ- এ তো খুবই স্বাভাবিক কথা। কিন্তু কেন জানি না আববাজানের প্রতিটা আচরণের মধ্যে স্বাভাবিক সেণহ ও মমত্ববোধের উর্ধ্বে অন্যকিছু অনুভব করতাম।  আমি ঠিক বুঝে উঠতে পারতাম না, আববা যা করছেন একি শুধুই সন্তানের প্রতি সেণহবোধ থেকে করছেন, না এখানে হৃদয় ও আত্মার অন্য কোনো সম্পর্ক লুকিয়ে আছে। আববা আমাকে যে ভাষায় সম্বোধন করতেন, যে শব্দে ডাকতেন, সেসব ভাষা ও শব্দের গভীরে আমি অনুভব করতাম এক অভূতপূর্ব ভালবাসা। আমি তখন অনেক ছোট। কিন্তু অনেক কিছুই বুঝতে পারি। সেই রাতের কথাগুলো মনে হলে আমার ভিতরটা কেমন যেন করে উঠে। তখন তো পৃথিবী ঘুমন্ত ছিল। চারিদিক নিস্তব্ধ ছিল। এই সুনসান নিস্তব্ধ পৃথিবীতে একজন পিতা তখন ব্যস্ত  অন্য এক কাজে। নিজের গায়ের লেপটা নিয়ে তিনি অতি সন্তর্পনে ঘুমন্ত সন্তানের গায়ে দিয়ে দিচ্ছেন। তারপর শীতের রাতে নিজে খালি দেহে শুয়ে পড়ছেন। আমার চোখে এখনো উজ্জ্বল সেই ছবি। এইসব ছবি কখনো হৃদয় থেকে মোছা যায় না।

আববার সমস্ত কাজের ভিতর একটা নিষ্পাপ ছবি ভেসে উঠত। হৃদয় ও কলবের পবিত্রতার ছাপ মানুষের চেহারার মধ্যেও পড়ে - এ কথা সবারই জানা। এ কথার একেবারে জীবন্ত মেসদাক ছিলেন আমার আববাজান। আববাজানের প্রত্যেকটা কথা হত মাপামাপা। কথা বলতেন হাসিমুখে। কথা বলতেন শ্রোতাকে আপন করে নিয়ে। কথা শুনতেন শ্রোতার দিকে পূর্ণ মনোযোগী হয়ে । বহু মানুষ আববাজানের কাছে যেত কোনো পেরেশানীর কথা বলে সান্ত্বনা লাভ করার জন্য। আববাজান তাদের কথা এতটা মনোযোগ দিয়ে এতটা গুরুত্ব দিয়ে শুনতেন যে, আববাজান কোনো সান্ত্বনা দেওয়ার আগে তাদের মন শান্ত হয়ে যেত। এরপর আববা যা বলতেন, সেটা তাদের জন্য এক অনন্য হেদায়েতে পরিণত হত।

আমার কতবার এমন হয়েছে যে, আববাজানের কাছে অনেক কথা বলার আছে। অনেকগুলো বিষয়ে আববাজান থেকে ফায়সালা নিতে হবে। মনের অনেক বোঝা আববাজানকে বলে হালকা করতে হবে। বহু পরিকল্পনা নিয়ে আববাজানের কাছে গেছি। দুয়েক কথা বলার পরই দেখা গেল আমার সব জটিলতার সমাধান হয়ে গেছে। বুকের পাথর নেমে বুকটা হালকা হয়ে গেছে। আববার একটা অভ্যাস দেখেছি, কথা শোনার সময় মাথাটা নিচের দিকে ঝুঁকিয়ে  রাখেন। ডানে বামে কোনোদিকে তাকাতেন না। নিজের সমস্ত মনোযোগ কথা শোনার দিকে নিবদ্ধ রাখেন। ছোট বড় সবার কথাই তিনি গভীর মনোযোগ দিয়ে শুনতেন। কারো প্রতি কোনোদিন কোনো অবহেলা করতে আমি দেখিনি। কারো প্রতি উদাসীন মনোভাব কোনোদিন আমার নযরে আসেনি। কথা বলা ও কথা শোনার যে নববী আদর্শ, আববা ছিলেন সেই আদর্শের পূর্ণমাত্রার অধিকারী। আববা আজীবন মানুষের সাথে হাসিমুখে কথা বলেছেন। আববার সেই হাসিমাখা মুখ যারা দেখেছে কোনোদিন তাদের মন থেকে সেই ছবি মুছে যাবে না। নিষ্পাপ হাসি। আমার প্রিয় ছাত্র মাওলানা আবু তাহের মেসবাহের ভাষায়,  মাসুমানা হাসি। আববাজানের ইন্তেকালের কিছুদিন পর ভাঙা মন নিয়ে পাহাড়পুর যাচ্ছি। সঙ্গে আবু তাহের মেসবাহ। তাঁর যবানে আববাজানের হাসিমাখা চেহারার এমন বিবরণ শুনে আমার মনটা ভালো হয়ে গেল। আববাজান এখন কবরে শুয়ে আছেন। আমার মনে হচ্ছে সেখানেও আববাজানের চেহারায় এই মাসুমানা হাসিটা লেগে আছে। আল্লাহ! আমার এ বিশ্বাস যেন সত্য হয়। আমীন ইয়া রাববাল আলামীন।      

আমি ঢাকায় থাকি। আববা পাহাড়পুরে। মাঝেমধ্যেই আববা বিভিন্ন প্রয়োজনে আমার কাছে চিঠি লিখতেন। সেসব চিঠিতে আববা প্রয়োজনের কথা বলতেন। কিছু টুকটাক নির্দেশনা দিতেন। কিছু আদেশ কিছু নিষেধ থাকত। কিন্তু চিঠির বিষয়বস্ত্তর চেয়ে চিঠির অন্তরে লুকানো আবেদনটাই মুখ্য হয়ে দেখা দিত। চিঠির প্রতিটি অক্ষরে আমি স্পষ্ট অনুভব করতাম আববার হৃদয়ের উত্তাপ। আববা যেন হৃদয়ের এই উত্তাপটাই কালো কালো হরফের আবরণে আমার কাছে পাঠিয়ে দিতেন। নির্দেশনাগুলো সেখানে কখনো মুখ্য নয়। আববাজান চিঠির শুরুতে যেসব সম্বোধন উল্লেখ করতেন আমার সমগ্র অস্তিত্বে এক অদ্ভুত আলোড়ন তৈরি হয়ে যেত। আমার সমগ্র অতীত, আববাজানের সাথে আমার যিন্দেগীর সমস্ত স্মৃতি মুহূর্তেই চোখের সামনে ভেসে উঠত। এই চিঠিগুলোকে আমি আমার যিন্দেগীর এক অমূল্য সম্পদ মনে করি। কোনো চিঠিতে আববা আমাকে সম্বোধন করতেন, আঁখু কী ঠান্ডাক বলে।  কোথাও বলতেন, নূরে চশম। আববার চিঠিগুলোর ভাষা ও শব্দচয়ন এতটাই মর্মস্পর্শী হত যে, আমি চিঠির মধ্যে দীর্ঘ সময় তন্ময় হয়ে থাকতাম। আমি মনে করতাম, এ তো আমার প্রতি আমার আববাজানের এমন এক এহসান যার ঋণ পরিশোধ করা আমার পক্ষে কোনোদিনই সম্ভব নয়।

আববাজান যেকোনো বড় সিদ্ধান্ত নেয়ার আগে অবশ্যই আমাকে অবহিত করতেন। কখনো ঢাকা থেকে আমাকে ডেকে পাঠাতেন। কখনো চিঠির মাধ্যমে আমার খেয়াল জানতে চাইতেন। আলহামদুলিল্লাহ আমি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করি এসব কিছুই ছিল আববাজানের আকাশসম উচ্চ আখলাকের বহিঃপ্রকাশ। আববার এই উন্নত মানসিকতার একটা সুস্পষ্ট প্রভাব আমার যিন্দেগীর মধ্যেও পড়েছিল। আমি আমার যিন্দেগীর গুরুত্বপূর্ণ কোনো সিদ্ধান্ত আববাজানের অনুমতি ছাড়া গ্রহণ করিনি। আমার বড় মেয়ের বিয়ের সময় কথাবার্তা যখন একপ্রকার চূড়ান্ত। এখন আমি হ্যাঁ বললেই হয়ে যাবে। সবাই আমার দিকেই তাকিয়ে থাকল। আমি বললাম, সবকিছু তো হল। এখন আমার আসল কাজ বাকি রয়ে গেছে। এখনই আমি কিছু বলতে পারবো না। আমি আববাজানকে সবকিছু বলব। সব শুনে আববাজান যে সিদ্ধান্ত দিবেন সেটাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত।

কে যেন তখন আমাকে বলল, আপনি সিদ্ধান্ত দিয়ে দিলেই তো হয়ে যায়। আববাজানের সাথে পরামর্শের এখন কী প্রয়োজন। বলাই বাহুল্য, কথাটা আমার মনপুত হল না। আমার পাশে ছিলেন আমার দীর্ঘকালের সুহৃদ দোস্ত শেখেরচরের হুযুর মাওলানা আবদুল মতীন ছাহেব। আবদুল মতীন ছাহেব আমাকে অন্তর দিয়ে তায়ীদ করলেন। বললেন, আবদুল হাই পাহাড়পুরী জীবনে কোনোদিন বাবা-মার অগোচরে তাদের না জানিয়ে কোনো কাজ করেননি। এখনও আমাদের উচিত হবে না মেয়ের বিয়ের বেলায় এসে তাকে তার এই আখলাক থেকে সরিয়ে দেয়া।

আববা আম্মা থাকেন সেই পাহাড়পুর। আমি থাকি ঢাকায়। সমস্ত ব্যাপারে আববা আম্মার পরামর্শ নেওয়া অবশ্যই কষ্টকর। ফোনে যোগাযোগের কোনো ব্যবস্থা ছিল না। তবুও আল্লাহর মেহেরবানী, কখনো আমার চিন্তায় আসেনি যে, কাজটা করে ফেলি। পরে আববাকে জানিয়ে দিলেই হবে। যে কোনো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমি আববার কাছে গিয়েছি। আববার সামনে বসেছি। আববার কাছে সবগুলো বিষয় খুলে বলেছি। ষ

শ্রুতিলিখন :

আবরারুয যামান পাহাড়পুরী

 

 

advertisement