একটি বই, একটি চিঠি
ইখতিলাফে মাযমূম (অযৌক্তিক ও নিন্দনীয় মতভেদ) তো সর্বাবস্থায় বর্জনীয়; এক্ষেত্রে প্রকৃত সত্য একটিই, যা সুনির্দিষ্ট এবং যা গ্রহণ করা অত্যাবশ্যক। এই সত্য থেকে যে বিমুখ হবে ইখতিলাফের গোনাহ ও দায়দায়িত্ব তার উপর। ইখতিলাফে মাহমূদ বা মাশরূ’ যা বৈধ ও ন্যায়সঙ্গত- এক্ষেত্রেও বিধান এই যে, একে গলদ তরিকায় ব্যবহার করে বিভেদের দ্বার উন্মুক্ত করা যাবে না। তবে ন্যায়ের সীমা অতিক্রম না করে, সংলাপের নীতিমালা মেনে দলীলনির্ভর ইখতিলাফি মাসায়েলে ‘ইলমী জিদাল ও মুনাকাশা’ তথা আলেমসুলভ বিতর্ক ও পর্যালোচনার অবকাশ রয়েছে। এবং এই ধারাবাহিকতা অতিপ্রাচীন। আক্ষেপের বিষয়, কিছু মানুষ এখন এধরণের মাসায়েলে ‘ইলমী মুনাকাশার’ পরিবর্তে রেষারেষি ও অপবাদ আরোপের পথ বেছে নিয়েছে। যে কারণে তাদেরকে নিজেদের আলোচনার ভিত্তি রাখতে হয়েছে অবাস্তব সব দাবি-দাওয়ার উপর। রেওয়ায়েতসমূহের গ্রহণ-বর্জনের ক্ষেত্রেও তাদের নিতে হয়েছে উসূল ও নীতিমালার পরিবর্তে না-ইনসাফি ও পক্ষপাতিত্বের পথ। এমন কাজ যে-ই করুক বা করে থাকুক সে ন্যায়ের পথ থেকে অবশ্যই বিচ্যুত এবং ইলমের আমানত বিনষ্টের অপরাধে অপরাধী।
‘জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) -এর ছালাত’ নামের বইটি ‘ইলমী মুনাকাশা’র চেয়ে অপবাদ ও না-ইনসাফিরই উপর বেশি নির্ভরশীল। বইটির নাম থেকেই যা অনুমেয়। এর আবরী নামটিও বড় অদ্ভুত। Ôصلاة الرسول صلى الله عليه وسلم بقبضة الأحاديث الضعيفة والموضوعة। নাম তো আক্রোশে ঠাসা, কিন্তু বিশুদ্ধতার দিক দিয়ে শূন্য! আল্লাহর মেহেরবানী যে, এ বইয়ের একটি কপি জনৈক আলেমের হস্তগত হয়। যিনি হযরত মাওলানা আব্দুল গাফফার সাহেবের ভক্ত এবং এক সময় তার মুসল্লিও ছিলেন- তিনি তা মাওলানার কাছে পৌঁছান এবং এ বই সম্পর্কে তার মতামত প্রকাশের অনুরোধ জানান। এই অনুরোধকে গুরুত্বের সাথে আমলে নিয়ে মাওলানা এ বিষয়ে এক দীর্ঘ চিঠি লেখেন। যা একটি স্বতন্ত্র প্রবন্ধের রূপ লাভ করে। বিষয়বস্ত্ত পুরোপুরি ইলমী ও সূক্ষ্ম হওয়া সত্ত্বেও ভাষার সাবলীলতা ও পাঠ-মাধুর্য তাতে ব্যাহত হয়নি। ইলমী দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচনার যতখানি হক আদায় করা সম্ভব তাতেও প্রবন্ধটি সফল, আলহামদুলিল্লাহ। পাঠকদের কাছে নিবেদন, চিঠিটি তারা চিন্তা সহকারে পড়বেন এবং বারবার পড়বেন। দলীলের বিশ্লেষণসহ ইখতিলাফি মাসায়েল অধ্যয়ন করে যারা অভ্যস্ত- ইনশাআল্লাহ তারা এতে সেই চাহিদা নিবারণের প্রচুর উপাদান পাবেন। প্রবন্ধকারের কাছে আবেদন, ইনসাফ ও ইলমী গভীরতা এবং ভাষার সাবলীলতা ও প্রাঞ্জলতার এই ধারা বজায় রেখে তিনি সম্পূর্ণ বইটির উপর তার পর্যালোচনা ও মূল্যায়ন লিপিবদ্ধ করবেন। আল্লাহ তা‘আলা সুস্থতা ও নিরাপত্তার সাথে তাকে দীর্ঘ নেক হায়াত দান করেন। আমীন।
(মুহাম্মাদ আব্দুল মালেক)
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম
আস্সালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহ
মুহতারাম,
আপনার প্রেরিত মুযাফ্ফর বিন মুহসিন প্রণীত ‘‘জাল হাদীসের কবলে রাসুলুল্লাহ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)-এর ছালাত’’ নামক বইটি পেয়েছি। এরূপ একটি বই প্রেরণের জন্য আপনাকে অশেষ ধন্যবাদ। আল্লাহ তাআলা আপনাকে জাযায়ে খায়ের এনায়েত করুন, আমীন। আপনার পক্ষে বর্তমানে কোনো কিতাবাদি দেখা সম্ভব নয় বিধায় আপনি আমাকে আদেশ করেছেন, বইটিতে যা বলা হয়েছে তার সত্যাসত্য ও যথার্থতা যাচাই করে আপনাকে জানাতে।
বইটির নাম থেকে শুরু করে উপসংহার পর্যন্ত লেখকের বক্তব্য, উদ্ধৃতি ও হাদীসের ব্যাখ্যাসহ সবকিছুই ব্যাপক ও গভীর আলোচনা ও পর্যালোচনার দাবি রাখে। কিন্তু এর জন্য যে পর্যাপ্ত সময়ের প্রয়োজন সেই সময় বের করা আমার পক্ষে কষ্টকর। কারণ, আপনি জানেন, মাদারটেকের একটি মাদরাসায় বুখারী শরীফ ১ম খন্ড, আমাদের নিজেদের প্রতিষ্ঠিত জামিয়াতুল উলূমিল ইসলামিয়ায় বুখারী শরীফ ২য় খন্ড, মিশকাত শরীফ ১ম খন্ডসহ বেশ কিছু কিতাবের দরস আমাকে দিতে হয়। সেই সঙ্গে শহীদবাগস্থ আব্দুস সোবহান মাদরাসার পরিচালনা-ভার ও আমাদের প্রতিষ্ঠিত জামিয়াতুল উলুমিল ইসলামিয়া ঢাকা -এর ভাইস প্রিন্সিপালের দায়িত্ব এবং মসজিদের ইমামতির দায়িত্ব তো আছেই। অতএব সময়ের স্বল্পতাহেতু পুরো বইটি নিয়ে আলোচনা এই মুহূর্তে সম্ভব হচ্ছে না। তবে বইটির মূল প্রতিপাদ্য বিষয় যেহেতু সালাত, সেহেতু গ্রন্থখানির চতুর্থ অধ্যায়ে ‘‘ছালাতের সময়’’ শিরোনামের অধীনে আলোচিত বিষয়াবলীর মধ্য হতে শুধু ‘ফজরের ছালাতের ওয়াক্ত’ সম্পর্কে লেখকের বক্তব্য নিয়ে সামান্য পর্যালোচনার সিদ্ধান্ত নিলাম। পর্যালোচনা শেষে পুরো গ্রন্থখানি সম্পর্কে আমার মৌলিক কিছু বক্তব্য তুলে ধরার চেষ্টা করব ইনশাআল্লাহ।
ফজরের ছালাতের ওয়াক্ত
লেখক লিখেছেন, ছুবহে ছাদিকের পর হতে ফজরের ওয়াক্ত শুরু হয়। সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। সমস্যাজনিত কারণে সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত আদায় করা যায়। এ পর্যন্ত লিখে তিনি ৪৫৫ নং টীকা যুক্ত করেছেন। টীকায় তিনি তাঁর উপরিউক্ত কথার বরাত দিয়েছেন বুখারী শরীফের ৫৫৬ ও ৫৭৯ নং হাদীসের।
পর্যালোচনা: বরাত অনুযায়ী নম্বর দুইটিতে ঐরূপ কোনো হাদীস আমি পাইনি। নম্বর দুইটিতে যে হাদীসটি আছে তা এই-
عَنْ أَبِي هُرَيْرَةَ قَالَ : قَالَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم : إِذَا أَدْرَكَ أَحَدُكُمْ سَجْدَةً مِنْ صَلاَةِ الْعَصْرِ قَبْلَ أَنْ تَغْرُبَ الشَّمْسُ فَلْيُتِمَّ صَلاَتَهُ ، وَإِذَا أَدْرَكَ سَجْدَةً مِنْ صَلاَةِ الصُّبْحِ قَبْلَ أَنْ تَطْلُعَ الشَّمْسُ فَلْيُتِمَّ صَلاَتَهُ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, ‘তোমাদের কেউ যখন সূর্যাস্তের পূর্বে আসরের এক রাকআত পায় তখন সে যেন তার সালাত পূর্ণ করে এবং যখন সূর্যোদয়ের পূর্বে সালাতে ফজরের এক রাকআত পায় সে যেন তার সালাত পূর্ণ করে ।’
লেখক হয়তো বলবেন, ‘আমি এই হাদীসের বরাত দিয়েছি আমার শেষোক্ত বাক্য ‘‘সমস্যাজনিত কারণে সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত আদায় করা যায়’’-এর সমর্থনে’। কিন্তু লেখকের বিরূদ্ধে তখন প্রশ্ন দাঁড়াবে যে, এই হাদীসে তা বলা হয়নি। এই হাদীসে যা বলা হয়েছে তার মর্মার্থ হল, ফজরের এক রাকআত পড়ার পর যদি সূর্য উদিত হয়ে যায় তবে সূর্যোদয়ের কারণে সে যেন সালাত পরিত্যাগ না করে, বরং সে যেন তার সালাত পূর্ণ করে নেয়। অর্থাৎ সূর্যোদয়ের পূর্বে এক রাকআত আদায় করতে পারলে তার দ্বিতীয় রাকআতটি সূর্যোদয়ের মুহূর্তে আদায়কৃত হলেও তার সালাত হয়ে যাবে । সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত নয় বরং সূর্যোদয়ের মুহূর্তে আদায় করার কথা বলা হচ্ছে।
উল্লেখ্য: সূর্যোদয়ের মুহূর্তে সালাত আদায় অন্যান্য হাদীসের বক্তব্য মতে হারাম। সেইসব হাদীসের সঙ্গে এই হাদীসের বক্তব্য সাংঘর্ষিক হওয়ায় এই হাদীসের প্রায়োগিক ক্ষেত্র কী তা নির্ণয়ে ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের মাঝে বিস্তর মতভেদ রয়েছে। সেটি স্বতন্ত্র এক আলোচ্য বিষয়।
সমস্যাজনিত কারণে সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত আদায় করা যায়। লেখকের এই কথাটি এই হাদীসে তো নয়ই কোনো হাদীসেই নেই। দেখুন, লেখক প্রথমে বলেছেন যে, ছুবহে ছাদিকের পর হতে ফজরের ওয়াক্ত শুরু হয়। সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। এটি শুধু লেখকের বক্তব্য নয়, ওয়াক্ত সংক্রান্ত সব হাদীসের বক্তব্যও তাই। সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত যখন ফজরের ওয়াক্ত থাকে তখন সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত ফজর আদায় করা সর্বাবস্থায় বৈধ হবে। কোন সমস্যা বা ওজর থাকুক বা না থাকুক। সমস্যাজনিত কারণে সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত আদায় করা যায়’ - লেখকের এই কথা দ্বারা বুঝা যায় যে, সমস্যা না থাকলে সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত আদায় করা যাবে না । অথচ একটু পূর্বে তিনি বলে আসলেন যে, ফজরের ওয়াক্ত সূর্যোদয়ের পূর্ব পর্যন্ত থাকে। লেখকের বক্তব্য এখানে স্ববিরোধী হয়ে যাচ্ছে। আসলে ‘সমস্যাজনিত কারণে’ শর্তটি লেখক নিজের পক্ষ হতে যুক্ত করে দিয়েছেন। সহীহ হাদীস জাল হয়ে যায় এভাবেই। আমি ভাবছি, লেখক জাল হাদীসের কবল হতে সালাতকে মুক্ত করার অভিযানে নেমে নিজেই রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাতকে জাল হাদীসের কবলে নিক্ষেপ করলেন না তো? নিজেই নিজের জালিয়াতির জালে আটকা পড়ে গেলেন না তো?
লেখক এরপর লিখেছেন, ‘আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা সর্বোত্তম হিসাবে রাসূল (ছাঃ) খুব ভোরে ছালাত আদায় করতেন। পূর্ব আকাশ ফর্সা হওয়ার পর ছালাত শুরু করতে হবে মর্মে কোন ছহীহ দলীল নেই।’ বোঝা যাচ্ছে, লেখক ফজরের মুস্তাহাব বা পছন্দনীয় ওয়াক্ত কোনটি তা নিয়ে আলোচনা করতে চাচ্ছেন। সে ক্ষেত্রে লেখকের উচিত ছিল এই কথা লেখা ‘পূর্ব আকাশ ফর্সা হওয়ার পর ছালাত শুরু করা মুস্তাহাব এই মর্মে কোনো সহীহ দলীল নেই’ । কারণ, ‘করতে হবে’ আর ‘করা মুস্তাহাব’ কথা দুইটির মধ্যে আকাশ পাতাল পার্থক্য রয়েছে। প্রথমটি অপরিহার্যতা বোঝায় আর দ্বিতীয়টি পছন্দনীয়তা বোঝায়। করতে হবে মর্মে কোন সহীহ দলীল নেই কথাটি শতভাগ সত্য। এই কারণে আমাদের জানামতে পৃথিবীর কেউ বলেন না যে, পূর্ব আকাশ ফর্সা হওয়ার পর ছালাত শুরু করতে হবে। লেখক দাবি করতে চাচ্ছেন, পূর্ব আকাশ ফর্সা হওয়ার পর ছালাত শুরু করা মুস্তাহাব মর্মে কোন সহীহ দলীল নেই অথচ বাক্য ব্যবহার করলেন, ‘করতে হবে মর্মে কোন সহীহ দলীল নেই।’ এতে পাঠককে বিভ্রান্ত করার একটা প্রয়াস লক্ষ্য করা যায়।
লেখক বলেছেন, আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা সর্বোত্তম হিসাবে রাসূল (ছাঃ) খুব ভোরে ছালাত আদায় করতেন। ‘‘আউয়াল ওয়াক্তে ছালাত আদায় করা সর্বোত্তম’’ কথাটির বরাত দিয়েছেন তিরমিযী শরীফের ১৭০ নং হাদীসের এবং মন্তব্য লিখেছেন, সনদ সহীহ।
তাহকীক: ইমাম তিরমিযী রাহ. হাদীসটির সনদের উপর মন্তব্য করেছেন এই কথা বলে-
حديث أم فروة لا يروى إلا من حديث عبد الله بن عمر العمري وليس هو بالقوى عند أهل الحديث واضطربوا عنه في هذا الحديث وهو صدوق وقد تكلم فيه يحيى بن سعيد من قبل حفظه
ইমাম তিরমিযী রাহ.-এর এই মন্তব্য হাদীসটির সনদকে যঈফ বলে সাব্যস্ত করে। অথচ লেখক সনদটিকে সহীহ বললেন। ইমাম তিরমিযীর মন্তব্য অনুযায়ী হাদীসটিতে আব্দুল্লাহ ইব্ন উমার আল-উমারী নামক যে রাবী আছেন তিনি যঈফ। তিনি ব্যতীত উম্মে ফারওয়া রা.-এর এই হাদীসটি আর কেউ বর্ণনা করেন না। তদুপরি হাদীসটিতে ইযতিরাব রয়েছে। এতসব দোষ থাকা সত্ত্বেও সনদটিকে সহীহ বলা কতটুকু যুক্তিযুক্ত? হাঁ, শায়খ আলবানী রাহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। লেখক হয়তো তাঁর তাকলীদ করেই বলেছেন, সনদ সহীহ। তাকলীদ যদি করতেই হয় তবে শায়খ আলবানীর কেন, ইমাম তিরমিযীর নয় কেন? তাছাড়া শায়খ আলবানী হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন, সনদটিকে নয়। সনদ সহীহ হওয়া আর হাদীস সহীহ হওয়া এক কথা নয়। পরবর্তী আলোচনায় তা স্পষ্ট হবে। লেখকের উচিত ছিল শায়খ আলবানী রাহ. হাদীসটিকে কেন সহীহ বলেছেন তা তাহকীক করা ।
শায়খ আলবানী রাহ.-এর তাহকীক ও পর্যালোচনা
উম্মে ফারওয়া রা.-এর হাদীসটির সনদ শায়খ আলবানীর মতেও যঈফ। তিনি সুনানে আবূ দাউদে হাদীসটির উপর আলোচনা করতে গিয়ে বলেন :
و هذا سند ضعيف، عبد الله بن عمر - هو العمرى المكبر- وهو سيئ الحفظ
(এটি যঈফ সনদ। আব্দুল্লাহ ইবন উমর হচ্ছেন আল-উমারী । তিনি দুর্বল স্মৃতিশক্তিসম্পন্ন।) এরপর তিনি হাদীসটির ইযতিরাব সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করার পর লেখেন:
وهذا اضطراب شديد مما يزيد فى ضعف الاسناد
(এটা মারাত্মক ইযতিরাব যা হাদীসের সনদকে আরও দুর্বল করে দেয়) অর্থাৎ শায়খ আলবানী বলতে চাচ্ছেন, একে তো যঈফ রাবীর কারণে হাদীসের সনদটি যঈফ, তদুপরি এতে রয়েছে নানারকম ইযতিরাব যা হাদীসের সনদকে আরও যঈফ ও দুর্বল করে দেয়। এতদসত্ত্বেও আমাদের আলোচ্য বইয়ের লেখক বলে দিলেন, ‘সনদ সহীহ’। হাঁ উম্মে ফারওয়ার হাদীসটি হাকেম কর্তৃক বর্ণিত আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসউদ রা.-এর হাদীস দ্বারা সমর্থিত বলে মনে করার কারণে আলবানী রাহ. হাদীসটিকে সহীহ বলেছেন। অর্থাৎ তাঁর মতে হাদীসটি সহীহ লিগাইরিহী। কোনো হাদীস অন্য হাদীস দ্বারা সমর্থিত হওয়ার কারণে সহীহ লি-গাইরিহী হওয়া আর সেই হাদীসটির সনদ সহীহ হওয়া এক কথা নয়। বিষয়টি সাধারণ তালিবুল ইলমও জানে। লেখক কেন বিষয়টি জানলেন না তা বোঝা গেল না।
উম্মে ফারওয়া রা.-এর হাদীসটি কি সহীহ, যেমনটা আলবানী রাহ. বলেছেন?
আব্দুল্লাহ ইবন মাসঊদ রা. কর্তৃক বর্ণিত মুস্তাদরাকে হাকেমের যে হাদীসটির কারণে উম্মে ফারওয়া রা. -এর হাদীসটিকে শায়খ আলবানী রাহ. সহীহ বলেছেন সেটি যঈফ। কারণ : বর্ণনাটি শায বা দল-বিচ্ছিন্ন বর্ণনা। এর বিস্তারিত বিবরণ এই যে, হাকেম হাদীসটিকে বর্ণনা করেছেন এইভাবে:
حَدَّثَنَا عَلِيُّ بْنُ عِيسَى ، فِي آخَرِينَ ، قَالُوا : حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرٍ مُحَمَّدُ بْنُ إِسْحَاقَ ، حَدَّثَنَا بُنْدَارٌ ، حَدَّثَنَا عُثْمَانُ بْنُ عُمَرَ ، حَدَّثَنَا مَالِكُ بْنُ مِغْوَلٍ ، عَنِ الْوَلِيدِ بْنِ الْعَيْزَارِ ، عَنْ أَبِي عَمْرٍو الشَّيْبَانِيِّ ، عَنْ عَبْدِ اللهِ بْنِ مَسْعُودٍ ، قَالَ : سَأَلْتُ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ : أَيُّ الْعَمَلِ أَفْضَلُ ؟ قَالَ : الصَّلاَةُ فِي أَوَّلِ وَقْتِهَا
এই হাদীসটিকেই ইমাম বুখারী রাহ. ভিন্ন শব্দে তাঁর গ্রন্থে গ্রন্থাবদ্ধ করেছেন। তিনি বলেছেন:
حَدَّثَنَا أَبُو الْوَلِيدِ هِشَامُ بْنُ عَبْدِ الْمَلِكِ قَالَ : حَدَّثَنَا شُعْبَةُ قَالَ الْوَلِيدُ بْنُ الْعَيْزَارِ ، أَخْبَرَنِي قَالَ : سَمِعْتُ أَبَا عَمْرٍو الشَّيْبَانِيَّ يَقُولُ ، حَدَّثَنَا صَاحِبُ هَذِهِ الدَّارِ وَأَشَارَ إِلَى دَارِ عَبْدِ اللهِ ، قَالَ : سَأَلْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم أَيُّ الْعَمَلِ أَحَبُّ إِلَى اللهِ قَالَ الصَّلاَةُ عَلَى وَقْتِهَا قَالَ ثُمَّ أَيُّ قَالَ ثُمَّ بِرُّ الْوَالِدَيْنِ قَالَ ثُمَّ أَيُّ قَالَ الْجِهَادُ فِي سَبِيلِ اللهِ ، قَالَ : حَدَّثَنِي بِهِنَّ وَلَوِ اسْتَزَدْتُهُ لَزَادَنِ
(হাদীস নং-৫২৭)
লক্ষ করুন বুখারীর বর্ণনায় শব্দ রয়েছে الصلاة على وقتها আর হাকেমের বর্ণনায় রয়েছে الصلاة فى أول وقتها । দুটি কথা সম্পূর্ন ভিন্ন অর্থ বহন করে। সে কথায় পরে আসছি। বুখারী রাহ. হাদীসটিকে শু‘বার সনদে উল্লেখ করেছেন। শু‘বার সকল শাগরেদ হাদীসটিকে الصلاة على وقتها শব্দেই বর্ণনা করেছেন। শুধু তাঁর একজন শাগরেদের বর্ণনায় الصلاة فى أول وقتها পাওয়া যায়। তিনি হলেন আলী ইব্ন হাফস। আলী ইব্ন হাফস কর্তৃক বর্ণিত الصلاة فى أول وقتها শব্দ সম্বলিত হাদীসটি হাকেম, বায়হাকী ও দারা কুতনী তাঁদের স্ব স্ব গ্রন্থে উল্লেখ করেছেন। আলী ইব্ন হাফস সম্পর্কে দারা কুতনী মন্তব্য করেছেন এই বলে- ما احسبه حفظه لانه كبر وتغير حفظه (আমি মনে করি না আলী ইব্ন হাফস হাদীসটিকে যথাযথ সংরক্ষণ করেছেন। কেননা, তিনি বৃদ্ধ হয়ে গিয়েছিলেন এবং তাঁর স্মৃতিশক্তির পরিবর্তন ঘটেছিল।)
আরেকটি সনদে হাদীসটি الصلاة فى أول وقتها শব্দে বর্ণিত হয়েছে। সনদটি এরূপ-
الحسن بن على المعمرى عن ابى موسى محمد بن المثنى عن غندر عن شعبة
কিন্তু আবূ মূসার শাগরেদদের মধ্য হতে হাসান ইবন আলী ব্যতীত আর কেউ হাদীসটিকে ঐ শব্দে বর্ণনা করেন না। বরং তাঁর সকল শাগরেদ তাঁর বরাতে الصلاة على وقتها শব্দেই বর্ণনা করেন। দারা কুতনী রাহ. এমনটাই বলেছেন। তিনি বলেন,
تفرد به المعمرى فقد رواه أصحاب أبي موسى بلفظ الصلاة على وقتها
(অর্থাৎ আল-মা‘মারী এইরূপ একাই বর্ণনা করেছেন। আবূ মূসার সকল শাগরেদ হাদীসটিকে বর্ণনা করেছেন الصلاة على وقتها শব্দে।) এই মন্তব্যের পরে দারা কুতনী রাহ. আবূ মূসার অপর এক শাগরেদ মাহামিলীর বরাতে হাদীসটি বর্ণনা করেছেন الصلاة على وقتها শব্দে। ঠিক যেমনটা আবূ মূসার অন্যান্য শাগরেদগণ বর্ণনা করেন। আবূ মূসার ন্যায় গুনদারের সকল শাগরেদ হাদীসটিকে الصلاة على وقتها শব্দেই বর্ণনা করেন। হাফেয ইবন হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, প্রকাশ্যত এটাই বোঝা যায় যে, হাসান ইবন আলী আল-মা‘মারী তাঁর বর্ণনায় ভ্রান্তির শিকার হয়েছেন। কারণ, তিনি তাঁর স্মৃতি থেকে হাদীস বর্ণনা করতেন।
বাকী রইল মুস্তাদরাকে হাকেমের উপরিউক্ত ঐ বর্ণনাটি যার দ্বারা উম্মে ফারওয়ার হাদীসটি সমর্থিত বলে শায়খ আলবানী রাহ. মনে করেন। হাদীসটি সম্পর্কে বক্তব্য হল, হাদীসটি মালেক ইবন মিগ্ওয়ালের শাগরেদদের মধ্য হতে একমাত্র উসমান ইব্ন উমার ব্যতীত আর কেউ الصلاة فى أول وقتها শব্দে বর্ণনা করেন না। তাঁর সকল শাগরেদ তাঁর বরাতে হাদীসটিকে الصلاة على وقتها শব্দেই বর্ণনা করেন। হাফেজ ইবন হাজার আসকালানী রাহ. বলেন, وتفرد عثمان بذلك’ والمعروف عن مالك بن مغول كرواية الجماعة
(অর্থাৎ এইরূপ বর্ণনায় উসমান নিঃসঙ্গ। মালেক ইবন মিগ্ওয়াল হতে যা প্রসিদ্ধ তা হল الصلاة على وقتها শব্দে অন্যান্য সকলের অনুরূপ বর্ণনা।)
আপনি বলতে পারেন যে, হাকেম তো হাদীসটিকে على شرط الشيخين তথা বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের মানে উত্তীর্ণ বলে ব্যক্ত করেছেন।
এর জবাবে বলব যে, على شرط الشيخين কথাটি কোন্ হাদীসের ক্ষেত্রে ব্যবহার করা যায় বা করা হয় তা নিয়ে বিশেষজ্ঞগণের মধ্যে মতভেদ রয়েছে। কেউ বলেন, কোনো হাদীসের সনদে উল্লেখকৃত রাবীগণের সকলেই যদি বুখারী ও মুসলিমের রাবী হন তাহলে সেই হাদীস সম্পর্কে বলা যায় যে, তা على شرط الشيخين বা বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের মানসম্পন্ন। কেউ বলেন, যে হাদীসটির সনদ হুবহু বুখারী ও মুসলিমের সনদ সেই হাদীস সম্পর্কে বলা যায় যে, তা على شرط الشيخين । কেউ বলেন, বুখারী ও মুসলিমের রাবীগণ যে সকল বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর অধিকারী সেই সকল বৈশিষ্ট্য ও গুণাবলীর অধিকারী রাবী কর্তৃক বর্ণিত হাদীস সম্পর্কে বলা যায় যে, তা على شرط الشيخين । দ্বিতীয় মতটিই অধিকতর বিশুদ্ধ বলে মনে হয়। এর কারণ কী সে আলোচনা এখানে নিষ্প্রয়োজন। তবে সবকটি মতের সার কথা হল, যে হাদীসটিকে على شرط الشيخين বা বুখারী ও মুসলিমের হাদীসের মানে উত্তীর্ণ বলে ব্যক্ত করা হয় তার রাবীগণ উচ্চমান সম্পন্ন সত্যবাদি ও বিশ্বস্ত। কিন্তু কোন হাদীস সহীহ ও দলীল হিসাবে গ্রহণযোগ্য হওয়ার জন্য রাবীগণের সত্যবাদিতা, বিশ্বস্ততা ইত্যাদি গুণই যথেষ্ট নয়। বরং তাঁদের বর্ণনাটি শায বা দল-বিচ্ছিন্ন না হওয়াও জরুরী। এটি একটি স্বীকৃত মূলনীতি। দল বিচ্ছিন্নতা হাদীস সহীহ হওয়ার পথে একটি বড় বাধা। হাকেমের হাদীসটি এই বাধাকে অতিক্রম করতে পারেনি। কেননা পূর্বেই আমরা দেখিয়েছি যে, الصلاة فى أول وقتها শব্দে হাদীসটি বর্ণনার ক্ষেত্রে উসমান ইব্ন উমার নিঃসঙ্গ। তাঁর উস্তায মালেক ইবন মিগ্ওয়ালের শাগরেদগণের কেউই হাদীসটিকে ঐ শব্দে বর্ণনা করেন না।
সত্যবাদী ও বিশ্বস্ত হওয়া সত্ত্বেও যে সকল রাবী হাদীসটিকে الصلاة على وقتها -এর স্থলে الصلاة فى أول وقتها শব্দে বর্ণনা করেছেন তাঁদের কেউবা স্মৃতি দুর্বলতার শিকার হয়েছেন, আর কেউ সম্ভবত কথা দুটোর অর্থ অভিন্ন বলে ধারণা করে الصلاة على وقتها -এর স্থলে الصلاة فى أول وقتها বর্ণনা করেছেন। হাফেজ ইব্ন হাজার আসকালানী রাহ. বলেন,وكأن من رواها كذالك ظن ان المعنى واحد (যারা হাদীসটিকে এইভাবে বর্ণনা করেছেন তারা হয়তো মনে করেছেন যে, উভয়টির অর্থ এক।) শায়খ আলবানীও (রাহ.) কথা দুটোর অর্থ অভিন্ন বলে ধারণা পোষণ করেন। কেননা তিনি হাকেমের হাদীসের উদ্ধৃতি দেওয়ার পর বলেন: وهو فى الصحيحين وغيرهما بلفظ ,على وقتها، والمعنى واحد عندنا (সহীহাঈন ও অন্যান্য গ্রন্থে হাদীসটি على وقتها শব্দে বর্ণিত হয়েছে। আমাদের মতে অর্থ একই।) শায়খ আলবানীর সঙ্গে এ ক্ষেত্রে আমি সহমত পোষণ করি না।
কারণ, দ্বিতীয় কথাটির অর্থ হল, ওয়াক্তের শুরুতে সালাত আদায় করা। আর প্রথম কথাটির স্পষ্ট অর্থ হল, সময়মত সালাত আদায় করা। অর্থাৎ সালাতকে তার ওয়াক্তচ্যুত না করা। প্রতিটি সালাতের শুরু ও শেষের যে নির্ধারিত ওয়াক্ত আছে সেই ওয়াক্তের মধ্যেই সালাত আদায় করা। কাযা না করা।
একটি প্রশ্ন ও তার জবাব
কেউ বলতে পারে যে, الصلاة على وقتها কে তো আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় বলে বলা হয়েছে। কোনো বিষয় অধিক প্রিয় তখনই হয় যখন ঐ বিষয়টির মধ্যে একাধিক ঐচিছকতা বিদ্যমান থাকে এবং তন্মধ্য হতে একটি ঐচ্ছিক বিষয় অন্যটির তুলনায় প্রিয় হয়ে থাকে। সময়মত সালাত আদায় করা বা কাযা না করা তো অপরিহার্য। অপরিহার্যের মধ্যে কোনো ঐচ্ছিকতা থাকে না। সুতরাং বোঝা যায় যে, হাদীসটিতে বলা হয়েছে, যে কোনো সময়ে সালাত আদায় করা বৈধ তবে অন্য যে কোনো সময়ে আদায় করার তুলনায় আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় করা মুস্তাহাব বা অধিক প্রিয়।
এর জবাবে বলব যে, কথাটি যুক্তিযুক্ত। তবে কথাটি আলোচ্য বিষয়ে প্রযোজ্য হত যদি প্রশ্ন করা হত যে, কোন্ সময়ে সালাত আদায় করা উত্তম। এখানে প্রশ্ন করা হয়েছে, কোন্ আমলটি সর্বাধিক উত্তম? উত্তরে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, الصلاة على وقتها অর্থাৎ অন্যান্য আমলের তুলনায় সালাতকে সময়মত আদায় করা এবং কাযা না করা অধিক প্রিয়। তুলনা করা হয়েছে অন্যান্য আমলের সঙ্গে। বলা হয়েছে, সালাত কাযা না করা আল্লাহর নিকট অধিক প্রিয় আমল। সালাতের পূর্ণ সময়ের একটি অংশকে অপর অংশের সঙ্গে তুলনা করা হয়নি।
কথা আরও আছে। তা হল, একাধিক ঐচ্ছিক সময়ের মধ্য হতে আউয়াল বা শুরু সময়ের কথাটি বোঝা গেল কোত্থেকে? এ অর্থ কেন হবে না যে, একাধিক ঐচ্ছিক সময়ের মধ্য হতে মধ্যবর্তী সময়ে বা শেষ সময়ে সালাত আদায় করা অন্য সময়ের তুলনায় অধিক প্রিয়?
এই দীর্ঘ আলোচনার সার দাঁড়ালো এই যে, হাদীসটিকে যাঁরা الصلاة فى أول وقتها শব্দে বর্ণনা করেছেন তাঁরা হয় স্মৃতি বিভ্রাটের শিকার হয়েছেন নয় তো অর্থ বিভ্রাটের শিকার হয়েছেন। কারণ যা-ই হোক, তাঁদের বর্ণনাটি দল-বিচ্ছিন্ন বর্ণনা। আর দল-বিচ্ছিন্ন বর্ণনাকে মুহাদ্দিসগণ যঈফ বলেন। সম্ভবত এই কারণেই ইমাম বুখারী ও ইমাম মুসলিম রাহ. তাঁদের গ্রন্থে ঐ শব্দ সম্বলিত হাদীসটিকে স্থান দেননি। যদিও এর বর্ণনাকারীগণের বর্ণিত অন্য হাদীস তাঁরা গ্রহণ করেছেন। আর এই কারণেই ইমাম নববী রাহ. الصلاة فى أول وقتها শব্দে বর্ণিত সকল হাদীসকে যঈফ বলে মত প্রকাশ করেছেন। হাফেয ইব্ন হাজার আসকালানী রাহ. তাঁর ফতহুল বারী গ্রন্থে ইমাম নববী রাহ.-কে উদ্ধৃত করে বলেছেন,
وقد اطلق النووى فى شرح المهذب أن واية فى أول وقتها ضعيفة
অর্থাৎ শরহুল মুহায্যাব গ্রন্থে নববী রাহ. ব্যাপকভাবে (কোন ব্যতিক্রম উল্লেখ না করে) বলেছেন যে, فى أول وقتها বর্ণনা যঈফ।
উল্লেখ্য, এ পর্যন্ত হাফেজ ইবন হাজার আসকালানীকে উদ্ধৃত করে আমি যা লিখেছি তা যাচাই করতে দেখুন ফাতহুল বারী ২য় খন্ড, পৃষ্ঠা ১১ ও ১২, প্রকাশক: দারুল হাদীস, কায়রো।
সহীহ হাদীসের অপব্যাখ্যা না যথার্থ ব্যাখ্যা ?
লেখক এরপর লিখেছেন, মূলত ছহীহ হাদীসের অপব্যাখ্যা করে দেরী করে ছালাত আদায় করা হয়।
এ সম্পর্কে পরে আলোচনা আসছে। এরপর লেখক লিখেছেন, অনেক মসজিদে ফর্সা হলে ছালাত শুরু করা হয় এবং বিদ্যুত বা আলো বন্ধ করে কৃত্রিম অন্ধকার তৈরি করা হয়। এটা শরীয়তের সাথে প্রতারণা করার শামিল। হাঁ, অবশ্যই এটা প্রতারণা। লেখক স্পষ্ট করেননি, কারা এই কাজটি করে থাকে। কারণ, বিষয়টি এমনিতেই স্পষ্ট। এটা করে থাকে তারা যারা অন্ধকারে ফজর আদায় করাকে মুস্তাহাব বলে মনে করে। যারা ফর্সা করে ফজর আদায় করাকে মুস্তাহাব বলে মনে করে তারা এটা করবে না। তারা বরং উল্টোটা করবে। তারা অন্ধকারে আলো জ্বালিয়ে কৃত্রিম ফর্সা তৈরির চেষ্টা করবে।
মুহতারাম,
লেখক এই অধ্যায়ে মূলত ফজরের সালাত অন্ধকারে আদায় করা তথা তাগলীস বিল ফাজর যে মুস্তাহাব তা সহীহ হাদীস দ্বারা প্রমাণ করতে চাইছেন। আপনি জানেন যে, কারও কারও মতে ফজরকে ফর্সা করে আদায় করা তথা ইসফার বিল ফাজর মুস্তাহাব। লেখক এই দ্বিতীয় মতটির পক্ষের হাদীসগুলোকে জাল প্রমাণ করতে চাইছেন। এ জন্য তিনি শুরুতেই হযরত মুআজ ইবন জাবাল রা.-এর একটি হাদীস উপস্থাপন করেছেন যা দ্বিতীয় মতটিকে সমর্থন করে। লেখক বলছেন, হাদীসটি জাল। আমারও তাই মনে হয়। কিন্তু ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ এই হাদীসকে তাঁদের মতের পক্ষে দলীল হিসাবে কোথাও উপস্থাপন করেছেন বলে আমার জানা নাই। এই মতের অনুসারীদের কেউ বিচ্ছিন্নভাবে এটিকে দলীল হিসাবে উপস্থাপন করলে করতেও পারে কিন্তু তার দায় দায়িত্ব এই মতের প্রবক্তাগণের উপর কিংবা এই মতের অনুসারীদের সকলের উপর চাপানোকে আমি ন্যায়সংগত মনে করি না।
ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ যে সব সহীহ হাদীসকে তাঁদের মতের পক্ষে দলীল হিসাবে উপস্থাপন করে থাকেন লেখকের মতে সেসব হাদীসের অপব্যাখ্যা করা হয়েছে। এইজন্য তিনি এরপর ‘ছহীহ হাদীসের অপব্যাখ্যা’ নামে একটি শিরোনাম কায়েম করেছেন। এই শিরোনামের অধীনে তিনি রাফে‘ ইব্ন খাদীজ রা.-এর একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি এই-
عَنْ رَافِع بْنِ خَدِيْجٍ قَالَ سَمِعْتُ رَسُوْلَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَقُوْلُ أَسْفِرُوْا بِالْفَجْرِ فَإِنَّهُ أَعْظَمُ لِلْأَجْرِ
হাদীসটির প্রথম বাক্যের অনুবাদ তিনি করেছেন এইভাবে: ‘তোমরা ফজরের মাধ্যমে ফর্সা কর। অনুবাদের সামান্য হেরফেরে বাক্যের মর্ম ও উদ্দেশ্যের পরিবর্তন ঘটে যায়। মর্ম ও উদ্দেশ্যের পরিবর্তন ঘটানোর উদ্দেশ্যেই লেখক এইরূপ অনুবাদ করেছেন, না অনুবাদে অদক্ষতার কারণে বা আরবী ভাষায় দখল না থাকার কারণে এইরূপ অনুবাদ করেছেন তা আল্লাহই ভাল জানেন। সঠিক অনুবাদ এইরূপ হবে বলে আমি মনে করি: ‘তোমরা ফজরকে (তথা ফজরের সালাতকে) ফর্সায় উপণীত কর।’ কারণ, اسفار শব্দটি سفر হতে গঠিত। سفر অর্থ আলো ও উজ্জ্বলতা। বলা হয়, سفر الصبح (অর্থাৎ প্রভাত আলোকোজ্জ্বল হয়েছে।) বাবে ইফ্আলে এর অর্থ হল, প্রভাতের আলোকোজ্জ্বলতায় প্রবেশ করা, প্রভাতের আলোকোজ্জ্বলতায় উপণীত হওয়া। বলা হয়, اسفر بلال তথা دخل بلال فى سفر الصبح (অর্থাৎ বেলাল প্রভাতের আলোকোজ্জ্বলতায় প্রবেশ করেছে।) যেমন বলা হয় اصبح بلال (অর্থাৎ বেলাল প্রভাতে প্রবেশ করেছে, প্রভাতে উপণীত হয়েছে। তথা প্রভাত করেছে।) কুরআন মজীদে বলা হয়েছে: فسبحان الله حين تمسون و حين تصبحون [তোমরা আল্লাহর পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা কর যখন তোমরা সন্ধ্যা কর ও সকাল কর। (তথা সন্ধ্যায় ও সকালে।) - সূরা রূম, আয়াত ১৭] অতএব إسفار মাসদার হতে গঠিত আদেশ সূচক শব্দ أسفروا -এর অর্থ হল, তোমরা প্রভাতের আলোকোজ্জ্বলতায় প্রবেশ কর তথা ফর্সা কর। এরপর যখন بالصبح বলে حرف الجر -‘با’ (preposition) দ্বারা ক্রিয়াটিকে সকর্মক ক্রিয়া (متعدى) বা transitive verb-এ পরিণত করা হল তখন নিয়ম অনুযায়ী এর অর্থ হবে তোমরা ফজরের সালাতকে ফর্সায় উপণীত কর। এতদ্বারা ইসফার বিল ফাজর -এর প্রবক্তাগণের মতের পক্ষে সমর্থন মেলে।
এরপর লেখক এই হাদীসের সমার্থক আরেকটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। হাদীস দুটি ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ তাঁদের মতের সপক্ষে দলীল হিসাবে পেশ করে থাকেন। লেখক হাদীস দুটিকে সহীহ বলেছেন। কিন্তু তাঁর দাবি হল, ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ হাদীস দুটির অপব্যাখ্যা করে থাকেন। তাঁর এই দাবি প্রমাণ করার পূর্বে তিনি প্রসঙ্গত বলেছেন,‘ ‘হেদায়া’ কিতাবে প্রথম আলোচনায় সঠিক সময় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু পরে পৃথক আলোচনায় বলা হয়েছে, ويستحب الإسفار بالفجر ‘ফর্সা করে ফজর ছালাত আদায় করা মুস্তাহাব’। অথচ উক্ত ব্যাখ্যা চরম বিভ্রান্তিকর এবং ছহীহ হাদীসের প্রকাশ্য বিরোধী।’ (দ্রষ্টব্য পুস্তকের ১২৫নং পৃষ্ঠা)
হেদায়া প্রণেতা কী বলেছেন আর মুযাফফর সাহেব কী বুঝলেন
মুহতারাম,
লেখকের প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রেখে বলছি যে, হেদায়া কিতাবটি বুঝতে লেখকের একটুখানি স্খলন ঘটে গেছে। কারণ, হেদায়া প্রণেতা সালাত অধ্যায়ে প্রথমে সালাতের মূল ওয়াক্তের বিবরণ দান করেছেন। কোন্ সালাতের ওয়াক্ত কখন শুরু হয় আর কখন শেষ হয় তার বিবরণ দান করেছেন। বলেছেন :
أول وقت الفجر إذا طلع الفجرالثانى وهو البياض المعترض فى الأفق و آخر وقتها مالم تطلع الشمس
এইভাবে প্রতিটি সালাতের শুরু ও শেষ ওয়াক্ত বর্ণনা করার পর তিনি ভিন্ন অনুচ্ছেদে প্রতিটি সালাতের মুস্তাহাব ওয়াক্তের বিবরণ দান করেছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ويستحب الإسفار بالفجر ‘এবং মুস্তাহাব হল ফজরকে ইসফার করা।’ লেখকের মন্তব্য দ্বারা বোঝা যায় যে, হেদায়া প্রণেতা পরষ্পর বিরোধী দুইটি কথা বলেছেন। অথচ কোনোটির সাথে কোনোটির বিরোধ নেই। তাছাড়া লেখক বলেছেন. হেদায়া কিতাবে প্রথম আলোচনায় সঠিক সময় উল্লেখ করা হয়েছে। কিন্তু......।
প্রশ্ন হল, লেখক তো ফজরের মুস্তাহাব ওয়াক্ত নিয়ে আলোচনা করছেন। এ প্রসঙ্গে আলোচনা করতে গিয়ে তিনি বলছেন, হেদায়া কিতাবে প্রথমে সঠিক সময় উল্লেখ করা হয়েছে। তাহলে কি লেখকের মতে ফজরের
মুস্তাহাব ওয়াক্ত সুবহে সাদেক থেকে শুরু করে সূর্য উদিত হওয়া পর্যন্ত? সুবহানাল্লাহ! একমাত্র আল্লাহ তাআলাই সকল দোষ ত্রুটি হতে মুক্ত। লেখক তাঁর নিজের রচিত জালেই আটকে গেলেন।
লেখক বলছেন, উক্ত হাদীসের ভুল ব্যাখ্যা করে বলা হয় যে, ফর্সা হওয়ার পর ফজরের ছালাত শুরু করতে হবে। কারণ এটাই সর্বোত্তম। এরপর তিনি হেদায়ার প্রসঙ্গ টানার পর বলেছেন, অথচ উক্ত ব্যাখ্যা চরম বিভ্রান্তিকর এবং ছহীহ হাদীসের প্রকাশ্য বিরোধী। কারণ,-
(ক) ইমাম তিরমিযী (২০৯-২৭৯ হিঃ) উক্ত হাদীস বর্ণনা করে বলেন,
قَالَ الشَّافِعِىُّ وَأَحْمَدُ وَإِسْحَاقُ مَعْنَى الْإِسْفَارِ أَنْ يَّضِحَ الْفَجْرُ فَلَا يُشَكُّ فِيْهِ وَلَمْ يَرَوْا أَنَّ مَعْنَى الْإِسْفَارِ تَأْخِيْرُ الصَّلَاةِ
ইমাম শাফেঈ, আহমাদ ও ইসহাক্ব বলেন, ‘ইসফার’ হল, ফজর প্রকাশিত হওয়া, যাতে কোন সন্দেহ না থাকে। তারা কেউ বর্ণনা করেননি যে, ইসফার অর্থ ছালাত দেরী করে পড়া।
পর্যালোচনা:
দেখুন, লেখক দাবী করছেন উক্ত ব্যাখ্যা চরম বিভ্রান্তিকর এবং সহীহ হাদীসের প্রকাশ্য বিরোধী। কীভাবে সহীহ হাদীসের প্রকাশ্য বিরোধী হল তার কারণ বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি ইমাম তিরমিযী কর্তৃক উদ্ধৃত ইমাম শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাকের ব্যাখ্যার উল্লেখ করেছেন অতঃপর ইমাম তাহাবী ও শায়খ আলবানীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। কোনো সহীহ হাদীসের উদ্ধৃতি তিনি পেশ করেননি। তিনি সূক্ষ্মভাবে ইমাম শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাকের ব্যাখ্যা এবং ইমাম তাহাবী ও শায়খ আলবানীর বক্তব্যকে সহীহ হাদীস বলে চালিয়ে দিলেন। লেখকের ধারণায়, পাঠক তাঁর এই সূক্ষ্ম কৌশল অনুধাবন করতে পারবে না। এটা পাঠককে অবমূল্যায়ণ করার শামিল। আর আমানতের খিয়ানতের প্রশ্ন তো থেকেই যায়। তাছাড়া কারও বক্তব্যকে, কারও ব্যাখ্যাকে হাদীস বলা, তাও আবার সহীহ হাদীস? নাউযুবিল্লাহ। এটা তো হাদীস জাল করার নামান্তর।
ইমাম তিরমিযী রাহ. রাফে‘ ইবন খাদীজের রা. হাদীসটি উল্লেখ করার পর যা বলেছেন লেখক তার অর্ধেক উদ্ধৃত করেছেন আর অর্ধেক গোপন করে গেছেন। ইমাম তিরমিযীর পুরো কথাটি এইরূপ :
وَقَدْ رَأَى غَيْرُ وَاحدٍ مِنْ أَهْلِ الْعِلْمِ مِنْ أَصْحَابِ النَّبِيِّ صَلَّى الله عليه و سلم وَالتَّابِعِيْنَ اَلْإِسْفَارَ بِصَلَاةِ الْفَجْرِ وَبِهِ يَقُوْلُ سُفْيَانُ الثَّوْرِي وَقَالَ الشَّافِعِيُّ وَ أَحْمَدُ وَ إِسْحقُ مَعْنَى الْإِسْفَارِ أَنْ يَّضِحَ الْفَجْرُ فَلَا يُشَكُّ فِيْهِ وَلَمْ يَرَوْا أَنَّ مَعْنَى الْإِسْفَارِ تَأْخِيْرُ الصَّلَاةِ
অর্থাৎ নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাহাবীগণের মধ্য হতে এবং তাবেঈগনের মধ্য হতে একাধিক আহ্লে ইল্ম সাহাবী ও তাবেঈ ইসফার বিল ফাজ্র তথা ফজরকে ফর্সা করে আদায় করার মত পোষণ করেছেন। সুফ্ইয়ান সাওরীও এই মত ব্যক্ত করেন এবং ইমাম শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাক্ব বলেন... (উপরে দেখুন)
আসল ব্যাপার হল, ইমাম তিরমিযী রাহ. প্রথমে একটি অনুচ্ছেদে তাগলীস বিল ফাজর সংক্রান্ত হাদীস উল্লেখ করে ইমাম শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাকের মত উল্লেখ করেছিলেন যে, তাঁরা তাগলীস বিল ফাজরকে মুস্তাহাব বলেন। অতঃপর পরবর্তী অনুচ্ছেদে তিনি ইসফার বিল ফাজর সংক্রান্ত হাদীস উল্লেখ করে বললেন যে, একাধিক সাহাবী ও তাবিঈ - যাঁরা ইলমের অধিকারী- ইসফার বিল ফাজরের পক্ষে মত পোষণ করেন। এদিকে ইসফার বিল ফাজর সংক্রান্ত হাদীসটি যেহেতু ইমাম শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাকের মতের বিপক্ষে যায় সেহেতু তাঁদের নিকট এই হাদীসের কী ব্যাখ্যা আছে তা জানান দেওয়ার জন্য ইমাম তিরমিযী তাঁদের কৃত ব্যাখ্যাটি এখানে উল্লেখ করে দিলেন।
একাধিক আহলে ইলম সাহাবী ও তাবিঈ ইসফার বিল ফাজরকে মুস্তাহাব বলে মনে করেন। একাধিক অর্থ দুই চারজন নয়। দুই চারজন হলে ইমাম তিরমিযী তাঁদের নাম উল্লেখ করে দিতেন, যেমনটা উল্লেখ করেছেন তাগলীস বিল ফাজরের পক্ষে মত পোষণকারীগণের নাম। غير واحد বা একাধিক বলে সাধারণত প্রচুর সংখ্যক বোঝানো হয়। তাগলীস বিল ফাজরের পক্ষে মত পোষণকারী কোনো সাহাবী আছে কি নাই বা থাকলে তাদের সংখ্যা কী পরিমান সেটি ভিন্ন বিষয়। আমাদের আলোচনা চলছে ইমাম তিরমিযীর মন্তব্য নিয়ে। তো ইমাম তিরমিযীর বক্তব্য অনুযায়ী বহু সংখ্যক সাহাবী ও তাবিঈ ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তা। আমাদের দেশে বা পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় যাঁরা ফজরকে ইসফার তথা ফর্সা করে আদায় করাকে মুস্তাহাব বলে জ্ঞান করেন এবং সেই অনুযায়ী আমল করেন লেখকের বক্তব্য মতে তাঁরা যদি জাল হাদীসের ভিত্তিতে এবং সহীহ হাদীসের অপব্যাখ্যা করে এরূপ আমল করেন তাহলে ঐ সকল সাহাবী ও তাবিঈগণও কি জাল হাদীস অনুযায়ী আমল করতেন? তাঁরাও কি সহীহ হাদীসের অপব্যাখ্যা করে ইসফার বিল ফাজর করতেন? নাউযুবিল্লাহ। কথা বলতে বা লিখতে অসাবধানতাবশত ভুল হতেই পারে। কিন্তু তারও একটা মাত্রা থাকা উচিত। নইলে সেটাকে অসাবধানতাজনিত ভুল বলা যাবে না, ইচ্ছাকৃত জালিয়াতি ও ধৃষ্টতা বলতে হবে।
ইমাম শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাক্ব (রাহিমাহুমুল্লাহ) রাফে‘ ইবন খাদীজ রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীসের যে ব্যাখ্যা করেছেন সে সম্পর্কেও কিছু কথা আছে। তা যথাস্থানে আলোচিত হবে ইনশাআল্লাহ। লেখক এরপরে ইমাম তাহাবী ও শায়খ আলবানীর বক্তব্য উদ্ধৃত করেছেন। ইমাম তাহাবীর দুটি বক্তব্যের প্রথমটির অনুবাদ করতে গিয়ে লেখক বন্ধনী যুক্ত করে লিখেছেন, (উক্ত হাদীছের অর্থ হল)...। না, বক্তব্যটি হাদীসের অর্থ বা ব্যাখ্যা নয়। বরং এটি ইমাম তাহাবীর সিদ্ধান্ত। তিনি তাগলীস বিল ফাজর ও ইসফার বিল ফাজর সংক্রান্ত হাদীসসমূহের উপর পর্যালোচনা করার পর এই সিদ্ধান্ত ব্যক্ত করেছেন। হাঁ উদ্ধৃত দ্বিতীয় বক্তব্যটিতে ইমাম তাহাবী হাদীসের অর্থ ও মর্ম ব্যক্ত করেছেন। ইমাম তাহাবী রাহ. ও শায়খ আলবানী রাহ. উভয়ই ইসফার বিল ফাজর ও তাগলীস বিল ফাজর সংক্রান্ত সব হাদীসের আলোকে মত ব্যক্ত করে যা বলেছেন তার সার কথা হল, ফজরের সালাত শুরু করা উচিত অন্ধকারে এবং কিরাআত লম্বা করে শেষ করা উচিত ফর্সায়। এখানে লক্ষণীয় যে, ইমাম তাহাবী ও শায়খ আলবানী রাহ. কিন্তু ইমাম শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাকের ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করেননি।
লেখক এরপর ফজর ছালাতের সঠিক সময় শিরোনাম দিয়ে লিখেছেন, রাসূল (ছাঃ) কোন্ সময়ে ফজরের ছালাত আদায় করতেন , তা নিমেণর হাদীছগুলোতে বর্ণিত হয়েছে। যে সকল হাদীস এরপর তিনি উল্লেখ করেছেন সেগুলো বাহ্যত প্রমাণ করে যে, তাগলীস বিল ফাজর তথা অন্ধকারে ফজরের সালাত শুরু করা এবং অন্ধকার থাকতেই সালাত শেষ করা মুস্তাহাব। কিন্তু লেখক স্পষ্ট করেননি যে, তিনিও এইরূপ মত পোষণ করেন ও তদনুযায়ী আমল করেন, না তিনি ইমাম তাহাবী ও শায়খ আলবানী রাহ. যা বলেছেন সেইরূপ মত পোষণ করেন ও তদনুযায়ী আমল করেন। ইসফার বিল ফাজর-এর প্রবক্তাগণের ব্যাখ্যা যে অপব্যাখ্যা তা প্রমাণ করতে তিনি তো তাহাবী ও আলবানী (রাহিমাহুমাল্লাহ) -এর ব্যাখ্যাকেই পেশ করেছেন। বোঝা যায় যে, তাঁদের ব্যাখ্যাটি তাঁর নিকট গ্রহণযোগ্য। কাজেই লেখকের আমলও ঐরূপ হওয়া উচিত। কিন্তু তিনি ‘ফজর ছালাতের সঠিক সময়’ শিরোনামের অধীনে যেসব হাদীসের উদ্ধৃতি দিয়েছেন সেগুলোর সবই যেহেতু তাগলীস বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ তাঁদের মতের সপক্ষে দলীল হিসাবে উপস্থাপন করে থাকেন সেহেতু আমরা ধরে নিতে পারি যে, তিনি শায়খ আলবানীর তাকলীদ না করে এক্ষেত্রে এই মতই পোষণ করেন যে, ফজরের সালাত অন্ধকারে শুরু করে অন্ধকারেই শেষ করা মুস্তাহাব।
এর পক্ষে তিনি প্রথম যে হাদীসটি এনেছেন তা হযরত আয়েশা রা. কর্তৃক বর্ণিত। হাদীসটি এই-
عَنْ عَائِشَةَ ، قَالَتْ : إِنْ كَانَ رَسُولُ اللهِ صلى الله عليه وسلم لَيُصَلِّي الصُّبْحَ فَيَنْصَرِفُ النِّسَاءُ مُتَلَفِّعَاتٍ بِمُرُوطِهِنَّ مَا يُعْرَفْنَ مِنَ الْغَلَسِ
আয়েশা রা. বলেন, রাসূল (ছাঃ) ফজরের সালাত আদায় করতেন। অতঃপর মহিলারা চাদর মুড়ি দিয়ে ঘরে ফিরত। কিন্তু অন্ধকারের কারণে তাদেরকে চেনা যেত না।
আয়েশা রা. -এর এই একটি হাদীসকেই লেখক তিনবার এনেছেন তিনটি নম্বর লাগিয়ে। এটা একটা বড় বিপদ। প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে একাধিক কিতাবে বর্ণিত কিংবা একাধিক সনদে বর্ণিত একই হাদীসকে স্বতন্ত্র হাদীস হিসাবে উল্লেখ করে দেখানো যে, আমাদের পক্ষে এত এত হাদীস রয়েছে। অথচ হাদীস মাত্র একটিই।
যাকগে সে কথা। আসল কথায় আসি। আয়েশা রা. -এর হাদীসটি সম্পর্কে ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের বক্তব্য হল, হযরত আয়েশা রাঃ -এর বক্তব্য আসলে مايعرفن পর্যন্ত। অর্থাৎ হযরত আয়েশা রা. বলেছেন, ‘অতঃপর মহিলারা চাদর মুড়ি দিয়ে ঘরে ফিরে যেত, তাদেরকে চেনা যেত না।’ তাঁদের দাবি হল, হযরত আয়েশা রা. বলতে চাচ্ছেন যে, মহিলারা ফজরের সালাতে যখন আসত তখনও তারা পর্দার প্রতি কঠোর যত্নবান থাকত ফলে তারা যখন ফিরে যেত তখন তাদেরকে চাদর মুড়ি দেওয়া অবস্থায় থাকার কারণে চেনা যেত না। অর্থাৎ তাদেরকে না চেনার কারণ ছিল চাদর মুড়ি দেওয়া। অন্ধকার নয়। কিন্তু তাঁদের বিরূদ্ধে তখন প্রশ্ন দাঁড়ায় যে, হাদীসে তো স্পষ্ট বলা হয়েছে, من الغلس বা অন্ধকারের কারণে। তাঁরা বলেন যে, من الغلس বা ‘অন্ধকারের কারণে’ কথাটি হযরত আয়েশার নয়। বরং তা কোনো রাবীর সংযোজন, হাদীস শাস্ত্রের পরিভাষায় যাকে বলা হয় ইদরাজ এবং সংযোজিত অংশকে বলা হয় مُدرَجٌ مِنَ الرَّاوِىْ (মুদরাজ মিনার রাবী)। তাঁদের এই দাবির পÿÿ হাদীস থেকেই শক্তিশালী প্রমাণ খুঁজে পাওয়া যায়। কারণ, সুনানে ইব্ন মাজায় হাদীসটি বর্ণিত হয়েছে এইভাবে।
حَدَّثَنَا أَبُو بَكْرِ بْنُ أَبِي شَيْبَةَ ، حَدَّثَنَا سُفْيَانُ بْنُ عُيَيْنَةَ ، عَنِ الزُّهْرِيِّ ، عَنْ عُرْوَةَ ، عَنْ عَائِشَةَ ، قَالَتْ : كُنَّ نِسَاءُ الْمُؤْمِنَاتِ ، يُصَلِّينَ مَعَ النَّبِيِّ صَلَّى الله عَليْهِ وسَلَّمَ صَلاَةَ الصُّبْحِ ، ثُمَّ يَرْجِعْنَ إِلَى أَهْلِهِنَّ ، فَلاَ يَعْرِفُهُنَّ أَحَدٌ ، تَعْنِي مِنَ الْغَلَسِ.
অর্থ: হযরত আয়েশা বলেন, মুমিন নারীগণ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সংগে ফজরের সালাত আদায় করত অতঃপর তারা তাদের ঘরে ফিরে যেত, তাদেরকে কেউ চিনত না। তিনি (হযরত আয়েশা রা.) বোঝাতে চাচ্ছেন, অন্ধকারের কারণে।
হাদীসটির সনদ অত্যন্ত শক্তিশালী। হাদীসটিতে تعنى শব্দটি আমাদেরকে জানান দিচ্ছে যে, من الغلس শব্দটি হযরত আয়েশার নয়। কারণ, تعنى বা ‘তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন’ কথাটি হযরত আয়েশার হতে পারে না। হযরত আয়েশার হলে শব্দটি হত أعنى অর্থাৎ আমি বোঝাতে চাচ্ছি, অথবা এই জাতীয় কোনো শব্দই থাকত না। আসলে হযরত আয়েশা রা. এতটুকু পর্যন্ত বলেছেন, مَا يُعْرَفْنَ বা فَلَا يَعْرِفُهُنَّ أَحَدٌ (তাদেরকে চেনা যেত না বা তাদেরকে কেউ চিনত না)। পরবর্তী কোন রাবী মনে করেছেন যে, না চেনার কারণ হল, অন্ধকার। তাই তিনি ব্যাখ্যা করে বলে দিয়েছেন, হযরত আয়েশা বোঝাতে চাচ্ছেন, অন্ধকারের কারণে। এরপর আরও পরের কোন রাবী تعنى (তিনি বোঝাতে চাচ্ছেন) শব্দটিকে বাদ দিয়ে من الغلس শব্দটিকে রেখে হাদীস বর্ণনা করেছেন। ফলে হয়ে গিয়েছে ما يعرفن من الغلس ।
উপরিউক্ত দাবি সম্পর্কে কিছু প্রাসঙ্গিক কথা
এই ইদরাজ তথা হাদীসের মধ্যে রাবী কর্তৃক হাদীসের কোনো অংশের ব্যাখ্যা বা মন্তব্য অন্তর্ভুক্তির ঘটনা কিছু হলেও ঘটেছে। আল্লামা ইবন হাজার আসকালানী রাহ. আবূ হাতেমের সনদে ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বলের একটি উক্তি উদ্ধৃত করেছেন যে, ইমাম আহমাদ ইবন হাম্বাল বলেন,
كان وكيع يقول فى الحديث _ يعنى كذا وكذا _ وربما حذف "يعنى" وذكر التفسير فى الحديث
অর্থাৎ ওয়াকী‘ (বিখ্যাত মুহাদ্দিস) হাদীস বর্ণনা করতে গিয়ে বলতেন -অর্থাৎ এইরূপ এইরূপ- এবং অনেক সময় তিনি ‘অর্থাৎ’ কথাটিকে অনুচ্চারিত রেখেছেন এবং হাদীসের মাঝে স্বীয় ব্যাখ্যা উল্লেখ করে দিয়েছেন। আল্লামা ইবন হাজার আসকালানী বলেন,
وكذا كان الزهرى يفسر الأحاديث كثيرا وربما أسقط أداة التفسير فكان بعض أقرانه ربما يقول له: افصل كلامك من كلام النبى – صلى الله عليه وسلم-
অর্থাৎ, তদ্রূপ যুহরী অনেক সময় হাদীসের ব্যাখ্যা করতেন এবং ব্যাখ্যা নির্দেশক অব্যয়কে ছেড়ে দিতেন। এই কারণে তাঁর সঙ্গীদের কেউ একজন তাঁকে বলতেন, নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কথা হতে আপনার কথাকে পৃথক রাখুন। দ্রষ্টব্য: النكت على كتاب ابن الصلاح , বিশ নম্বর অধ্যায়, মুদরাজ সংক্রান্ত আলোচনা পৃষ্ঠা ৩৪৯।
তবে মুহাদ্দিসগণ বিভিন্ন নিদর্শনাবলী দ্বারা এইসব ইদরাজকে চিwহ্নতও করেছেন। উসূলে হাদীস ও মুহাদ্দিসগণের পরিভাষা সংক্রান্ত শাস্ত্রে এতদসম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা পাওয়া যায়।
মূল আলোচনায় প্রত্যাবর্তণ
তো ইবন মাজার হাদীসে تعنى শব্দটি প্রমাণ করে যে, من الغلس বা অন্ধকারের কারণে কথাটি কোনো রাবী কর্তৃক সংযোজিত, হযরত আয়েশার কথা নয়। ‘শরহু মাআনিল আছারে’ ইমাম তাহাবী রাহ. কর্তৃক তাখরীজকৃত একটি হাদীসে শব্দটির কোন অস্তিত্বই নাই। হাদীসটি এই :
حَدَّثَنَا يُونُسُ قَالَ: ثنا سُفْيَانُ بْنُ عُيَيْنَةَ , عَنِ الزُّهْرِيِّ , عَنْ عُرْوَةَ , عَنْ عَائِشَةَ رَضِيَ اللهُ عَنْهَا , قَالَتْ: " كُنَّا نِسَاءً مِنَ الْمُؤْمِنَاتِ يُصَلِّينَ مَعَ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَاةَ الصُّبْحِ , مُتَلَفِّعَاتٍ بِمُرُوطِهِنَّ , ثُمَّ يَرْجِعْنَ إِلَى أَهْلِهِنَّ , وَمَا يَعْرِفُهُنَّ أَحَدٌ
হাদীসটির সনদ অত্যন্ত শক্তিশালী। হাদীসটি ইদরাজের দাবিকে আরও জোরালো করে। কাজেই হযরত আয়েশার হাদীস দ্বারা তাগলীস বিল ফাজরের পক্ষে প্রমাণ গ্রহণ শক্তিশালী নয়, দুর্বল বলেই প্রতীয়মান হয়।
তাগলীস বিল ফাজরের পক্ষে লেখকের দ্বিতীয় দলীল
নাসাঈ ও মুসনাদে আহমাদের একটি হাদীস। হাদীসটি হযরত আনাস রা. কর্তৃক বর্ণিত।
পূর্বেই বলেছি যে, হযরত আয়েশা রা.-এর একটি হাদীসকেই লেখক তিনবার এনে তিনটি নম্বর লাগিয়েছেন। উদ্দেশ্য, পক্ষের দলীলের আধিক্য দেখানো। অতএব উক্ত হাদীসকে একটি দলীল হিসাবেই গণ্য করা উচিত। এজন্য আমি বলছি, লেখক চতুর্থ নম্বরে যে হাদীসটি পেশ করেছেন তা তাগলীস বিল ফাজরের পক্ষে তাঁর দ্বিতীয় দলীল। হাদীসটির শেষে বলা হয়েছে, وَالصُّبْحَ اِذَا طَلَعَ الْفَجْرُ إِلَى أَنْ يَنْفَسِحَ الْبَصَرُ (এবং ফজরের সালাত আদায় করতেন ফজর যখন উদিত হত তখন থেকে দৃষ্টি প্রসারিত হওয়া পর্যন্ত।)
হাদীসটি তাগলীস বিল ফাজরের পক্ষে দলীল হয় না । কারণ, ‘দৃষ্টি প্রসারিত হওয়া পর্যন্ত’ কথাটির অর্থ হল, ফর্সা হওয়া পর্যন্ত। হাদীসটির এক মর্ম হতে পারে এই যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম প্রতিদিন ফজর উদিত হওয়া থেকে শুরু করে দৃষ্টি প্রসারিত হওয়া পর্যন্ত সালাত দীর্ঘ করে সালাত আদায় করতেন। তাই যদি হয় তাহলে তাগলীস বিল ফাজর মুস্তাহাব প্রমাণিত হয় কী করে? তাগলীস বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের দাবি তো এই যে, অন্ধকারে শুরু করা এবং অন্ধকারেই শেষ করা মুস্তাহাব। অথচ হাদীসটি থেকে বোঝা যায়, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাত শুরু করতেন অন্ধকারে আর শেষ করতেন ফর্সা করে। হাদীসটির আরেকটি মর্মও হতে পারে। তা হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজর উদিত হওয়া থেকে শুরু করে দৃষ্টি প্রসারিত হওয়া পর্যন্ত সময়ের মধ্যে সালাত আদায় করতেন। কোনোদিন অন্ধকারে শুরু করে অন্ধকারে শেষ করতেন। কোনোদিন অন্ধকারে শুরু করে ফর্সা করে শেষ করতেন। কোনোদিন ফর্সা করে শুরু করে ফর্সা করে শেষ করতেন। এই মর্ম গ্রহণ করলেও হাদীসটি দ্বারা তাগলীস বিল ফাজর মুস্তাহাব প্রমাণিত হয় না।
পাঁচ নম্বরে উল্লেখকৃত লেখকের তৃতীয় দলীল
হযরত জাবের রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীস। হাদীসটির শেষে আছে والصُّبْحَ بِغَلَسٍ অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাত আদায় করতেন অন্ধকারে।
হাঁ, এই হাদীস দ্বারা বাহ্যত বোঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্ধকারে ফজর আদায় করতেন। তবে এই দলীল সম্পর্কে এই লেখার শেষ দিকে কিছু বলব ইনশাআল্লাহ।
উল্লেখ্য , লেখক হাদীসটির বরাত দিয়েছেন, ‘সহীহ আবু দাউদ হা/৩৯৭। অথচ হাদীসটি সহীহ বুখারীতে ও সহীহ মুসলিমেও আছে। (বুখারী হাদীস নং ৫৬৫, মুসলিম হাদীস নং ৬৪৬) কোনো হাদীস বুখারী ও মুসলিম শরীফে থাকলে তো কথাই নেই এতদুভয়ের কোন একটিতে থাকলেও অন্য কিতাবের বরাত দেওয়ার প্রয়োজন হয় না। প্রয়োজন হলেও সঙ্গে বুখারী ও মুসলিমের বরাত অবশ্যই দেওয়া হয়। তার কারণ ব্যাখ্যা করা নিষ্প্রয়োজন। সম্ভবত লেখকের খবরই নেই যে, হাদীসটি বুখারী ও মুসলিম শরীফে আছে। এই যদি লেখকের অবস্থা হয় তাহলে তাঁর মনে যা আসবে তাই তিনি লিখবেন এটাই স্বাভাবিক। তিনি সহীহ হাদীসের আলোকে আদায়কৃত সালাতকে, সাহাবী ও তাবেঈগণের সালাতকে জাল হাদীস দ্বারা আক্রান্ত মনে করবেন এটাই স্বাভাবিক। থাকুক সে কথা। আমাদের আলোচনায় ফিরে আসি।
ছয় নম্বরে উল্লেখকৃত লেখকের চতুর্থ দলীল
সহীহ বুখারীর এই হাদীস :
وَكَانَ يُصَلِّى الصُّبْحَ وَمَايَعْرِفُ أَحَدُنَا جَلِيْسَهُ الَّذِىْ كَانَ يَعْرِفُهُ وَكَانَ يَقْرَأُ فِيْهَا مِنَ السِّتِّيْنَ إِلَى الْمِأَةِ
অর্থাৎ রাসূল (ছাঃ) ফজরের ছালাত এমন সময়ে পড়তেন, যখন আমাদের কেউ পার্শেব বসা ব্যক্তিকে চিনতে পারত না, যাকে সে আগে থেকেই চিনে। তিনি ফজর ছালাতে ৬০ থেকে ১০০টি আয়াত তেলাওয়াত করতেন। (লেখকের অনুবাদ)
ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের পক্ষে পেশকৃত আবূ বার্যাহ আসলামী রা. কর্তৃক বর্ণিত বুখারী শরীফেরই একটি হাদীসের সঙ্গে আলোচ্য হাদীসটির বাহ্যত বিরোধ পরিলক্ষিত হচ্ছে। আবূ বারযাহ আসলামী রা-এর হাদীসটিকে আমার এই লেখনীতে ইসফার বিল ফাজরের পক্ষে চতুর্থ দলীল হিসাবে দেখানো হয়েছে। সেই হাদীসটিতে বলা হয়েছে,
وّكَانَ يَنْفَتِلُ مِنْ صَلَاةِ الْغَدَاةِ حِيْنَ يَعْرِفُ الرَّجُلُ جَلِيْسَهُ
(এবং তিনি ফজরের সালাত সম্পন্ন করতেন যখন ব্যক্তি তার পার্শেব উপবিষ্ট ব্যক্তিকে চিনতে পারত।) এই বিরোধ নিষ্পত্তির উপায় কী লেখক তা বলেননি। কেন বলেননি? এটিও তো বুখারীর হাদীস। তাহলে এটিকে আমলে না নিয়ে এটির বিরোধী হাদীসকে দলীল হিসাবে উপস্থাপন কি একদেশদর্শিতা নয়? আমরা অবশ্য এই বিরোধের নিষ্পত্তি কীভাবে হবে তা নিয়ে পরে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ।
সাত নম্বরে উল্লেখকৃত লেখকের পঞ্চম দলীল
তা হল, সুনানে আবু দাউদের একটি হাদীস। যাতে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একবার ফজরের সালাত অন্ধকারে আদায় করলেন অতঃপর একবার আদায় করলেন ইসফার করে। অতঃপর আমৃত্যু তাঁর সালাত ছিল অন্ধকারে। তিনি আর ইসফার করেননি।
লেখক হাদীসটির যে তরজমা করেছেন এবং অতঃপর যে মন্তব্য করেছেন তা নিয়ে পরে আলোচনা করব ইনশাআল্লাহ। তার পূর্বে হাদীসটি নিয়েই কিছু আলোচনা আছে।
এই হাদীসটি আসলে লম্বা একটি হাদীসের টুকরা। পুরো হাদীসটি এইরূপ:
حَدَّثَنَا مُحَمَّدُ بْنُ سَلَمَةَ الْمُرَادِىُّ حَدَّثَنَا ابْنُ وَهْبٍ عَنْ أُسَامَةَ بْنِ زَيْدٍ اللَّيْثِىِّ أَنَّ ابْنَ شِهَابٍ أَخْبَرَهُ أَنَّ عُمَرَ بْنَ عَبْدِ الْعَزِيزِ كَانَ قَاعِدًا عَلَى الْمِنْبَرِ فَأَخَّرَ الْعَصْرَ شَيْئًا فَقَالَ لَهُ عُرْوَةُ بْنُ الزُّبَيْرِ أَمَا إِنَّ جِبْرِيلَ -صلى الله عليه وسلم- قَدْ أَخْبَرَ مُحَمَّدًا -صلى الله عليه وسلم- بِوَقْتِ الصَّلاَةِ فَقَالَ لَهُ عُمَرُ اعْلَمْ مَا تَقُولُ.فَقَالَ عُرْوَةُ سَمِعْتُ بَشِيرَ بْنَ أَبِى مَسْعُودٍ يَقُولُ سَمِعْتُ أَبَا مَسْعُودٍ الأَنْصَارِىَّ يَقُولُ سَمِعْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- يَقُولُ « نَزَلَ جِبْرِيلُ -صلى الله عليه وسلم- فَأَخْبَرَنِى بِوَقْتِ الصَّلاَةِ فَصَلَّيْتُ مَعَهُ ثُمَّ صَلَّيْتُ مَعَهُ ثُمَّ صَلَّيْتُ مَعَهُ ثُمَّ صَلَّيْتُ مَعَهُ ثُمَّ صَلَّيْتُ مَعَهُ ». يَحْسُبُ بِأَصَابِعِهِ خَمْسَ صَلَوَاتٍ فَرَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- صَلَّى الظُّهْرَ حِينَ تَزُولُ الشَّمْسُ وَرُبَّمَا أَخَّرَهَا حِينَ يَشْتَدُّ الْحَرُّ وَرَأَيْتُهُ يُصَلِّى الْعَصْرَ وَالشَّمْسُ مُرْتَفِعَةٌ بَيْضَاءُ قَبْلَ أَنْ تَدْخُلَهَا الصُّفْرَةُ فَيَنْصَرِفُ الرَّجُلُ مِنَ الصَّلاَةِ فَيَأْتِى ذَا الْحُلَيْفَةِ قَبْلَ غُرُوبِ الشَّمْسِ وَيُصَلِّى الْمَغْرِبَ حِينَ تَسْقُطُ الشَّمْسُ وَيُصَلِّى الْعِشَاءَ حِينَ يَسْوَدُّ الأُفُقُ وَرُبَّمَا أَخَّرَهَا حَتَّى يَجْتَمِعَ النَّاسُ وَصَلَّى الصُّبْحَ مَرَّةً بِغَلَسٍ ثُمَّ صَلَّى مَرَّةً أُخْرَى فَأَسْفَرَ بِهَا ثُمَّ كَانَتْ صَلاَتُهُ بَعْدَ ذَلِكَ التَّغْلِيسَ حَتَّى مَاتَ وَلَمْ يَعُدْ إِلَى أَنْ يُسْفر
আলোচ্য হাদীসটি আন্ডার লাইন করা অংশের অংশ বিশেষ। আর এই আন্ডার লাইন করা অংশ তথা ওয়াক্তের বিশদ বিবরণ সম্বলিত অংশটুকুকে ইমাম আবু দাউদ রাহ. মা‘লূল বা দোষযুক্ত সাব্যস্ত করেছেন। কারণ, ইব্ন শিহাব যুহরীর শাগরেদদের মধ্য হতে এক উসামা ইব্ন যায়দ আল-লাইছী ব্যতীত আর কেউ এই অংশটুকু বর্ণনা করেন না। মা‘মার, ইমাম মালেক, সুফইয়ান ইব্ন উয়াইনাহ, শুআইব ইব্ন আবূ হামযাহ, লাইছ ইব্ন সা‘দসহ ইব্ন শিহাব যুহ্রীর অন্যান্য হাফেজে হাদীস শাগরেদগণ এই অংশটুকু বর্ণনা করেন না। আবার উরওয়া হতে হিশাম ইব্ন উরওয়া ও হাবীব ইব্ন আবূ মারযূকও যুহরীর এই শাগরেদগণের অনুরূপ বর্ণনা করেন। তাঁরা সকলেই يحسب باصابعه خمس صلوات পর্যন্ত বর্ণনা করেন। পরবর্তী অংশটুকু তাঁদের কেউই বর্ণনা করেন না। দেখুন, বুখারী ও মুসলিম রাহিমাহুমাল্লাহ তাঁদের গ্রন্থে হাদীসটি সন্নিবেশিত করেছেন কিন্তু তাঁদের কেউই এই অংশ সম্বলিত হাদীসটি গ্রহণ করেননি। তার কারণ, সম্ভবত এই ইল্লাত বা দোষ। ইমাম আবূ দাউদ রাহ.-এর মন্তব্যটি হুবহু তুলে ধরছি, দেখুন।
قَالَ أَبُو دَاوُدَ وَرَوَى هَذَا الْحَدِيثَ عَنِ الزُّهْرِىِّ مَعْمَرٌ وَمَالِكٌ وَابْنُ عُيَيْنَةَ وَشُعَيْبُ بْنُ أَبِى حَمْزَةَ وَاللَّيْثُ بْنُ سَعْدٍ وَغَيْرُهُمْ لَمْ يَذْكُرُوا الْوَقْتَ الَّذِى صَلَّى فِيهِ وَلَمْ يُفَسِّرُوهُ وَكَذَلِكَ أَيْضًا رَوَاهُ هِشَامُ بْنُ عُرْوَةَ وَحَبِيبُ بْنُ أَبِى مَرْزُوقٍ عَنْ عُرْوَةَ نَحْوَ رِوَايَةِ مَعْمَرٍ وَأَصْحَابِهِ
অতএব বোঝা গেল, আলোচ্য হাদীসটি উসামা ইবন যায়দ আল-লাইছীর শায বা দল-বিচ্ছিন্ন বর্ণনা। আর হাদীস সহীহ হওয়ার পথে দলবিচ্ছিন্নতা একটি বড় বাধা। যে সম্পর্কে পূর্বে আমি বিশদ আলোচনা করে এসেছি। কাজেই তাগলীস বিল ফাজরের পক্ষে দলীল হিসাবে এই হাদীসটিকে উপস্থাপন করা সঠিক বলে মনে করি না।
প্রসঙ্গত বলছি, লেখক হাদীসটির ثم صلى مرة اخرى فاسفر بها এই অংশের তরজমা করেছেন এইরূপ : ‘অতঃপর একবার পড়তে পড়তে ফর্সা করে দিয়েছিলেন।’ তরজমাটি ভুল বলে মনে হয়। অংশটির তরজমা এইরূপ হওয়া উচিত: অতঃপর আরেকবার তিনি সালাত আদায় করলেন, তো ফর্সা করে আদায় করলেন। লেখক এরপর লিখেছেন : উক্ত হাদীস প্রমাণ করে যে, একবার তিনি দীর্ঘ ক্বিরাআত করে ফর্সা করেছিলেন। যা সর্বাধিক উত্তম। এরপর থেকে অন্ধকার থাকতেই ছালাত শেষ করতেন।
বিস্ময়কর! যা সর্বাধিক উত্তম রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তা একবারমাত্র পালন করে সারাজীবন তা পরিহার করে গেলেন? হাঁ কোনো কারণে তা হতে পারে, কিন্তু কী সে কারণ? লেখক কেন তা উল্লেখ না করে এড়িয়ে গেলেন? এড়িয়ে গেলেন, না তার নিকট এ সম্পর্কে কোনো জ্ঞানই নেই? আল্লাহই ভাল জানেন।
তাগলীস বিল ফাজরের পÿÿ লেখকের পেশকৃত দলীলসমূহের আলোচনার একটি পর্যায় এখানে শেষ হল।
ইসফার বিল ফাজরের পক্ষে দলীল
এবার ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ যেসব হাদীসকে দলীল হিসাবে উপস্থাপন করে থাকেন সেগুলোর এদিক সেদিক নিয়ে আলোচনা করা যাক। তাঁদের একটি দলীল রাফে‘ ইবন খাদীজ রা. কর্তৃক বর্ণিত তিরমিযী শরীফের একটি হাদীস। লেখক যেটিকে সহীহ হাদীসের অপব্যাখ্যা শিরোনামে প্রথমেই উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি সহীহ। লেখক তা স্বীকারও করেছেন। তবে লেখকের দাবি হল, হাদীসটির অপব্যাখ্যা করা হয়েছে এবং এই প্রসঙ্গে তিনি যা বলেছেন তার এদিক সেদিক নিয়ে পূর্বে কিছুটা আলোচনা করেছি। অবশিষ্ট ছিল হাদীসটির যে ব্যাখ্যা ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ করে থাকেন তা কি অপব্যাখ্যা -লেখক যেমনটা বলেছেন - না যথার্থ ব্যাখ্যা তা নিয়ে আলোচনা এবং লেখক যে ব্যাখ্যাটিকে সহীহ বলছেন তা কতটুকু সহীহ তা নিয়ে আলোচনা।
اسفروا بالفجر এর ব্যাখ্যা : তাদের ও প্রতিপক্ষের
ইমাম শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাক (রাহিমাহুমুল্লাহ)কৃত যে ব্যাখ্যার উদ্ধৃতি ইমাম তিরমিযী দিয়েছেন তা নানাবিধ কারণে প্রশ্নবিদ্ধ বলে মনে হয়।
কারণ, প্রথমত : ব্যাখ্যাটি হাদীসের স্পষ্ট শব্দানুগ নয়। শব্দ হতে প্রথমেই যা বোঝা যায় তা হল, তোমরা ফজরের সালাতকে ফর্সায় উপণীত কর। ফর্সা করে সালাত আদায় কর। এ সম্পর্কে পূর্বে আমি বিশদ আলোচনা করে এসেছি।
দ্বিতীয়ত : তাঁদের কৃত ব্যাখ্যাটির সার কথা হলো, তোমরা ফজর তথা সুবহে সাদিককে স্পষ্ট কর যাতে কোনো সন্দেহ না থাকে। অর্থাৎ সুবহে সাদিক উদিত হয়েছে কিনা সে ব্যাপারে নিশ্চিত হও, তারপর সালাত আদায় কর। সুবহে সাদিক উদিত হয়েছে - এটা নিশ্চিত না হলে সালাত আদায় করো না। এই ব্যাখ্যা গ্রহণ করলে হাদীসে বর্ণিত -فَإِنَّهُ أَعْظَمُ لِلْأَجْرِ - (কারণ, তা সওয়াবের জন্য সর্বোত্তম বা তা বৃহৎ সওয়াব আনয়ণকারী-) রাসূলের এই কথাটির কোনো যথার্থতা থাকে না। কেননা, সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত না হয়ে সালাত আদায় করলে তো কিছুমাত্র সওয়াব হবে না, অধিক সওয়াব তো দূরের কথা। কারণ, তখন সালাত শুদ্ধই হবে না। আমল শুদ্ধ হবার পর আমলে সুন্নাত ও মুস্তাহাব জাতীয় কিছু সংযুক্ত হবার কারণে যখন আমলে অতিরিক্ত কিছু মাত্রা যোগ হয় তখনই তাতে অধিক সওয়াব লাভ হয়। আমল যদি শুদ্ধই না হয় তাহলে ঐ আমলের জন্য নির্ধারিত মূল সওয়াবই তো লাভ হবে না, অধিক সওয়াব আসবে কোত্থেকে? অথচ উক্ত ব্যাখ্যা অনুযায়ী বোঝা যায় যে, সুবহে সাদিক হওয়ার ব্যাপারটি নিশ্চিত হয়ে সালাত আদায় করলে অধিক সওয়াব লাভ হবে আর নিশ্চিত না হয়ে সালাত আদায় করলে অধিক সওয়াব না হলেও আসল সওয়াব লাভ হবে। লক্ষ করলেন নিশ্চয়ই ব্যাখ্যাটির ফল কী দাঁড়াল? বিষয়টি একজন সাধারণ লোকেরও বোঝার কথা, আর আপনি তো অত্যন্ত মেধাবী আলেম।
তৃতীয়ত : সুনানে নাসাঈতে একটি হাদীস আছে এইরূপ - مَا أَسْفَرْتُمْ بِالْفَجْرِ فَإِنَّهُ أَعْظَمُ بِالْأَجْرِ (তোমরা যতবেশী ফজরকে ইসফার করবে ততবেশী তা অধিক সওয়াবের কারণ হবে। হাদীস নং-৫৪৯) শায়খ আলবানী বলেছেন, صحيح الإسناد অর্থাৎ হাদীসটির সনদ সহীহ।
কথাটি আরও স্পষ্টরূপে ব্যক্ত হয়েছে আল্লামা হাফেয ইবন হাজার আসকালানীর أَلْمَطَالِبُ الْعَالِيَةُ গ্রন্থে মুসনাদে মুহাম্মাদ ইব্ন ইয়াহইয়া আল-আদানীর বরাতে সন্নিবেশিত এই হাদীস দ্বারা - أَصْبِحُوْا بِصَلَاةِ الصُّبْحِ فَإِنَّكُمْ كُلَّمَا أَصْبَحْتُمْ بِهَا كَانَ أَعْظَمَ لِلأَجْرِ (তোমরা ফজরের সালাতকে আলোকিত করে আদায় কর। কেননা, যতবেশী আলোকিত করবে ততই তা অধিক সওয়াবের কারণ হবে। হাদীস নং- ২৯৫)
সহীহ ইব্ন হিববানে রাফে‘ ইবন খাদীজ রা. -এর হাদীসটি এই শব্দে বর্ণিত হয়েছে - أَصْبِحُوْا بِالصُّبْحِ فَإِنَّكُمْ كُلَّمَا أَصْبَحْتُمْ بِالصُّبْحِ كَانَ أَعْظَمَ لِأُجُوْرِكُمْ (তোমরা ফজরের সালাতকে আলোকিত করে আদায় কর। কেননা তোমরা ফজরের সালাতকে যত বেশী আলোকিত করে আদায় করবে ততই তা তোমাদের সওয়াব বৃদ্ধির কারণ হবে। হাদীস নং- ১৪৮৯)
এই সব হাদীস প্রতিপক্ষের ব্যক্ত ব্যাখ্যাকে (যে ব্যাখ্যা ইমাম তিরমিযী রাহ. উদ্ধৃত করেছেন) অসার প্রমাণ করে। কেননা ফজর বা সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার ঘটনাটি প্রলম্বিত হওয়ার মত ঘটনা নয়। বিষয়টি এরকম নয় যে, ফজর বা সুবহে সাদিক একটু উদিত হলে ফজরের ওয়াক্ত একটু শুরু হয়, সালাত একটু শুদ্ধ হয় আর একটু একটু করে যতবেশী উদিত থাকে সালাতও ততবেশী শুদ্ধ হতে থাকে আর সওয়াবও ততবেশী বৃদ্ধি পেতে থাকে। না বিষয়টি এরকম নয়। কাজেই হাদীসের অর্থ যদি তেমনটাই হয় যেমনটা তাগলীস বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ বলেছেন তাহলে
فإنه أعظم للأجر
বা
كلما أصبحتم بها كان أعظم للأجر
এবং
كلما أصبحتم بالصبح كان أعظم لأجوركم
রাসূলের এই কথাগুলোর কোনো অর্থ থাকে না। জানি না তাগলীস বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ এই সকাল করবে ততই তা তোমাদের সওয়াব বৃদ্ধি
হাদীসের কী ব্যাখ্যা করবেন।
চতুর্থত : লেখক মুসনাদে তায়ালিসীর একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বেলাল রা.-কে নির্দেশ দেন - أَسْفِرْ بِصَلَاةِ الصُّبْحِ حَتَّى يَرَى الْقَوْمُ مَوَاقِعَ نَبْلِهِمْ । লেখক শায়খ আলবানীর মন্তব্যও উল্লেখ করেছেন যে, শায়খ আলবানী বলেন, وهذا إسناد صحيح إن شاء الله । আল্লাহ চাহেন তো এটি সহীহ সনদ।
লক্ষ করুন, হাদীসটিতে বলা হয়েছে- সালাতে সুব্হকে এমনভাবে ইসফার বা আলোকিত কর, যেন লোকেরা তাদের নিক্ষিপ্ত তীর কোথায় পতিত হল তা দেখতে পায়। হাদীসটি ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণেরই পÿÿ যায়। ইসফার বিস্ সুবহের অর্থ যদি তেমনটাই হয় যেমনটা তাগলীস বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ বলেন, তাহলে এই হাদীসের অর্থ দাঁড়ায়- তুমি সুবহে সাদিক এমনভাবে উদিত কর যাতে লোকেরা তাদের নিক্ষিপ্ত তীর কোথায় পতিত হল তা দেখতে পায়। সুবহানাল্লাহ! তাহলে অন্ধকারে সালাত আদায় করা মুস্তাহাব তো দূরের কথা, বৈধ হওয়াই মুশকিল। কেননা, তাঁদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী নিক্ষিপ্ত তীর কোথায় পতিত হল তা দেখতে না পাওয়া গেলে তো সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার ব্যাপারটি সন্দেহযুক্ত থেকে যাবে, নিশ্চিত হবে না। ফলে তার পূর্বে ফজরের সালাতও আদায় করা যাবে না।
এই হাদীসে আরেকটি বিষয় লÿ করম্নন। হাদীসে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে بصلاة الصبح । الصبح বা الفجر শব্দ নয়। শেষোক্ত শব্দ দুটির অর্থ ‘সুবহে সাদিক’ হতে পারে আবার ‘ফজরের সালাত’ও হতে পারে কিন্তু প্রথমোক্ত শব্দটি শুধু ‘ফজরের সালাত’ অর্থ নির্দেশ করে। তাগলীস বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ ইসফারের যে ব্যাখ্যা করেছেন তা এই হাদীসের সাথে কোনোভাবেই মেলানো যায় না। কারণ, তাঁরা ইসফারের অর্থ করেছেন সুবহে সাদিক এমনভাবে স্পষ্ট হওয়া যাতে কোনো সন্দেহ না থাকে। এখানে সুবহে সাদিকের কথা বলা হয় নি সালাতে সুব্হ বা ফজরের সালাতের কথা বলা হয়েছে। একে তো হাদীসটিতে এতটুকু ইসফারের কথা বলা হয়েছে যাতে নিক্ষিপ্ত তীরের গন্তব্যস্থল দেখতে পাওয়া যায় তার উপর আবার শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ‘বিসালাতিস্ সুবহি’। আর এ কারণেই তাগলীস বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ ইসফারের যে ব্যাখ্যা করেছেন সেই ব্যাখ্যাটি যে হযরত বেলালের এই হাদীসটির কারণেই অগ্রহণযোগ্য তা হাফেজ ইবন হাজার আসকালানীও স্বীকার করেছেন। মনে রাখতে হবে যে, হাফেজ ইবন হাজার আসকালানী রাহ. শাফিঈ মাযহাবের অনুসারী ছিলেন এবং শাফিঈ মাযহাবের পক্ষে অন্যতম ব্যারিস্টার ছিলেন। তিনি স্বীয় ইমাম ইমাম শাফিঈ ও আহমাদ ও ইসহাকের এই ব্যাখ্যা উল্লেখ করার পর বলেন,
وَيَرُدُّهُ رِوَايَةُ إِبْنُ أَبِىْ شَيْبَةَ وَ إِسْحَاقَ وَغَيْرِهِمَا بِلَفْظِ ثَوِّبْ بِصَلَاةِ الصُّبْحِ يَا بِلَالُ حَتّى يُبْصِرَ الْقَوْمُ مَوَاقِعَ نَبْلِهِمْ
অর্থাৎ এই ব্যাখ্যাটিকে খন্ডন করে দেয় ইব্ন আবি শাইবা, ইসহাক প্রমূখের রেওয়ায়েত এই শব্দে- ثوب بصلاة الصبح يا بلال حتى يبصر القوم مواقع نبلهم (হে বেলাল, ফজরের সালাতের ইকামত দাও এমন সময়ে যাতে লোকেরা তাদের নিক্ষিপ্ত তীরের আপতনস্থল দেখতে পায়। (দ্রষ্টব্য আত্ তালখীসুল হাবীর, ২৬১ নং হাদীসের অধীনে আলোচনা।)
হাফেজ সাহেব হাদীসটির সনদে কোন আপত্তি উত্থাপন করেননি। বোঝা যায় হাদীসটি তাঁর মতে সহীহ।
তবে হাফেজ সাহেব এরপর কিছুটা দুর্বল ভাষায় বলেছেন
لَكِنْ رَوَى الْحَاكِمُ مِنْ طَرِيقِ اللَّيْثِ عَنْ أَبِي النَّضْرِ عَنْ عَمْرَةَ عَنْ عَائِشَةَ قَالَتْ: مَا صَلَّى رَسُولُ الله صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ بالصلاة لِوَقْتِهَا الْآخِرِ حَتَّى قَبَضَهُ اللَّهُ.
(কিন্তু হাকেম তাঁর সনদে আয়েশা রা. হতে বর্ণনা করেন, আয়েশা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো সালাতকে তার শেষ ওয়াক্তে আদায় করেননি।) হাফেজ সাহেব বলতে চাচ্ছেন, হযরত বেলালের প্রতি ইসফারের নির্দেশ সম্বলিত হাদীসটি ইমাম শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাকের ব্যাখ্যাকে খন্ডন করে ঠিক কিন্তু তা হযরত আয়েশার এই হাদীসের বিরোধী। এটি হাফেজ সাহেবের পক্ষ হতে হযরত বেলালের প্রতি নির্দেশ সম্বলিত হাদীসটির প্রতি একটি আপত্তি। কিন্তু ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের নিকট এই আপত্তির শক্তিশালী জবাব আছে এবং তাঁদের নিকট হাদীস দুটির বাহ্য বিরোধের মীমাংসাও আছে। তাঁরা এই আপত্তির জবাবে বলেন, আসলে হাদীস দুটির মাঝে কোনো বিরোধ নেই। কারণ, হযরত আয়েশা রা.-এর হাদীসের অর্থ হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কোনো সালাতকে একদম শেষ ওয়াক্তে আদায় করেননি যাতে সালাত ফউত হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। আর ইসফার সেইরকম শেষ ওয়াক্ত নয়। কারণ ইসফার করে সালাত শুরু করে সুন্নত কিরাআতের মাধ্যমে সালাত শেষ করার পরও কমপক্ষে পনের থেকে বিশ মিনিট সময় অবশিষ্ট থাকে সূর্য উদিত হতে।
ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের ব্যাখ্যাকে লেখক অপব্যাখ্যা বলেছেন। হাদীসটির সঠিক ব্যাখ্যা কোনটি তা তিনি বলেননি। তিনি ইমাম শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাকের ব্যাখ্যা ও ইমাম তাহাবী ও শায়খ আলবানী রাহ.- এর ব্যাখ্যা উল্লেখ করেছেন। অথচ ইমাম শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাকের ব্যাখ্যা এবং ইমাম তাহাবী ও শায়খ আলবানীর ব্যাখ্যা দুইটির মাঝে বিস্তর ভিন্নতা রয়েছে। এই উভয় ব্যাখ্যা একই সাথে সঠিক হতে পারে না । লেখক যদি একই সাথে এই উভয় ব্যাখ্যাকে সঠিক মনে করেন তাহলে ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের ব্যাখ্যাকে কেন সঠিক মনে করবেন না? অথচ তাঁদের ব্যাখ্যাটি ইমাম তাহাবী ও শায়খ আলবানীর ব্যাখ্যার কাছাকাছি। যা হোক, আমরা বোধ হয় প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে, ইমাম শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাকের ব্যাখ্যা হাদীসটির যথোপযুক্ত ব্যাখ্যা নয়। হাঁ ইমাম তাহাবী ও শায়খ আলবানী রাহ. কর্তৃক কৃত ব্যাখ্যা হাদীসটির শব্দ ও ভাষার সঙ্গে মোটামোটি সংগতিপূর্ণ। কিন্তু অন্যান্য হাদীসের আলোকে বলতে হয় যে, ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের ব্যাখ্যাই অধিক সংগতিপূর্ণ। দেখুন, হাফেজ ইবন হাজার আসকালানী রাহ. ইব্ন আবি শাইবার যে হাদীসটির প্রেক্ষিতে ইমাম শাফিঈ, আহমাদ ও ইসহাকের ব্যাখ্যাকে মারদূদ ও প্রত্যাখ্যাত বলেছেন সেই হাদীসটিতে শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে ثوب بصلاة الصبح يا بلال حتى يبصر القوم مواقع نبلهم (ফজরের সালাতের ইকামত দাও হে বেলাল, এমন সময়ে যেন লোকেরা তাদের তীর কোথায় নিক্ষিপ্ত হল তা দেখতে পায়।) এতদ্বারা বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসফার করেই ফজর শুরু করতে চাচ্ছেন। এই হাদীসটির অন্যান্য বর্ণনায় نَوِّرْ শব্দ রয়েছে যা أسفر শব্দের সমার্থক। أسفر শব্দটিরই বহুবচন اسفروا । যা ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের পক্ষের প্রথম হাদীসের শব্দ। হাদীসটির অর্থ নিয়ে পূর্বে আলোচনা করেছি যে, এর অর্থ হল, তোমরা ফজরের সালাতকে ফর্সায় উপণীত কর। এর ব্যাখ্যা দুই রকম হতে পারে। এক: যেমনটা ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ বলেছেন। অর্থাৎ তোমরা ফজরের সালাতকে ফর্সায় শুরু করে ফর্সায় শেষ কর। দুই: যেমনটা ইমাম তাহাবী ও শায়খ আলবানী বলেছেন। অর্থাৎ তোমরা ফজরের সালাতকে অন্ধকারে শুরু করে ফর্সায় শেষ কর। সেই হিসাবে نَوِّرْ শব্দ সম্বলিত হযরত বেলাল রা. -এর হাদীসটিও এই দুই ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে বলে কেউ দাবি করতে পারে। কিন্তু মুহতারাম, আমার মতে হযরত বেলাল রা. -এর হাদীসটি এই উভয় ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। কারণ, এখানে সম্বোধন করা হয়েছে হযরত বেলালকে যে, তুমি ফজরকে ফর্সায় উপণীত কর। সম্বোধনটি সাধারণের উদ্দেশে নয়। বিশেষভাবে হযরত বেলালকে সম্বোধন করার উদ্দেশ্য এ ছাড়া আর কিছু নয় যে, বেলাল যেন ফর্সা করে সালাতের একামত দেয়। যুহর সালাতের ক্ষেত্রে যেমন হযরত বেলালকে সম্বোধন করে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, أَبْرِدْ بِالظُّهْرِ (যুহরকে ঠান্ডায় উপণীত কর) অর্থাৎ ঠান্ডা হওয়ার পর যুহরের একামত দাও। এ ছাড়া ثوب শব্দটি স্পষ্টভাবেই আমাদেরকে জানান দিচ্ছে যে, হযরত বেলালকে ফর্সা করে সালাতের একামত দিতে বলা হচ্ছে। সুতরাং হাদীসটি ফর্সা করে সালাত শুরু করার পক্ষে শক্তিশালী দলীল হয় বলে আমি মনে করি এবং এই হাদীসটিই أسفروا শব্দ সম্বলিত হাদীসটির সম্ভাব্য দুটি ব্যাখ্যার মধ্য হতে ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের ব্যাখ্যাকে নির্দিষ্ট করে দেয় এবং ইমাম তাহাবী ও শায়খ আলবানীর ব্যাখ্যার সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেয়। আল্লাহু আ‘লাম।
মুহতারাম,
ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ যে সকল হাদীসকে তাঁদের মতের পক্ষে দলীল হিসাবে উপস্থাপন করে থাকেন লেখক তন্মধ্য হতে দুটি হাদীস উল্লেখ করেছেন। হাদীস দুটি সম্পর্কে তাগলীস বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের বক্তব্য নিয়ে দীর্ঘ আলোচনার ফাঁকে সুনানে নাসাঈ, মুসনাদে মুহাম্মাদ ইয়াহইয়া আল-আদানীর বরাতে আল-মাতালিবুল ‘আলিয়া ও ইব্ন হিববানের যে হাদীস তিনটির প্রসঙ্গ এসেছে সেগুলোও ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের দলীল এবং সেগুলো তাঁদের তৃতীয় দলীল।
ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের চতুর্থ দলীল
বুখারী শরীফের হযরত আবূ বারযাহ আল আসলামী রা. -এর একটি লম্বা হাদীস। যেটিতে তিনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সালাতের বিবরণ দিতে গিয়ে বলেন, وَكَانَ يَنْفَتِلُ مِنْ صَلَاةِ الْغَدَاةِ حِيْنَ يَعْرِفُ الرَّجُلً جَلِيْسَهُ আর তিনি (রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ফজরের সালাত সম্পন্ন করতেন যখন ব্যক্তি তার পার্শ্বে উপবিষ্ট ব্যক্তিকে চিনতে পারত। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ৫৪৭)
দেখুন, মসজিদে নববীর দেয়াল ছিল মাটির এবং উচ্চতা ছিল স্বল্প। অর্থাৎ মসজিদের অভ্যন্তর ছিল অত্যন্ত সংকীর্ণ। এতদসত্ত্বেও সালাত শেষে মসজিদের অভ্যন্তরে একজন যখন তার পাশের ব্যক্তিকে চিনতে পারত তখন বোঝা যায় যে, মসজিদের ভিতরটা তখন আলোকিত হয়ে যেত। তাহলে মসজিদের বাইরে তখন নিশ্চয়ই আরও বেশী আলোময় হয়ে উঠত, নয় কি? অতএব হাদীসটি দ্বারা বুঝা যায় যে, সালাত শেষ করা হয়েছিল ফর্সা করে। তবে ইসফার বা ফর্সা করে ফজর শুরু করা হয়েছিল কি না তা হাদীস দ্বারা স্পষ্ট নয়। কাজেই আমার দৃষ্টিতে হাদীসটি ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের পক্ষে শক্তিশালী দলীল নয়। তবে হাদীস দ্বারা এতটুকু তো স্পষ্ট যে, সালাত যখন শেষ করা হয়েছিল তখন আকাশ বেশ ফর্সা হয়ে গিয়েছিল। কাজেই হাদীসটি তাগলীস বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের বিরুদ্ধে শক্তিশালী দলীল অবশ্যই। কারণ, তাঁদের দাবি হল, ফজর অন্ধকারে শুরু করে অন্ধকারেই শেষ করা মুস্তাহাব। তাহলে এই হাদীসের কী জবাব তাঁরা দেবেন ?
পঞ্চম দলীল : হযরত আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রা.-এর একটি হাদীস। হাদীসটি বুখারী, মুসলিম ও আবূ দাউদের হাদীস। আবূ দাউদে হাদীসটি এভাবে আছে -
عَنِ ابْنِ مَسْعُودٍ قَالَ مَا رَأَيْتُ رَسُولَ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- صَلَّى صَلاَةً إِلاَّ لِوَقْتِهَا إِلاَّ بِجَمْعٍ فَإِنَّهُ جَمَعَ بَيْنَ الْمَغْرِبِ وَالْعِشَاءِ بِجَمْعٍ وَصَلَّى صَلاَةَ الصُّبْحِ مِنَ الْغَدِ قَبْلَ وَقْتِهَا
আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসউদ রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে কখনও দেখিনি কোনো সালাতকে তার সময় ব্যতীত অন্য সময়ে আদায় করতে। মুযদালিফায় ছিল এর ব্যতিক্রম। কেননা তিনি মুযদালিফায় মাগরিব ও এশাকে একসাথে আদায় করেছেন (ফলে মাগরিব আদায় হয়েছে তার সময় ছাড়া এশার সময়ে) এবং পরবর্তী সকালে তিনি ফজর আদায় করেছেন ফজরের ওয়াক্তের পূর্বে। (আবূ দাউদ, হাদীস নং ১৯৩৬ )
বুখারীর হাদীসটি দেখুন এইভাবে এসেছে-
عَنْ عَبْدِ اللهِ ، رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ ، قَالَ مَا رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم صَلَّى صَلاَةً بِغَيْرِ مِيقَاتِهَا إِلاَّ صَلاَتَيْنِ جَمَعَ بَيْنَ الْمَغْرِبِ وَالْعِشَاءِ وَصَلَّى الْفَجْرَ قَبْلَ مِيقَاتِهَا
‘আব্দুলস্নাহ ইবন মাসউদ রা. বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দেখিনি কোনো সালাতকে তার ওয়াক্ত ছাড়া আদায় করতে। দুটি সালাত ব্যতীত । তিনি মাগরিব ও এশাকে একসাথে আদায় করলেন এবং ফজর আদায় করলেন তার ওয়াক্তের পূর্বে। (সহীহ বুখারী, হাদীস নং ১৬৮২)
লক্ষ করুন, হাদীসটিতে বলা হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় ফজর আদায় করেছেন ফজরের ওয়াক্তের পূর্বে। এদিকে এটা সর্বসম্মত যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় ফজর আদায় করেছেন সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পরে, পূর্বে নয়। তাহলে ‘ওয়াক্তের পূর্বে, কথাটির অর্থ কী? ফকীহ ও মুহাদ্দিসগণের সর্ববাদীসম্মত অভিমত এই যে, এর অর্থ হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত যে ওয়াক্তে ফজর আদায় করতেন তার পূর্বে। এর দ্বারা বোঝা গেল যে, রাসূল সাধারণত ইসফার করে ফজর আদায় করতেন। কারণ, তিনি যদি অন্ধকারে সাধারণত ফজর আদায় করতেন তাহলে তার পূর্বের ওয়াক্তটি হত সুবহে সাদিকের পূর্বে। অথচ আমরা একটু পূর্বে বলে এসেছি যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় ফজর আদায় করেছেন সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পরে, পূর্বে নয়।
হাদীসটি আরও স্পষ্ট ও মজার ভাষায় বুখারী শরীফে বর্ণিত হয়েছে। ১৬৭৫ নং হাদীসে আব্দুল্লাহ ইবন মাসউদ রা.-এর উক্তি বর্ণিত হয়েছে এইভাবে -
فَالَ عَبْدُ اللهِ هُمَا صَلاَتَانِ تُحَوَّلاَنِ عَنْ وَقْتِهِمَا صَلاَةُ الْمَغْرِبِ بَعْدَ مَا يَأْتِي النَّاسُ الْمُزْدَلِفَةَ وَالْفَجْرُ حِينَ يَبْزُغُ الْفَجْرُ قَالَ رَأَيْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَفْعَلُهُ
অব্দুল্লাহ ইব্ন মাসউদ রা. বলেন, দুটো সালাতকে তার ওয়াক্ত হতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। মাগরিবের সালাত লোকেরা মুযদালিফায় আসার পরে এবং ফজরের সালাত যখন ফজর বা সুবহে সাদিক উদিত হয়। তিনি বলেন, আমি নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে এইরূপ করতে দেখেছি।
আর ১৬৮৩ নং হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর উক্তি বর্ণিত হয়েছে এইভাবে-
إِنَّ رَسُولَ اللهِ صلى الله عليه وسلم قَالَ : إِنَّ هَاتَيْنِ الصَّلاَتَيْنِ حُوِّلَتَا عَنْ وَقْتِهِمَا فِي هَذَا الْمَكَانِ الْمَغْرِبَ وَالْعِشَاءَ فَلاَ يَقْدَمُ النَّاسُ جَمْعًا حَتَّى يُعْتِمُوا وَصَلاَةَ الْفَجْرِ هَذِهِ السَّاعَةَ
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম (সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পর) বললেন, এই দুই সালাতকে তাদের ওয়াক্ত হতে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে এই জায়গায় (তথা মুযদালিফায়) মাগরিব ও এশা, অতএব রাত না করে লোকেরা মুযদালিফায় আসবে না। আর ফজরের সালাতকে এই সময়ে।
উল্লেখ্য, হাদীসটিকে ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের পক্ষে একটি শক্তিশালী দলীল বলে মনে করা হয়। ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ যে হাদীসকে নিজেদের পক্ষে দলীল হিসাবে উপস্থাপনই করেন না সেইরূপ একটি জাল হাদীস অনুযায়ী আমল করার অভিযোগ উত্থাপন করে লেখক সেটিকে উদ্ধৃত করলেন অথচ ইসফারের পক্ষের এই হাদীসটিকে তিনি উল্লেখ করলেন না। লেখকের এই আচরণের কারণ অজ্ঞতা না জ্ঞানপাপিতা, তা বোঝা গেল না। আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষমা করুন।
মুহতারাম, তাগলীস বিল ফাজর ও ইসফার বিল ফাজর - এই উভয় মতের পক্ষের ও বিপক্ষের হাদীস, ব্যাখ্যা ও যুক্তি প্রমাণ নিয়ে আমার দীর্ঘ আলোচনার পর নিশ্চয়ই আপনি যথাযথভাবেই উপলব্ধি করতে পারছেন যে, ‘জাল হাদীছের কবলে রাসূলুল্লাহর ছালাত’ নামক পুস্তিকাটির লেখক কতটুকু সত্যাশ্রয়ী, কতটুকু মিথ্যাশ্রয়ী। কতটুকু ন্যায়পরায়ণ, কতটুকু অবিমৃষ্যকারী ও হঠকারী। তাঁর তাহকীক ও গবেষণা কতটুকু জ্ঞাননির্ভর, কতটুকু অজ্ঞতানির্ভর।
দীর্ঘ আলোচনার ফসল
মুহতারাম, উভয় পক্ষের হাদীসগুলো নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা পর্যালোচনার পর যে বিষয়গুলো বেরিয়ে আসল তা সংক্ষেপে এই :
এক: হাদীসের ভান্ডারে ইসফার বিল ফাজর ও তাগলীস বিল ফাজর - এই উভয় সংক্রান্ত হাদীস পাওয়া যায় এবং সহীহ হাদীস পাওয়া যায়। ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ জাল হাদীসকে তাঁদের মতের ভিত্তি বানাননি।
দুই: ইসফার বিল ফাজর সংক্রান্ত হাদীসগুলোর মধ্যে উভয়বিধ হাদীস পাওয়া যায়। কওলী ও ফে‘লী। অর্থাৎ কিছু হাদীস এরূপ যেগুলো আমাদের জানান দেয় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসফার করে ফজর আদায় করেছেন। আর কিছু হাদীস এরূপ যেগুলোতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইসফার করতে নির্দেশ দান করেছেন। পক্ষান্তরে তাগলীস বিল ফাজর সম্পর্কে শুধু ফে‘লী হাদীস পাওয়া যায় কোনো কওলী হাদীস পাওয়া যায় না।
উল্লেখ্য, যে সকল হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো কাজের বিবরণী পাওয়া যায় সেসব হাদীসকে ফে‘লী হাদীস বলে। যে সকল হাদীসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর কোনো উক্তি উদ্ধৃত হয় সেসব হাদীসকে কওলী হাদীস বলে।
তিন: ইসফার বিল ফাজর সম্পর্কে একাধিক সহীহ ও দ্ব্যর্থহীন হাদীস পাওয়া যায়। পক্ষান্তরে তাগলীস বিল ফাজর সম্পর্কে সহীহ ও দ্ব্যর্থহীন এই উভয় গুণসম্পন্ন হাদীস মাত্র একটি পাওয়া যায়। সেটি হল, লেখক কর্তৃক পাঁচ নম্বরে উল্লেখকৃত তাগলীসের পক্ষে তৃতীয় দলীল। যা হযরত জাবের রা. কর্তৃক বর্ণিত। তবে এই হাদীসটিও স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করে না যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্ধকারে শুরু করে অন্ধকারেই ফজর শেষ করেছেন। হাদীসটিতে শুধু ব্যক্ত হয়েছে যে, তিনি ফজর আদায় করেছেন অন্ধকারে। তা সত্ত্বেও আমি হাদীসটিকে দ্ব্যর্থহীন বলেছি এইজন্য যে, হাদীসটি শোনার সঙ্গে সঙ্গে এটাই বুঝা যায় যে, তিনি অন্ধকারে শুরু করে অন্ধকারেই শেষ করেছেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্ধকারে ফজর শুরম্ন করেছেন এটি নিশ্চিত কিন্তু অন্ধকারেই শেষ করার বিষয়টি নিশ্চিত নয়, তবে অন্ধকারে শেষ করেননি সে কথাও নিশ্চিতভাবে বলা যায় না।
এখন প্রশ্ন হল, এই দুই প্রকারের হাদীসগুলোর মধ্য হতে আমলের জন্য উসূলের আলোকে কোন হাদীসগুলো অগ্রগণ্য? ইসফারের হাদীস না তাগলীসের হাদীস?
এর জবাব হল, শাস্ত্রীয় নীতি অনুযায়ী যে কোনোটাকে কেউ যদি গ্রহণ করে এবং সেটাকে মুস্তাহাব বলে তাহলে বলা যায় না যে, সে মুস্তাহাব পরিপন্থী কাজ করেছে। কারণ, সব কয়টির পক্ষে মুস্তাহাব হওয়ার সম্ভাব্য দলীল বিদ্যমান। প্রশ্ন হল, যদি কোনো একটিকে প্রাধান্য দিতে চাই তখন ?
উত্তরে বলব, আপনি যদি নিবন্ধটি মনোযোগ সহকারে পাঠ করে থাকেন এবং নিরপেক্ষ মস্তিষ্কে চিন্তা করেন তাহলে আপনিই বলবেন যে, শাস্ত্রীয় বিচারে ইসফারকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। কারণ, ইসফার বিল ফাজর সংক্রান্ত হাদীসগুলোর মধ্যে কওলী ও ফে‘লী উভয় প্রকার হাদীস রয়েছে। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে যেমন ইসফার করে ফজর আদায় করেছেন তেমনি সাহাবায়ে কেরামকেও ইসফার করে ফজর আদায় করতে নির্দেশ দান করেছেন। পক্ষান্তরে তাগলীস বিল ফাজর সম্পর্কে শুধু ফে‘লী হাদীস পাওয়া যায়। অর্থাৎ রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিজে তাগলীস বিল ফাজর করেছেন -(এখানে তাগলীস বিল ফাজর বলে আমি শুধু বুঝাতে চাচ্ছি অন্ধকারে শুরু করাকে। সুতরাং অন্ধকারে শেষ করাও এর অন্তর্ভুক্ত এবং ফর্সা করে শেষ করাও এর অন্তর্ভুক্ত।) এই তথ্য তো হাদীসে পাওয়া যায় কিন্তু তিনি তাগলীস বিল ফাজর করতে নির্দেশ দান করেছেন - এইরূপ কোনো হাদীস পাওয়া যায় না। আর ফে‘লী হাদীসের বিপরীতে যখন কওলী হাদীস পাওয়া যায় তখন কওলী হাদীসকে প্রাধান্য দেওয়া হয়। অর্থাৎ রাসূলের কর্মের বিপরীত কোন উক্তি বা নির্দেশ পাওয়া গেলে তাঁর উক্তি বা নির্দেশকে তাঁর কর্মের উপর প্রাধান্য দেওয়া হয়। এর কারণ সহজবোধ্য। আর তা হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যখন নির্দেশ দেন একরকম আর তিনি নিজে করেন অন্যরকম তখন এ ছাড়া আর বলার কিছুই থাকে না যে, নিশ্চয়ই স্বীয় নির্দেশের বিপরীত কর্ম সাধনের পিছনে বিশেষ কোনো কারণ নিহিত আছে। অন্য ভাষায় বললে, রাসূলের ফে‘ল বা কর্ম নানারকম ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে। কিন্তু উক্তি বা নির্দেশ কোনো ব্যাখ্যার অবকাশ রাখে না। তা পালনীয় বিধান বলে পরিগণিত হয়। অতএব যেখানে রাসূলের কর্ম হয় একরকম আর নির্দেশ হয় তার বিপরীত তখন তাঁর নির্দেশই অধিকতর অনুসরণযোগ্য। আলোচ্য বিষয়ে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর অন্ধকারে ফজর আদায় করণের বিপরীতে ফর্সা করে ফজর আদায় করার না শুধু নির্দেশ পাওয়া যাচ্ছে বরং ফর্সা করে ফজর আদায় করা সম্পর্কে তাঁর কর্মেরও সন্ধান পাওয়া যাচ্ছে। তিনি উম্মতকে ফর্সা করে ফজর আদায় করতে নির্দেশ দিয়েছেন আবার নিজেও ফর্সা করে ফজর আদায় করেছেন । দেখুন ইসফার বিল ফাজরের পক্ষে পেশকৃত প্রথম তিনটি দলীল।
মুহতারাম,
আসলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিয়মিতই তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। মসজিদে নববীতে যাঁরা ফজর আদায় করতেন তাঁদের অধিকাংশই ছিলেন বিশিষ্ট সাহাবী। তাঁরাও সাধারণত তাহাজ্জুদ আদায় করতেন। সম্ভবত এই কারণে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাত সাধারণত অন্ধকারেই আদায় করতেন যাতে বিলম্বজনিত কারণে মসজিদে নববীতে সালাত আদায়কারী সাহাবীগণের কষ্ট না হয়।
কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্ধকারে ফজর আদায় করতেন - এই কথার অর্থ এই নয় যে, তিনি এত অন্ধকারে ফজর শুরু করতেন যে, দীর্ঘ কেরাতে নামায আদায় করা সত্ত্বেও তা অন্ধকারেই শেষ হয়ে যেত। কারণ, হযরত আব্দুল্লাহ ইব্ন মাসঊদ রা.-এর হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ফজর শুরু করতেন না যেমনটি তিনি করেছেন মুযদালিফায়। তাঁর হাদীস দ্বারা বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মুযদালিফায় সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার পরপরই ফজর শুরু করেছিলেন যা ছিল তাঁর স্বাভাবিক নিয়মের বিপরীত। বুঝা যায় যে, তাঁর সাধারণ নিয়ম ছিল, সুবহে সাদিক হওয়ার বেশ কিছু পরে সালাত শুরু করা। এদিকে লেখক কর্তৃক ছয় নম্বরে উল্লেখকৃত চতুর্থ দলীল দ্বারা বুঝা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাতে ৬০ থেকে ১০০টি আয়াত তেলাওয়াত করতেন। তো সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার বেশ কিছু পরে সালাত শুরু করে ৬০ থেকে ১০০টি আয়াত তেলাওয়াত করলে ফর্সা হয়ে যাওয়ার কথা, অন্ধকার থাকার কথা নয়। অতএব, পাঁচ নম্বরে উল্লেখকৃত লেখকের তৃতীয় দলীল তথা হযরত জাবের রা. কর্তৃক বর্ণিত হাদীস
والصبح بغلس
(এবং তিনি ফজর আদায় করতেন অন্ধকারে)-এর মর্ম এটাই বলতে হবে যে, তিনি অন্ধকারে সালাত শুরু করতেন। অন্ধকারে শেষ করতেন কি না হাদীসটি তা ব্যক্ত করে না। হাদীসটিকে অন্ধকারে শেষ করার প্রমাণ হিসাবে গ্রহণ করা যায় না। বিশেষত যখন এক হাদীসে বলা হয়েছে যে, তিনি ফজরের সালাত সম্পন্ন করতেন যখন ব্যক্তি তার পার্শেব উপবিষ্ট ব্যক্তিকে চিনতে পারত। দ্রষ্টব্য, ইসফার বিল ফাজরের পক্ষে আমার এই লেখনীতে চতুর্থ দলীল হিসাবে উল্লেখকৃত হাদীস। আপনি বলতে পারেন যে, তাগলীস বিল ফাজরের পক্ষে উল্লেখকৃত চতুর্থ দলীলের হাদীসটি দ্বারা তো অন্ধকারেই শেষ করার কথা বুঝা যায়। এর জবাব হল, না তা বুঝা যায় না। কারণ, ঐ হাদীসটিতে শুধু এতটুকু ব্যক্ত হয়েছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ফজরের সালাত এমন সময়ে পড়তেন যখন আমাদের কেউ তার পার্শেব বসা ব্যক্তিকে চিনতে পারত না যাকে সে আগে থেকেই চেনে। কিন্তু না চেনার ঘটনাটা কখনকার, সালাত শেষের না সালাত শুরুর তা হাদীসে ব্যক্ত হয়নি। আপনি বলতে পারেন যে, ঐ হাদীসের জালীস শব্দ কি প্রমাণ করে না যে, ঘটনাটি সালাত শেষের ? আমি বলব যে, জালীস শব্দটি দিয়ে নিশ্চিতভাবে প্রমাণ করা যায় না যে, ঘটনাটি সালাত শেষের। কারণ জালীস শব্দটি উপবিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কেই বলা হয়েছে তা নিশ্চিত নয়। একই মজলিসে উপস্থিত পার্শবস্থ ব্যক্তিকে বোঝানোর জন্যও শব্দটি ব্যবহার হয়ে থাকতে পারে। উপবিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে ব্যবহার হয়ে থাকলেও তা দ্বারা সালাত শেষের ঘটনা বুঝা যায় না। কারণ প্রথম রাকআতে উভয় সেজদার মাঝখানের সময়টিতেও উপবিষ্টতা পাওয়া যায়। দেখুন, ইসফার বিল ফাজরের পক্ষের চতুর্থ দলীলের হাদীসে কিন্তু স্পষ্টতই সালাত শেষের কথা ব্যক্ত হয়েছে। পক্ষান্তরে তাগলীস বিল ফাজরের পক্ষের চতুর্থ দলীলের হাদীসে এইরূপ স্পষ্ট কোনো শব্দ ব্যবহৃত হয়নি। হাদীস দুইটি আবার দেখুন। তাগলীস বিল ফাজরের হাদীসে বলা হয়েছে وكان يصلى الصبح ==== (তিনি সালাত আদায় করতেন), পক্ষান্তরে ইসফার বিল ফাজরের পক্ষের হাদীসটিতে বলা হয়েছে وكان ينفتل من صلاة الغداة ==== ( এবং তিনি ফজরের সালাত সম্পন্ন করতেন)।
পূর্বে বলেছিলাম, হাদীস দুইটি সাংঘর্ষিক। বলেছিলাম, এই সংঘর্ষ নিরসনের উপায় কী তা নিয়ে পরে আলোচনা করব। পর্যালোচনা দ্বারা এটা স্পষ্ট হয়েছে আশা করি যে, হাদীস দুইটির মাঝে প্রকৃতপক্ষে কোনো সংঘর্ষ ও বিরোধ নেই। যে বিরোধ বোঝা যায় তা বাহ্যিক, প্রকৃত নয়। হাদীস দুইটির সমন্বিত মর্ম এক ও অভিন্ন। আর তা হল, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম অন্ধকারে সালাত শুরু করতেন এবং ৬০ থেকে ১০০টি আয়াত তেলাওয়াত করে যখন সালাত শেষ করতেন তখন ফর্সা হয়ে যেত।
এখানে একটি ঘটনা উল্লেখ করার লোভ সংবরণ করতে পারছি না। ১৪৩১ হিজরীতে আমি সপরিবারে হজ্ব আদায় করতে যাই। মদীনা হতে জিদ্দায় আসার পথে এক জায়গায় এসে আমরা আসরের সালাত আদায় করলাম। এরপর চা নাস্তা গ্রহণ করার পর দেখলাম মাগরিবের সময় হতে মাত্র আধঘন্টা খানেক সময় বাকী আছে। ড্রাইভারকে বললাম, আমরা এখানেই মাগরিবের সালাত আদায় করে রওয়ানা হব। সূর্যাস্তের কাছাকাছি সময়ে মসজিদের সামনে দাঁড়িয়ে সূর্যাস্তের অপেক্ষা করতে থাকলাম । ফাঁকা মরুভূমি। কাজেই সূর্যাস্তের দৃশ্যটা সরাসরি দেখতে পাচ্ছি। সূর্য পুরোপুরি দৃশ্যের অন্তরালে চলে গেলে একমিনিট অপেক্ষা করলাম এবং একজনকে বললাম আযান দিতে। পথের ধারের ঐ সকল মসজিদে নিয়মিত মুয়ায্যিন ও ইমাম নিযুক্ত থাকেন না। আপনি তা ভালই জানেন। কাজেই আযান শেষে আমিই ইমামতি করলাম। দুই রাকআত সুন্নতও আদায় করলাম। সালাত শেষে যখন মসজিদ থেকে বের হলাম তখন সেই মুহূর্তে আগত একটি বাসের যাত্রীরা বলাবলি করতে থাকল, ওয়াক্ত না হতেই মাগরিবের সালাতের জামাআত শেষ হয়ে গেল? আমি তাদের কথার কোন জবাব দেওয়ার চেষ্টা করলাম না। আমরা যখন সালাত শেষ করে বের হলাম তখন দেখলাম, পুরো মরুভূমি তখনও আলোয় পূর্ণ। তীর নিক্ষেপ করলে তীর কোথায় গিয়ে পড়ল তা স্পষ্ট দেখা যাবে। এটাই ছিল সমালোচনার কারণ। ঐ যাত্রীদের ধারণা অনুযায়ী আমরা ওয়াক্ত না হতেই সালাত আদায় করেছি। যা হোক আমি যুবায়েরকে বললাম, ‘বুখারী ও মুসলিম শরীফের একটি হাদীসে রাফে‘ ইবন খাদীজ রা. বলেন,
كُنَّا نُصَلِّى الْمَغْرِبَ مَعَ رَسُوْلِ الله صلى الله عليه وسلم فَيَنْصَرِفُ أَحَدُنَا وَإِنَّهُ لَيُبْصِرُ مَوَاقِعَ نَبْلِهِ
অর্থাৎ আমরা রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর সঙ্গে মাগরিবের সালাত আদায় করতাম, অতঃপর আমাদের কেউ ঘরে ফিরতে মসজিদ থেকে বের হত আর তখন সে তার নিক্ষিপ্ত তীরের আপতনস্থল দেখতে পেত। (বুখারী হাদীস নং ৫৫৯, মুসলিম হাদীস নং ১৪৭৩) দেশে আমরা সবসময়ই মাগরিবের আযানের পরপরই সালাত আদায় করে থাকি, কিন্তু সালাত শেষে মসজিদ থেকে বের হওয়ার পর দেখি আমাদের চারপাশ এরূপ অন্ধকার হয়ে যায় যে, সেই অন্ধকারে নিক্ষিপ্ত তীরের আপতনস্থল দেখতে পাওয়া সম্ভব নয়। হাদীসটির মর্ম ও বাস্তবতা এখানে বুঝলাম। আমরা সালাত শেষ করে বের হয়েছি কিন্তু এখনও দেখ কিরকম আলো বিরাজ করছে। এর কারণও তার নিকট ব্যাখ্যা করলাম। বললাম, সূর্য অস্ত যায় আমাদের দৃশ্যপট হতে কিন্তু সূর্যের অস্তিত্ব তো আর বিলুপ্ত হয় না। ফলে ভূপৃষ্ঠের মানুষের দৃশ্যপট হতে সূর্য অস্তমিত হলেও এবং ভূপৃষ্ঠ হতে সূর্যের সরাসরি আলো বা রোদ দূরীভূত হলেও আকাশের উঁচুতে সূর্য অস্তমিত হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর পর্যন্তও সূর্যের আলো ও রোদ্দুর বিদ্যমান থাকে। আর সেই আলোর রেশই ফাঁকা ও কঙ্করময় মরুভূমিতে বেশ কিছুসময় পর্যন্ত বিদ্যমান থাকে। ফলে মাগরিবের সালাত যথাসময়ে আদায় করার পরও এতটুকু আলো বিদ্যমান থাকে যাতে নিক্ষিপ্ত তীরের আপতনস্থল দেখতে পাওয়া যায়। কিন্তু গাছপালা বিশিষ্ট ও ঘনবসতিপূর্ণ ভূপৃষ্ঠে ঐ ক্ষীণ আলো তার প্রভাব ফেলতে পারে না। ঐ জাতীয় স্থানে সূর্য অস্তমিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে অাঁধার নেমে আসে।’
মুহতারাম,
সূর্য উদিত হওয়ার কালেও একই জাতীয় ঘটনা ঘটে। অর্থাৎ তখন ফাঁকা মরুভূমিতে একই কারণে খুব দ্রুত ভূপৃষ্ঠ আলোকিত হয়ে যায়। সুতরাং বলা যায় যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সুবহে সাদিক উদিত হওয়ার বেশ কিছুক্ষণ পর যখন ফজর শুরু করতেন তখন ৬০ থেকে ১০০টি আয়াত সালাতে তেলাওয়াত করলে সালাত শেষ হতে হতে ফর্সা হয়ে যাওয়া অনিবার্য বলে মনে হয়, তখনও অন্ধকার বহাল থাকা কিছুটা অসম্ভব বলেই মনে হয়।
যা হোক, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বিশেষ কারণে ফজরের সালাতকে অন্ধকার থাকতে শুরু করতেন। আর তা হল তাহাজ্জুদ আদায়কারী সাহাবীগণের সুবিধার প্রতি লক্ষ রাখা। বিলম্বজনিত কারণে তাঁদের যেন কষ্ট না হয় সেই দিকটা বিবেচনা করেই অন্ধকারেই শুরু করতেন। দেখুন, তাগলীস বিল ফাজরের পক্ষে লেখক কর্তৃক পাঁচ নম্বরে উল্লেখকৃত তৃতীয় দলীলের হাদীসটিতে আছে وَالْعِشَاءَ إِذَا كَثُرَ النًّاسُ عَجَّلَ وَإِذَا قَلُّوْا أَخَّرَ ‘এবং এশা, যখন লোক বেশী হত তাড়াতাড়ি আদায় করতেন আর লোক কম হলে বিলম্ব করে আদায় করতেন।’ লোক কম হলে বিলম্ব করতেন আরও কিছু লোক আসে কি না সেই অপেক্ষায়। আর লোক বেশী হলে তাড়াতাড়ি আদায় করতেন যাতে তাঁদের কষ্ট না হয়। উম্মতের কষ্টের কথা বিবেচনায় রাখা রাহমাতুল লিল আলামীন সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের এক বিশেষ গুণ ও বৈশিষ্ট্য ছিল। তিনি বলেছেন, لولا أن أشق على أمتى لأمرتهم بالسواك عند كل صلاة ولأخرت صلاة العشاء إلى ثلث الليل অর্থাৎ আমি যদি আমার উম্মতের উপর কষ্ট চাপিয়ে দেওয়ার আশংকা না করতাম তাহলে প্রত্যেক সালাতের সময় তাদেরকে মিসওয়াক করতে নির্দেশ দিতাম এবং এশার সালাতকে রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বিলম্ব করতাম। (তিরমিযী, হাদীস নং ২৩)
ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণ এই বিষয়টিকেও সামনে রাখেন এবং রাসূলের যে মোটিভ ছিল অন্ধকারে ফজর শুরু করার সেই মোটিভ অনুযায়ী তাঁরা আমল করেন। এইজন্য আমরা দেখি রামাদান মাসে তাঁরা ফজরের সালাতকে সুবহে সাদিকের ১০/১৫ মিনিট পরেই শুরু করেন। তথা অন্ধকারেই শুরু করেন। যাতে ইসফার করে শুরু করার কারণে মুসল্লীরা কষ্ট না পায়।
বলছিলাম যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সাধারণত ফজর অন্ধকারে শুরু করতেন এবং শেষ করতেন ফর্সা করে। কিন্তু উম্মতের জন্য তাঁর পছন্দ ছিল ইসফার করে শুরু করা। তিনি নিজেও ফর্সা করে শুরু করেছেন বলে হাদীসে পাওয়া যাচ্ছে। সুতরাং ফর্সা করে শুরু করাকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত। দেখুন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এশার সালাত বেশী বিলম্ব করে আদায় করতেন না। কিন্তু তাঁর পছন্দ ছিল এশার সালাতকে বিলম্ব করে আদায় করা। তিনি বলেছেন, لولا أن أشق على أمتي لأمرتهم بالسواك عند كل صلاة ولأخرت صلاة العشاء الى ثلث الليل অর্থাৎ আমি যদি আমার উম্মতের উপর কষ্ট চাপিয়ে দেওয়ার আশংকা না করতাম তাহলে প্রত্যেক সালাতের সময় তাদেরকে মিসওয়াক করতে আদেশ করতাম এবং এশার সালাতকে রাতের এক তৃতীয়াংশ পর্যন্ত বিলম্ব করতাম। (তিরমিযী, হাদীস নং ২৩) এই জাতীয় আরও হাদীস আছে। এইসব হাদীসের প্রেক্ষিতেই এশার সালাত বিলম্ব করে আদায় করাকে দল মত নির্বিশেষে সকলেই মুস্তাহাব বলে থাকেন।
তাহলে রাসূলের পছন্দের কারণে যদি ইসফার করে ফজর আদায় করাকে কেউ মুস্তাহাব বলে তবে তাকে দোষ দেওয়া যায় কি ?
তবে ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের অভিমত হল, যদি কোনো ব্যক্তি অধিক দীর্ঘ কিরাআত করে সালাত আদায় করে তবে তার উচিত অন্ধকারে শুরু করা। যাতে সালাত শেষ হওয়ার পরও এতটুকু সময় অবশিষ্ট থাকে যেন কোনো কারণে সালাত ফাসেদ হয়ে গেছে জানতে পারলে পুনরায় সুন্নত কিরাআতের মাধ্যমে সালাত আদায় করে সূর্যোদয়ের পূর্বেই সালাত শেষ করা যায়। আর এ কারণেই তাঁরা সাধারণত সূর্যোদয়ের ত্রিশ থেকে পঁয়ত্রিশ মিনিট পূর্বে ফজরের সালাত শুরু করেন। কারণ, তিওয়ালে মুফাস্সালের যে কোনো দুইটি সূরা দিয়ে দুই রাকআত সালাত শেষ করতে বড় জোর পনের মিনিট সময়ের প্রয়োজন হয়। অতঃপর সালাত শেষে আরও পনের বিশ মিনিট সময় অবশিষ্ট থাকে সূর্য উদিত হতে। অতএব আপনি ভেবে দেখুন কাদের আমল ইফরাত ও তাফরীত তথা ছাড়াছাড়ি ও বাড়াবাড়ি হতে মুক্ত, কাদের আমল অধিকতর মধ্যপথ আশ্রয়ী ও ন্যায়ানুগ, কাদের আমল সকল হাদীসের অধিকতর কাছাকাছি এবং অধিকতর সুন্নাহ সম্মত। মুযাফ্ফর বিন মুহসিন সাহেবদের না ইসফার বিল ফাজরের প্রবক্তাগণের?
আরও অনেক কথাই বলতে ইচ্ছা করছে। কিন্তু আপনার ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে বিধায় আলোচনা শেষ করছি। যতটুকু আলোচনা হয়েছে তদ্বারা একজন আলেম হিসাবে আপনি অনেক কিছুই উপলব্ধি করতে পেরেছেন বলে আমার বিশ্বাস।
বলেছিলাম, পুরো বইটি সম্পর্কে কিছু মৌলিক বক্তব্য তুলে ধরব। কিন্তু তাতেও এত সময় ও এত লেখার প্রয়োজন যে, এই মুহূর্তে আমার পক্ষে তা সম্ভব হচ্ছে না। হাতে অন্য কাজ জমা হয়ে আছে যা অল্প কয়েকদিনে শেষ করতে হবে। তবে বইটি প্রেরণ করে আপনি আমার হাতে একটি গবেষণার কাজ তুলে দিয়েছেন। এজন্য আপনাকে আবারও ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আশা আছে, পুরো বইটির বক্তব্য নিয়ে এই নিবন্ধের মত পুঙ্খানুপুঙ্খ আলোচনা পর্যালোচনা করার। আপনি আমার জন্য দুআ করবেন। আমরাও আপনার জন্য দুআ করছি এবং করতে থাকব।
মুহতারাম,
আপনি জানেন, বহু আমলে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট হতে একাধিক পদ্ধতির সন্ধান পাওয়া যায়। কোনো কোনো ÿÿত্রে একটি মানসূখ বা রহিত এবং অপরটি নাসিখ বা রহিতকারী বলে উলামায়ে কেরাম চিহ্নিত করেছেন। কোনো কোনো আমলের ক্ষেত্রে একাধিক পদ্ধতির সবকটিকেই উলামায়ে কেরাম সুন্নাহ বলে নির্দেশ করেছেন। তন্মধ্য হতে কেউ একটিকে প্রাধান্য দিয়েছেন কেউ অপরটিকে এবং প্রাধান্য দেওয়ার ক্ষেত্রেও প্রত্যেকেই দলীলের আশ্রয় নিয়েছেন। দলীল ছাড়া ইচ্ছামত কেউ কোনো পদ্ধতিকে প্রাধান্য দেননি। সুতরাং কোনোটিকে তাচ্ছিল্য করা কিংবা কোনোটিকে প্রত্যাখ্যাত বা হাদীস বিরোধী বলা চরম অন্যায় এবং সুন্না্হ বিরোধী বক্তব্য।
নানাবিধ কারণে সালাতসহ শরীয়তের বহু মাস্আলা মাসায়েলে মতভেদের সৃষ্টি হয়েছে। এই মতভেদ সাহাবী যুগেও ছিল। কিন্তু সাহাবায়ে কেরাম কেউ কাউকে পথচ্যুত আখ্যায়িত করেননি। বলেননি যে, সে হাদীস বিরোধী আমল করছে।
শুধু সাহাবা যুগে নয় বরং রাসূলের জীবদ্দশায় তাঁর উপস্থিতিতে সাহাবায়ে কেরামের মতভেদ ঘটেছে কিন্তু রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কাউকেই বলেননি যে, তোমার কর্মটি শরীয়ত বিরোধী বা আমার আদেশ ও সুন্নাহ বিরোধী হয়েছে। আপনি জানেন, খন্দকের যুদ্ধ হতে ফিরে আসার পর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর নিকট জিব্রাঈল আ. আসলেন এবং জিজ্ঞেস করলেন, আপনি কি অস্ত্র-শস্ত্র রেখে দিয়েছেন? আল্লাহর শপথ, আমি তো অস্ত্র-শস্ত্র এখনও রাখিনি। আপনি ওদের উদ্দেশে বের হোন। রাসূল জিজ্ঞেস করলেন, কোন দিকে? জিব্রাইল আ. বনু কুরায়যার দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, ঐ দিকে। অতঃপর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাদের বিরূদ্ধে অভিযানের উদ্দেশে রওয়ানা হলেন এবং হযরত বেলালকে ঘোষণা দিতে বললেন-
من كان سامعا مطيعا فلا يصلين العصر إلا فى بنى قريظة
‘যে ব্যক্তি রাসূলুল্লাহর বাধ্য ও অনুগত সে যেন বনূ কুরায়যায় গিয়েই আসরের সালাত আদায় করে।’
ঘোষণা শোনামাত্রই সবাই অস্ত্র হাতে রওয়ানা হলেন। অনেকেই সময়মত পৌঁছে গেলেন। কিছু সাহাবী পথে থাকা অবস্থাতেই আসরের ওয়াক্ত শেষ হয়ে যাওয়ার উপক্রম হল। তখন তাঁদের মাঝে মতভেদ হল যে, সালাত কোথায় পড়া হবে। কিছু সাহাবী বললেন, আমরা সেখানেই সালাত আদায় করব যেখানে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সালাত আদায় করতে আমাদের নির্দেশ দান করেছেন। তথা বনূ কুরায়যায় গিয়ে। অন্যরা বললেন, তাঁর উদ্দেশ্য এই ছিল না যে, আমরা সালাত কাযা করে হলেও বনূ কুরায়যায় পৌঁছেই সালাত আদায় করি। তো কিছু সাহাবী পথেই সালাত আদায় করে রওয়ানা হলেন, অন্যরা বনূ কুরায়যায় পৌঁছে সালাত আদায় করলেন ততÿণে সূর্য ডুবে গেছে। পরবর্তীতে রাসূলকে ঘটনাটি জানানো হলে রাসূল কাউকেই তিরস্কার করলেন না। (সহীহ বুখারী, কিতাবুল মাগাযী, হাদীস নং ৪১১৯ ; সহীহ মুসলিম কিতাবুল জিহাদ হাদীস নং ১৭৭০; সীরাতে ইবন হিশাম খন্ড ৬, পৃ. ২৮২)
রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কেন কোন দলকেই তিরস্কার করলেন না ? করলেন না এজন্য যে, দুই দলেরই উদ্দেশ্য ছিল রাসূলের আনুগত্য। তবে একদল রাসূলের উক্তির উদ্দেশ্য কী ছিল সেদিকে দৃষ্টি দেননি। তাঁর উক্তির বাহ্য অর্থ অনুযায়ী অনুযায়ী আমল করেছেন। তা হোক, উদ্দেশ্যের প্রতি দৃষ্টিপাত নাই বা করলেন কিন্তু বাহ্য অর্থে হলেও তাঁরা আমল তো করেছেন তাঁর উক্তি অনুযায়ী। অপর দল তাঁর উক্তির মর্ম ও উদ্দেশ্য বুঝার চেষ্টা করেছেন এবং তদনুযায়ী আমল করেছেন । বাহ্যত তাঁরা রাসূলের নির্দেশের বিরোধিতা করেছেন। তাঁরা বাহ্যত রাসূলের নির্দেশের বিরোধিতা করলেও প্রকৃত অর্থে তাঁরা রাসূলের নির্দেশের বিরোধিতা করেননি। অতএব উভয় দলই স্ব স্ব স্থানে ছিলেন সঠিক। এ কারণেই রাসূল কাউকেই তিরস্কার করেননি। উভয় দলের আমলকেই গ্রহণযোগ্যতার সীমাভুক্ত সাব্যস্ত করেছেন। উভয় দলের মধ্য হতে কোন দলের আমলটি উত্তম ছিল তা স্বতন্ত্র এক আলোচ্য বিষয়। তবে একজন সাধারণ লোকের সামনেও যদি আপনি ঘটনার বিশদ বিবরণ দেন তাহলে সে বলবে দ্বিতীয় দলের আমলটিই উত্তম ও যথার্থ ছিল। কারণ, তাঁরা সালাতও কাযা করেননি আবার যথাসম্ভব দ্রুত বনূ কুরায়যায় পৌঁছেও গেছেন। এজন্যই আল্লামা ইবনুল কাইয়েম রাহ. ‘যাদুল মাআদ’ গ্রন্থে বিষয়টি নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করে লিখেছেন যাঁরা সালাত কাযা করেননি তাঁদের সিদ্ধান্ত সঠিক ছিল। তাঁরা দুই সওয়াবের অধিকারী। আর অন্যরা যেহেতু রাসূলের নির্দেশের বাহ্য অর্থ অনুযায়ী আমল করেছেন এবং তাঁদেরও উদ্দেশ্য ছিল রাসূলের আনুগত্য তাই তারা মাযূর এবং এক সওয়াবের অধিকারী। (যাদুল মাআদ, খন্ড ৩, পৃ. ১১৮-১১৯)
বলছিলাম যে, সালাতসহ শরীয়তের বহু মাস্আলা মাসায়েলে মতভেদ সৃষ্টি হয়েছে। এই মতভেদের কারণ একাধিক এবং এই মতভেদ নতুন নয়, সাহাবী যুগ থেকেই চলে আসছে। কিন্তু দলীলভিত্তিক মতভেদকে কেউ কখনও কলহ বিবাদের উপলক্ষ বানাননি। দলীলভিত্তিক মতভেদ শুধু বৈধ নয় প্রশংসনীয়। মতভেদ তখনই নিন্দনীয় হয় যখন তা হয় দলীলবিহীন বা মতভেদকে যখন কলহ বিবাদের উপলক্ষ বানানো হয়। সাম্প্রতিক কালে শ্রদ্ধেয় মুযাফ্ফর বিন মুহসিনসহ বেশ কিছু আলেম চিরায়ত এই দালীলিক মতপার্থক্যকে কলহ বিবাদের উপলক্ষ বানাচ্ছেন। তাঁরা সহীহ হাদীসের আলোকে সালাত আদায় করার তথাকথিত আহবান জানিয়ে মূলত মতপার্থক্যের পরিধিকে আরও বিস্মৃত করে চলেছেন। কারণ, তাঁদের বক্তব্য হল, কারও অনুসরণ নয় সহীহ হাদীসের অনুসরণ কাম্য। কথাটি সত্য কিন্তু কথাটির ফল খারাপ। প্রত্যেকেই যদি নিজ গবেষণা অনুযায়ী সহীহ হাদীসের আলোকে সালাত আদায় করার চেষ্টা করে তাহলে যত ব্যক্তি তত মত সৃষ্টি হতে বাধ্য। তাছাড়া তখন জনসাধারণ সালাত পরিত্যাগ করতে বাধ্য হবে। না তারা নিজেরা গবেষণা করতে পারবে, না মুযাফ্ফর সাহেবদের অনুসরণ করতে পারবে। কারণ, মুযাফ্ফর সাহেবদের বক্তব্য তো এই যে, অন্য কারও অনুসরণ করা যাবে না। তাঁরাও তো সেই ‘অন্য কেউ’ এর অন্তর্ভুক্ত। সহীহ হাদীসের অনুসরণ কাকে বলে, মতপার্থক্য দোষণীয় কি না, উম্মাহকে এক প্লাটফরমে কী করে আনা যায় ইত্যাদি বিষয়ে একটি গবেষণামূলক প্রবন্ধ রচনা করেছিলেন হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ আবদুল মালেক ছাহেব (আমীনুত তালীম, মারকাযুদ দাওয়াহ আলইসলামিয়া ঢাকা) । প্রবন্ধটি তিনি একটি সেমিনারে পাঠ করেছিলেন। পরবর্তীতে তা পুসত্মক আকারে ‘উম্মাহর ঐক্য: পথ ও পন্থা’ নামে প্রকাশিত হয়। সম্ভব হলে পুস্তকটি আপনার নিকট পাঠিয়ে দেব। মনোজ্ঞ ও গবেষণাপূর্ণ আলোচনা সমৃদ্ধ ঐ পুস্তকটি পাঠ করলে শুধু জনসাধারণ নয় আলেম উলামাও প্রভূত উপকার লাভ করবেন এবং বহু প্রশ্নের উত্তর পেয়ে যাবেন এবং মনের সকল সন্দেহ ও সংশয় বিদূরীত হবে ইনশাআলস্নাহ।
আজ বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে মুসলমানেরা ব্যাপকভাবে ইরতিদাদের শিকার হচ্ছে। নতুন প্রজন্ম নাস্তিক হয়ে যাচ্ছে। নাস্তিকতাকে তারা যদি নিজেদের আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করে ক্ষান্ত হত তাহলেও তার বিরূদ্ধে আমাদের সচেতন হওয়ার প্রয়োজন ছিল, ব্যবস্থা গ্রহণ অপরিহার্য ছিল। কিন্তু অবস্থা তো আরও ভয়াবহ। নাস্তিকতাকে তারা প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে চাচ্ছে। ইসলাম ও মুসলমানের বিরূদ্ধে তারা অনবরত বিষোদগার করে যাচ্ছে। অশ্লীল ভাষায় আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিরুদ্ধে কথা বলছে। কিন্তু মুযাফ্ফর বিন মুহসিন সাহেবরা তাঁদের সকল সংগ্রামী শক্তি ব্যয় করছেন সুন্নাহ সম্মত মতপার্থক্য বিদূরীত করণের পিছনে। সুন্নাহ সম্মত পন্থায় সালাত আদায়কারীকে পথভ্রষ্ট আখ্যা দেওয়ার পিছনে। আর ইরতিদাদ ও নাস্তিকতার বিরূদ্ধে না তাদের কলম চলছে, না তাদের জিহবা চলছে। দুর্ভাগ্য এই জাতির, মহাদুর্ভাগ্য।
শেষ কথা
সালাতে দলীলভিত্তিক শাখাগত মতপার্থক্যের কারণে সালাত আদায়ের পদ্ধতিতে যে পার্থক্য দেখা যায় তাকে আমি বিভেদ বলতে নারাজ। আমি এই পার্থক্যকে বৈচিত্র বলতে ইচ্ছুক, যে বৈচিত্র সালাতকে আরও সৌন্দর্যময় করে তোলে, ইসলামকে আরও মহিমান্বিত করে তোলে। আপনি গোটা জগতকে বাদ দেন, শুধু পৃথিবীর দিকে তাকান। আপনি আপনার চতুর্পার্শ্বে ঐক্যের তুলনায় পার্থক্যই বেশী দেখতে পাবেন। পৃথিবীতে আছে জড়বস্ত্ত, উদ্ভিদ, প্রাণীকূল। কেন এই বিভেদ? সব কেন জড়বস্ত্ত হল না, সব কেন উদ্ভিদ হল না, সব কেন প্রাণী হল না? তারপর দেখুন, সব জড়বস্ত্ত একরকম নয়। কোনোটি পাথর, কোনোটি লোহা, কোনোটি সোনা কোনোটি রূপা, কোনোটি মুক্তা কোনোটি মানিক। আরও কত শত রকমের পার্থক্য। উদ্ভিদ জগতেও ভিন্নতা বিদ্যমান। কোনোটি কান্ডবিশিষ্ট, কোনোটি লতাবিশিষ্ট। কোনোটি ফলজ, কোনোটি ঔষধি, কোনোটি এর কোনোটাই নয়। কোনোটি আম দেয় তো অন্যটি জাম দেয়। কোনোটি কাঁঠাল কোনোটি তাল। এরূপ হাজার রকমের পার্থক্য। প্রাণীকূল দেখুন। কোনোটি বাকশক্তিহীন, কোনোটি বাকশক্তিসম্পন্ন সৃষ্টির সেরা মানুষ। কোনোটি গৃহপালিত, কোনোটি বন্য। আরও কত রকমের পার্থক্য। এক বাঘকে দেখুন। একটি চিতা তো অপরটি নেকড়ে কিংবা রয়েল বেঙ্গল টাইগার। পাখী দেখুন। কত প্রজাতির পাখী । এই জীববৈচিত্রসহ নানারকম সৃষ্টি বৈচিত্র এই মাটির পৃথিবীকে আরও সমৃদ্ধ করেছে। শৈল্পিক সৌন্দর্য দিয়ে তাকে কানায় কানায় পূর্ণ করে তুলেছে। তদ্রূপ সালাত আদায়ের পদ্ধতিতে নানারকম দলীলনির্ভর পার্থক্য আমার চোখে বৈচিত্র হয়ে দেখা দেয়। আর সেই বৈচিত্রের মধ্যেও এক মহান ঐক্য আরও স্পষ্ট হয়ে বিশ্ববাসীকে চমকিত করে। মসজিদে নববীতে কিংবা হারাম শরীফে দেখি একজন সালাত আদায় করতে গিয়ে হাত বুকের উপর রাখে তো অপরজন নাভীর নীচে। আবার অপরজন আদৌ হাত বাঁধেই না, হাত ছেড়ে দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। একজন আমীন বলে নিঃশব্দে তো অপরজন সশব্দে। একজন রাফয়ে ইয়াদাইন করে তো অপরজন করে না। এইরকম আরও কত পার্থক্য। পাশাপাশি দাঁড়িয়ে এইরকম বিপুল পরিমান পার্থক্যসহ সালাত আদায় করার পরও যখন দেখা যায় কেউ কারও সঙ্গে বিবাদে লিপ্ত হচ্ছে না বরং একে অপরের সঙ্গে উৎফুল্লচিত্তে হাস্যোজ্জ্বল চেহারায় হাতে হাত মিলিয়ে তার নিকট হতে বিদায় নিচ্ছে তখন ইসলামী ভ্রাতৃত্বের মহাদিগন্ত বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত হয়। বৈচিত্রের মাঝে এক মহা ঐক্যের সুর প্রতিধ্বনিত হয়। সে এক অনির্বচনীয় দৃশ্য বলে মনে হয় এবং শুধু তাকিয়ে থাকতেই ইচ্ছা করে। আমি কবি নই। ফলে ভাষার তুলিতে এই বৈচিত্রের প্রকৃত চিত্র যথাযথ অাঁকতে পারলাম না। এই সংক্ষিপ্ত নিবন্ধটির এখানেই ইতি টানছি। আল্লাহ তাআলা আপনাকে হায়াতে তাইয়েবা দান করুন। আমীন।
মা‘আস্সালাম
আপনার একামত্ম সেণভাজন
আব্দুল গাফফার, শহীদবাগ, ঢাকা (১৭ মে ২০১৪)
পুনশ্চ: আমার এই লেখাটির কোনো খসড়া আমি তৈরী করিনি। কাগজ কলম ব্যবহার না করে সরাসরি মস্তিষ্ক থেকে কম্পিউটারে লেখাটি কম্পোজ করেছি। ফলে বিষয়বস্ত্তর দুর্বল উপস্থাপন কিংবা উপস্থাপনে কিছুটা ধারাবাহিকতার অভাব এবং ভাষাগত ত্রুটি থাকা স্বাভাবিক। তারপরও লেখাটি যদি আপনার আদেশ পালনে কিছুটা সফল হয়ে থাকে তাহলে আমি নিজেকে ধন্য ও গর্বিত মনে করব। কম্পিউটারের হিসাবে লেখাটিতে সর্বমোট ১২৮৭৪টি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। সময় ব্যয় হয়েছে ৭৬ ঘন্টা ৪২ মিনিট। অবশ্য ফাইল খোলা রেখে যখন খানা খেতে বসেছি কিংবা অন্য কাজ করেছি তখন সেই সময়টিকেও কম্পিউটার এডিটিং সময় হিসাবে কাউন্ট করে নিয়েছে। হায়! কম্পিউটার যদি আরেকটু বুদ্ধিমান হত!
(এ কথা মূল লেখার বিষয়ে। লেখাটি প্রকাশের সময় কিছু সংযোজন বিয়োজন হয়েছে।)
বর্ধিত অংশ : ‘জাল হাদীসের কবলে রাসূলুল্লাহ্র ছালাত’ গ্রন্থের লেখক এই অধ্যায়ের শেষে আরও কিছু দলীল উল্লেখ করেছেন ‘আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায়ের গুরুত্ব’ শিরোনামে। এতদ্বারা তিনি ‘আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় সর্বোত্তম’ তাঁর এই দাবি প্রমাণ করতে চেয়েছেন। প্রথমে উল্লেখ করেছেন কুরআন মজীদের আয়াত إِنَّ الصّلَاةَ كَانَتْ عَلَى الْمُؤْمِنِيْنَ كِتَابًا مَوْقُوْتًا ‘নিশ্চয় মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে ছালাত ফরয করা হয়েছে।’ (সূরা নিসা ১০৩)
আয়াতটি দ্বারা লেখকের দাবি প্রমাণিত হয় না। কারণ, আয়াতটিতে নির্দিষ্ট সময় বলতে সালাতের পূর্ণ সময় বোঝানো হয়েছে। যে সময়ের কোনো একটি সময়ে সালাত আদায় করলে সালাত আদায় হয়ে যাবে। সালাত কাযা হয়ে গেছে বলা হবে না। আউয়াল ওয়াক্ত বোঝানো হয়নি। লেখক যদি একটু মনোযোগ সহকারে আয়াতটি নিয়ে চিন্তা করতেন তাহলে আয়াতটিকে তিনি তাঁর ঐ দাবির পক্ষে দলীল হিসাবে উপস্থাপন করতেন না। আয়াতটির যে তরজমা তিনি তাঁর বইয়ে লিখেছেন সেটি সঠিক তরজমা। আয়াতে বলা হয়েছে নিশ্চয় মুমিনদের উপর নির্দিষ্ট সময়ে সালাত ফরয করা হয়েছে। আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায় করা তো মুস্তাহাব, ফরয নয়।
এরপর লেখক পুনরায় উম্মে ফারওয়া রা.-এর হাদীস উল্লেখ করেছেন। হাদীসটি নিয়ে পূর্বেই আলোচনা করেছি যে, হাদীসটি যঈফ।
এরপর আবূ কাতাদাহ রা.-এর একটি হাদীস উল্লেখ করেছেন হাদীসটি এই:
عَنْ أَبِىْ قَتَادَةَ قَالَ قَالَ رَسُوْلُ الله صلَّى الله عَلَيْهِ وَسَلَّمَ قَالَ الله تَعَالَى إِنِّىْ فَرَضْتُ عَلَى أُمَّتِكَ خَمْسَ صَلَوَاتٍ وَعَهِدْتُ عِنْدِىْ عَهْدًا أَنَّهُ مَنْ جَاءَ يُحَافِظُ عَلَيْهِنَّ لِوَقْتِهِنَّ أَدْخَلْتُهُ الْجَنَّةَ
আবূ কাতাদাহ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন, আল্লাহ তাআলা বলেন, আমি আপনার উম্মতের উপর পাঁচ ওয়াক্ত ছালাত ফরয করেছি এবং আমি একটি অঙ্গীকার করেছি যে, নিশ্চয় যে ব্যক্তি সেগুলোকে ওয়াক্ত অনুযায়ী যথাযথভাবে সংরক্ষণ করে উপস্থিত হবে, আমি তাকে জান্নাতে প্রবেশ করাবো। আর যে সেগুলোকে সংরÿণ করবে না , তার জন্য আমার কোনো অঙ্গীকার নেই।
পর্যালোচনা
লেখক লিখেছেন, হাদীসটি উপমহাদেশীয় ছাপা আবূ দাঊদে নেই। আমার বক্তব্য হল, তা-ই যদি হয় তাহলে লেখকের উচিত ছিল হাদীসটির সনদ উল্লেখ করা। তিনি তো বইটি এইদেশীয় মুসলমানদের উদ্দেশে লিখেছেন। সনদ উল্লেখ করলে সকলের পক্ষেই সনদটি যাচাই করার সুযোগ হত এবং লেখকের সততার উপর প্রশ্ন উঠত না। হাদীসটিকে লেখক হাসান বলেছেন। হাসান লিযাতিহী, না লিগাইরিহী তা বলেননি। আমার মতে হাদীসটি যঈফ। কারণ, হাদীসটিতে বাকিয়্যাহ নামক একজন রাবী আছেন যিনি মুদাল্লিস। আর মুদাল্লিসের রেওয়ায়েত তখনই গ্রহণযোগ্য হয় যখন তিনি মারবী আনহু হতে শ্রবণ করেছেন বলে স্পষ্ট ভাষায় বলেন। যেমন বলেন, আমি অমুক থেকে শুনেছি। কিংবা বলেন, আমাকে অমুকে বলেছেন বা জানিয়েছেন। মুদাল্লিস যদি এমন কোনো শব্দ ব্যবহার করেন যা দ্বারা স্পষ্টভাবে বুঝা যায় না যে, তিনি হাদীসটি মারবী আনহু হতে শুনেছেন না অন্য কোনো ব্যক্তি হতে শুনে তার নাম অনুচ্চারিত রেখে মারবী আনহুর নাম উল্লেখ করে দিয়েছেন তখন তার হাদীস অগ্রহণযোগ্য হয়ে যায়। পরিভাষায় বলা হয় যে, মুদাল্লিস কর্তৃক বর্ণিত হাদীস তখনই গ্রহণযোগ্য হয় যখন সে سماع -এর تصريح করে। যেমন বলে, سمعت فلانا يقول (আমি অমুককে বলতে শুনেছি) বা বলে, حدثنى فلان أو أخبرنى فلان (অমুকে আমার নিকট বর্ণনা করেছে বা অমুকে আমাকে জানিয়েছে।) পক্ষান্তরে মুদাল্লিস যদি سماع -এর تصريح না করে, বরং قال فلان (অমুকে বলেছে) বা ذكر فلان (অমুকে বলেছে) বা عن فلان (অমুক হতে) - এই জাতীয় কোনো অস্পষ্ট শব্দ ব্যবহার করে তবে তার হাদীস গ্রহণযোগ্য হবে না। আলোচ্য হাদীসটির বাকিয়্যাহ নামক রাবী মুদাল্লিস এবং তিনি عن শব্দ দ্বারা হাদীস বর্ণনা করেছেন। আল্লামা ইবন হাজারের মতে তিনি صدوق كثير التدليس عن الضعفاء । ইব্ন মাঈন তাঁর সম্পর্কে বলেন,
كان يحدث عن الضعفاء بمأة حديث قبل أن يحدث عن الثقة بحديث
ইমাম নাসাঈ তাঁর সম্পর্কে বলেন,
إذا قال حدثنا أو أخبرنا فهو ثقة
তাছাড়া বাকিয়্যাহ হাদীসটিকে যার বরাতে বর্ণনা করেছেন তিনি হলেন
ضبارة بن عبد الله بن ابى سليك
হাফেজ ছাহেবের মতে তিনি মাজহুল। ইত্যাদি কারণে হাদীসটি যঈফ। হাদীসটি হাসান লি-গাইরিহী হতে পারত যদি সেটি একাধিক সনদে বর্ণিত হত। কিন্তু লেখক তেমন কিছুই বলেননি। প্রতিপক্ষের বিরূদ্ধে লেখক অনবরত চিৎকার করতে থাকেন যে, তাদের অমুক হাদীসটি যঈফ, তমুক হাদীসটি যঈফ। অথচ নিজে যঈফ হাদীসকে দলীল হিসাবে উল্লেখ করলেন। এটা কিরূপ ন্যায়পরায়ণতা তা আপনিই বিচার করম্নন। অতঃপর আমার বক্তব্য হল, হাদীসটি যদি সহীহও হত তবুও হাদীসটিকে লেখকের দাবির পক্ষে দলীল হিসাবে উল্লেখ করা সমীচীন হত না। কারণ, ওয়াক্ত অনুযায়ী যথাযথ সংরক্ষণ করার অর্থ হল, কাযা না করা। প্রতিটি সালাতের জন্য যে আউয়াল ও আখের ওয়াক্ত নির্ধারিত আছে সেই ওয়াক্তের মধ্যেই সালাত আদায় করা। আউয়াল ওয়াক্তের কথা লেখক কোত্থেকে বুঝলেন জানি না।
এরপর তিনি ফাদালাহ রা.-এর একটি হাদীস উলেস্নখ করেছেন। হাদীসটি এই:
عَلَّمَنِى رَسُولُ اللَّهِ -صلى الله عليه وسلم- فَكَانَ فِيمَا عَلَّمَنِى « وَحَافِظْ عَلَى الصَّلَوَاتِ الْخَمْسِ ». قَالَ قُلْتُ إِنَّ هَذِهِ سَاعَاتٌ لِى فِيهَا أَشْغَالٌ فَمُرْنِى بِأَمْرٍ جَامِعٍ إِذَا أَنَا فَعَلْتُهُ أَجْزَأَ عَنِّى فَقَالَ « حَافِظْ عَلَى الْعَصْرَيْنِ ». وَمَا كَانَتْ مِنْ لُغَتِنَا فَقُلْتُ وَمَا الْعَصْرَانِ فَقَالَ « صَلاَةٌ قَبْلَ طُلُوعِ الشَّمْسِ وَصَلاَةٌ قَبْلَ غُرُوبِهَا
ফাদালাহ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম একদা আমাকে কিছু বিষয় শিক্ষা দান করলেন। তার মধ্যে ছিল, তুমি পাঁচ ওয়াক্ত সালাতের ব্যাপারে যত্নবান হও। আমি বললাম, এই সময়গুলো আমার জন্য খুব ব্যস্ততার। সুতরাং একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আমাকে নির্দেশ দিন, যখন আমি তা করব তখন আমার জন্য তা যথেষ্ট হবে। তিনি বললেন, তুমি দুই আছরকে সংরক্ষণ কর। এই ভাষা আমার জানা ছিল না। আমি বললাম, দুই আছর কী? তিনি বললেন, সূর্য উঠার পূর্বের ছালাত এবং সূর্য অস্ত যাওয়ার পূর্বের ছালাত।
এই হাদীস থেকে ‘আউয়াল ওয়াক্তে সালাত মুস্তাহাব’ কীভাবে প্রমাণিত হয় লেখক তা উল্লেখ করেননি।
আমার তাহকীক মতে হাদীসের ব্যাখ্যা কেউ কেউ এইভাবে করেছেন যে, ফাদালাহ রা.কে রাসূল প্রথমে সকল সালাতকেই আউয়াল ওয়াক্তে আদায় করতে নির্দেশ দিলেন। কিন্তু ফাদালাহ রা. যখন বললেন, ঐ সময়ে আমার অনেক ব্যস্ততা থাকে তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁকে বিশেষভাবে ফজর ও আসরকে আউয়াল ওয়াক্তে আদায় করতে নির্দেশ দিলেন। এই ব্যাখ্যা অনুযায়ী হাদীসটি লেখকের দাবির পক্ষে দলীল হয়।
কিন্তু এটি সম্ভাব্য একটি ব্যখ্যা। আরও ব্যাখ্যা হতে পারে। সেটি এই: সালাতের ব্যাপারে যত্নবান হওয়া বা সালাতকে যথাযথ সংরক্ষণ করার অর্থ হল, সালাত নিয়মিত আদায় করা, সালাতের যাবতীয় হকসমূহের প্রতি যথাযথ লক্ষ্য রেখে সালাত আদায় করা। ফাদালাহ রা. যখন বললেন, ঐ সময়ে আমার ব্যস্ততা থাকে, ফলে অনেক সময় আমার পক্ষে সালাতের যথাযথ হক আদায় করা সম্ভব হবে না তখন রাসূল তাঁকে বিশেষভাবে ফজর ও আছরের প্রতি যত্নবান হতে বললেন। এর নজীর আমরা সূরা বাকারার ২৩৮ নং আয়াতে পাই। যেখানে বলা হয়েছে حافظوا على الصلوات والصلاة الوسطى (তোমরা সকল সালাতের প্রতি, বিশেষভাবে সালাতে উসতার প্রতি যত্নবান হও) এই আয়াতের তাফসীরে তাফসীরকারগণ ঐ ব্যাখ্যাই উল্লেখ করেছেন যা আমি এইমাত্র উল্লেখ করলাম।
হাদীসটিতে যখন স্পষ্ট ভাষায় আউয়াল ওয়াক্তের কথা বলা হয়নি, আউয়াল ওয়াক্ত বুঝতে যখন হাদীসটির ব্যাখ্যার আশ্রয় নিতে হয় এবং সেই ব্যাখ্যাটিও চুড়ান্ত ব্যাখ্যা নয়, বরং সম্ভাব্য ব্যাখ্যা তখন হাদীসটি দ্বারা দলীল গ্রহণ কতটুকু যুক্তিযুক্ত তা আপনিই বিচার করুন।
যদি আমরা মেনেও নেই যে, হাদীসটিতে আউয়াল ওয়াক্তে সালাত আদায়ের গুরুত্বই ব্যক্ত করা হয়েছে তবুও হাদীসটিকে সকল সালাতের জন্য প্রযুক্ত করা যায় না। কারণ, এই হাদীস-নির্ভর দলীলটি عام বা সাধারণ ও নির্বিশেষ। সুতরাং তা خاص বা নির্দিষ্ট ও বিশেষ দলীলের মুকাবিলা করতে পারে না। দেখুন, এশার সালাত বিলম্বে আদায় করা সর্বসম্মতভাবে মুস্তাহাব। কারণ, এশার সালাত বিলম্বে আদায় করার পক্ষে বিশেষ দলীল রয়েছে। অর্থাৎ যে দলীলটি বিশেষভাবে এশার সালাতের কথাই বলে। তদ্রূপ যোহরের সালাত গ্রীষ্মকালে বিলম্ব করে আদায় করা সর্বসম্মতভাবে মুস্তাহাব। কারণ, এর পক্ষে বিশেষ দলীল রয়েছে। যে দলীলটি গ্রীষ্মকালে যোহরের সালাতকে বিলম্ব করে আদায় করার কথা বলে। অতএব ফজরের সালাত ইসফার করে আদায় করার পক্ষে যখন বিশেষ দলীল পাওয়া যাচ্ছে তখন ফজরের ক্ষেত্রে সেই বিশেষ দলীলটিই অগ্রগণ্য হবে।