শাবান-রমযান ১৪৩৫   ||   জুন-জুলাই ২০১৪

প্রজ্ঞাপূর্ণ জবাব

রাইয়ান বিন লুৎফর রহমান

প্রায় তিন বছর আগের ঘটনা। ১৪৩২ হিজরীর সম্ভবত জুমাদাল উলা মাস। আল্লাহ তাআলা এই অধমকে হারামাইন শরীফাইন যিয়ারতের সৌভাগ্য নসীব করেন। সেই সফরে আমার সবচে বড় প্রাপ্তি তো ছিল দীদারে বাইতুল্লাহ এবং যিয়ারতে মাদীনাহ। দ্বিতীয় প্রাপ্তি ছিল দুজন ইলমী ব্যক্তিত্বের সামান্য কিছু খেদমতে শামিল হওয়া। সফরের পূর্বে যখন আমার প্রিয় উস্তায ও মুরুববী মাওলানা আবদুল মালেক ছাহেব দামাত বারাকাতুহুমের কাছ থেকে বিদায় নিতে গেলাম। হুযুর বললেন, মক্কা মুকাররমায় একজন আলেম আছেন শায়খ গাসসান। তাঁর কাছে কিছু ইলমী কাজ প্রস্ত্তত আছে তুমি তা আমার জন্য নিয়ে আসবে। আর মদীনা মুনাওয়ারায় অধ্যয়নরত মুহিউদ্দিন ফারুকীর কাছে শরহু মুখতাসারিত ত্বাহাবীর একটি নুসখা আছে সেটা আদীব হুযুরের জন্য নিয়ে আসবে। একদিকে আল্লাহর ঘরের যিয়ারত অপরদিকে দুজন আহলে ইলমের খেদমতে সামান্য হিসসা নিতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে হচ্ছিল। দেখতে দেখতে দিনগুলি ফুরিয়ে গেল। আল্লাহর ঘর থেকে এবং রাসূলের শহর থেকে বিদায়ের সময় ঘনিয়ে  এলো। শায়খ গাসসানের সাথে অনেক চেষ্টা করেও যোগাযোগ করতে পারলাম না। তবে মুহিউদ্দিন ফারুকী ভাইয়ের কাছ থেকে শরহু মুখতাসারিত ত্বাহাবীর নুসখাটি নিতে ভুল করলাম না।

বিদায় সব সময়ই বেদনার। আর বাইতুল্লাহ থেকে বিদায়ের কষ্ট শুধু অনুভব করা যায়, কলমের কালি তা প্রকাশ করতে অক্ষম। তবু অবুঝ মনকে এই বলে প্রবোধ দিলাম যে, আমি যেখানেই থাকি যে ভূমিতেই বাস করি আমার হৃদয় তো বিচরণ করবে মক্কায় এবং মদীনায়। স্বদেশের মাটিতে ফিরে এলাম। বেশি দেরি না করে যাহিদ ভাইয়ের মাধ্যমে আদীব হুযুরের সাক্ষাৎ প্রার্থনা করলাম। আদীব হুযুর জানালেন, একে তো বাইতুল্লাহর মুসাফির, আবার আমার জন্য কিতাব নিয়ে এসেছে সে যখন সুযোগ পাবে তখনই সে আসবে। বাইতুল্লাহর মুসাফিরের পরিচয়ে যতবার গিয়েছি, আদীব হুযুরের অন্যরকম সমাদর পেয়েছি।

পরেরদিন ফযরের পর বের হয়ে খুব অল্পসময়ে মাদরাসাতুল মাদীনায় পৌঁছে গেলাম। মাদরাসার অভ্যন্তরে প্রবেশ করতেই আদীব হুযুরের সাক্ষাৎ পেয়ে গেলাম। হুযুর কিতাব দেখে অনেক খুশি হলেন। আটখন্ডের বিশাল কিতাবটি নেড়েচেড়ে দেখছিলেন আর আমার জন্য অনুচ্চস্বরে দুআ করছিলেন। এরপর হুযুর বললেন, আজ আমি অনেক ব্যস্ত। পুষ্পের কিছু কাজ করতে হবে আবার আলকাউসারের জন্য লেখা তৈরি করতে হবে। তবে তুমি যেহেতু আল্লাহর ঘর যিয়ারত করে এসেছো আবার আমার জন্য এত বড় কিতাব বহন করে নিয়ে এসেছো তাই শত ব্যস্ততা সত্ত্বেও ইচ্ছা করেছি আজ তোমাকে একটু বেশি সময় দিবো। হুযুর আমাকে তাঁর কম্পিউটার কক্ষে নিয়ে গেলেন। হুযুর কাজ করছিলেন আর ফাঁকে ফাঁকে অনেক কথা বলছিলেন এখন সব কথা মনেও নেই। এক পর্যায়ে হুযুর এমন একটি ঘটনা শোনালেন যাতে রয়েছে আমাদের সকলের জন্য শিক্ষার উপাদান। হুযুর বললেন, ৮৯ সালের হজ্বের সফরের ঘটনা। জান্নাতুল বাকীর কাছে দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ এক আলজেরিয়ান মহিলা এসে ঝাঁঝালো কন্ঠে আমাকে বলল, আমাদেরকে কেন কবর যিয়ারত করতে দেয়া হয় না? তাঁর গলার স্বরই বলে দিচ্ছিল সে এটাকে বৈষম্য মনে করছে। আমি তাকে উত্তর দিলাম, (হুযুরের আরবী ইবারত ছিল মোটামুটি এরকম)

الشريعة سنت زيارة القبور لإلانة القلوب وقلوب الرجال قاسية وقلوب النساء لينة فليس هذا المنع إهانة بل إكراما لكن.

অর্থাৎ: মানুষের দিল যাতে নরম হয় মূলত এ উদ্দেশ্যেই শরীয়ত কবর যিয়ারতের ব্যবস্থা দিয়েছে। আর স্বভাবতই পুরুষের দিল হয় কঠিন আর নারী হয় কোমল হৃদয়। সুতরাং কবর যিয়ারতের অনুমতি না দিয়ে শরীয়ত তোমাদের অবমাননা করেনি বরং তোমাদের প্রতি যথার্থ সম্মান প্রদর্শন করেছে।

আমার এ উত্তর শুনে মহিলাটি অত্যান্ত আনন্দিত হলো এবং জাযাকাল্লাহ বলতে বলতে চলে গেল। আসলে শরীয়তের প্রতিটি বিধানই সহজ ও সুন্দর। বিশেষত নারীকে কেন্দ্র করে শরীয়ত যত বিধান দিয়েছে সবগুলোতেই রয়েছে প্রজ্ঞার গভীরতা, যার সবটুকু পরিমাপ করার আকাঙ্ক্ষাই হাস্যকর। আল্লাহ যতটুকু প্রকাশ করেন সেটাও আমাদের প্রশান্তির জন্য যথেষ্ট। কিন্তু সমস্যা হলো, আমরা সহজ ও সুন্দরভাবে মানুষের সামনে পেশ করতে পারি না বরং অনেক ক্ষেত্রে শরীয়তের বিধান বর্ণনা করতে গিয়ে আমরা কঠোরতা করে ফেলি। ফলে সাধারণ মানুষের অন্তরে শরীয়তের প্রতি আকর্ষণের পরিবর্তে একরকম ভীতি কাজ করতে থাকে। অথচ আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন তুমি নিজ প্রতিপালকের পথে মানুষকে ডাকবে হিকমত ও সদুপদেশের মাধ্যমে। (সূরা নাহল : আয়াত ১২৫)

আল্লাহ আমাদেরকে শরীয়তের প্রতিটি বিধান হৃদয়ঙ্গম করার এবং সঠিকভাবে উপস্থাপন ও অনুধাবন করার তাওফিক দান করুন। আমীন। ষ

 

 

advertisement