শাবান-রমযান ১৪৩৫   ||   জুন-জুলাই ২০১৪

আমার আববাজান-২

হযরত মাওলানা আব্দুল হাই পাহাড়পুরী

পাহাড়পুর এমদাদুল উলূম ইসলামিয়া মাদরাসা

ত্যাগ ও কুরবানী ছাড়া বড় কিছু অর্জন করা যায় না। পৃথিবীতে অর্জন ও সাফল্যের যত ইতিহাস, তার সবটাই ত্যাগের ইতিহাস। লক্ষ্য অর্জনে নিজের সর্বস্ব বিলীন করার ইতিহাস। সেই ইতিহাস কখনো তৈরি হয় প্রকাশ্য জনসম্মুখে। কখনো তৈরি হয় লোকচক্ষুর অন্তরালে। রাতের নিভৃত নিস্তব্ধতায়  কিংবা দিনের ক্লান্তিহীন শ্রমসাধনায়। আমার আববাজানকে আমি দেখেছি, বরং বলতে হবে আল্লাহ আমাকে দেখিয়েছেন, তিনি ছিলেন ত্যাগী। ত্যাগই ছিল তাঁর জীবনের এক অমূল্য পাথেয়, যাকে সম্বল করে তিনি পার করেছেন তাঁর শতবর্ষের এই সুদীর্ঘ পথ।

পাহাড়পুর মাদরাসা। আমরা এখন দেখি এখানকার প্রকৃতি। ইট পাথরের সুদৃঢ় নির্মাণ। পুকুর। পুকুর পাড়ে ঘাটলা। টলটলে পানি। বিস্তৃত মাঠ। মাঠজুড়ে লোহার খুটি। ইটের উপর সিমেন্ট বালুর শক্ত প্রলেপ। মাঠের তিনদিকে ভবন। মসজিদ মাদরাসা। আমরা দেখি এবং দেখে বর্তমানের মধ্যেই আটকে থাকি। আমরা জানি না এর পিছনে আছে একটি ইতিহাস, ত্যাগ ও কুরবানীর  এক অবিশ্বাস্য ইতিহাস। সেই ইতিহাসের স্বাক্ষী এখন আর কে আছে। আল্লাহ তো আছেন, যার জন্য এত কিছু তিনি তো আছেন। পাহাড়পুর মাদরাসার ইতিহাসের অন্তরালে যাদের অবদান সবচেয়ে বেশী তাদের অন্যতম আমার আববাজান। দিনের পর দিন অবিশ্বাস্য শ্রম, রাতের পর রাত মাওলায়ে পাকের দরবারে নিভৃত আহাজারী, গভীর রাতে চোখের পানিতে বুক ভেজানো কান্না,  পাহাড়পুর মাদরাসার উন্নতি অগ্রগতির নেপথ্যে এই তো ছিল আমার আববাজানের শক্তির একমাত্র উৎস।

আমরা তখন পাহাড়পুর মাদরাসার ছাত্র। আমার মনে পড়ে, মাদরাসায় কাপড় বোনার দুটি তাঁত ছিল। আববাজান ও পাহাড়পুর মাদরাসার প্রতিষ্ঠাতাদের অন্যতম মাওলানা আলতাফ আলী সাহেব রাহ.। আমরা দেখতাম তাঁরা দুজন অবসর সময়ে তাঁত দুটি নিয়ে বসে যেতেন। কাপড় বুনতেন এবং সেই কাপড় বিক্রি করে মাদরাসার অনেক আর্থিক প্রয়োজন পুরা করতেন। মাদরাসায় নিয়মিত খতমে খাযেগানের আমল হত। একটি কাপড় বিছিয়ে তার উপর দিয়ে খতম পড়ার দানাগুলো চালানো হত। আমার মনে পড়ে কাপড়টি ছিল আমার আববাজানের নিজের হাতে বোনা।

মাদরাসার সামনে এখন বিস্তৃত খোলা ময়দান। আগে এই জায়গাটি ছিল একটি বিরাট ডোবা। আববা এখানে পাট চাষ করতেন। ছাত্রদেরকে নিয়ে পাট কাটতেন। আমার মনে পড়ে একবার আমি কাঁচা  হাতে পাট কাটতে গিয়েছিলাম। ডান হাতে ধারালো কাস্তে। বাঁ হাতে পাট ধরা। সজোরে কাস্তে চালালাম এবং সম্পূর্ণ হাতের উপর। সেই কাটা দাগ এখনো আছে আমার হাতে। যাই হোক, এভাবে পাট কেটে পুকুরের পানিতে ভিজিয়ে রাখা হত। পরে পাট বিক্রি করে মাদরাসার আর্থিক প্রয়োজন পুরা করা হত।

এখন যেখানে মাদরাসা আগে এখানে ছিল না। মাদরাসার দক্ষিণ  পশ্চিম কোণে একটি খোলা মাঠ ছিল। পাহাড়পুর এবং আশপাশের অনেকগুলো গ্রামের ঈদগাহ ময়দান। আববা ছিলেন ঈদগাহের ইমাম। মাদরাসা তখন এই ঈদগাহ ময়দানেরই এক পাশে ছিল। ঈদগাহ ময়দান থেকেও আববা মাদরাসার উন্নতির ফিকির করতেন। সারা বছর ময়দান খালি পড়ে থাকত। আববা ভাবলেন, এখানে যদি ধান চাষ করা যায় মাদরাসার কিছু ফায়দা হতে পারে। ঘাস কেটে এখানে ধান চাষের ব্যবস্থা করলেন। প্রতি বছর এখানে আববা ধান চাষ করতেন এবং মাদরাসার খরচের বিরাট একটা অংশ এখান থেকে তুলে আনতেন।

মাদরাসার চিন্তা আববাকে এতটাই আচ্ছন্ন করে রাখত যে, আববা নিজের অস্তিত্বকেই যেন ভুলে যেতেন। বার্ধক্য মানবজীবনের এমন একটা অধ্যায় যেখানে মানুষ প্রকৃতির হাতে নিজেকে সঁপে দিতেই পছন্দ করে; বরং বাধ্য হয় সঁপে দিতে। মানুষ তখন নিজেকে সমস্ত কিছু থেকে মুক্ত করে ব্যক্তি চিন্তায় ব্যস্ত হয়ে পড়ে। এটাই মানবজীবনে চিরাচরিত অবয়ব। কিন্তু আমার আববা এসব চিন্তা থেকে অনেক উর্ধ্বে ছিলেন। বার্ধক্য তাঁর দেহকে কাবু করেছিল। কিন্তু তাঁর হৃদয়ে বার্ধক্যের ছাপ কোনোদিনই পড়েনি। বার্ধক্যের ভারে শরীর নুয়ে পড়েছে। তবু দিলের জোয়ানিতে তিনি ছুটে চলেছেন কখনো গ্রামে কখনো শহরে। মাদরাসার কাজে তাঁর এ ছুটে চলা কখনো থেমে যায়নি। পাহাড়পুর মাদরাসার শিক্ষকদের এ পরিস্থিতিতে কতবার যে পড়তে হয়েছে। মাদরাসার কোনো প্রয়োজন দেখা দিল, খুব জরুরি। কিন্তু ব্যবস্থা নেই। কী করা যায়? উস্তাযগণ আলোচনায় বসে গেলেন। মাশওয়ারা চলতে থাকল। কুল কিনারা পাওয়া যাচ্ছে না। খবরটা কোনোভাবে আববার কানে পৌঁছে গেছে। তখনই আববা সেই কাজটা করার জন্য বের হয়ে গেলেন। কাজটা আঞ্জাম দিতে যেখানে যাওয়া দরকার চলে গেলেন। মাদরাসার উস্তাযগণ পরামর্শ শেষ করে আবিষ্কার করলেন যে, হুজুর তো মাদরাসায় নেই। কোথায় গেছেন? হুজুর ঢাকার উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিয়ে দিয়েছেন। মাদরাসার প্রয়োজনের কথা শোনে বার্ধক্যের ভারে নুয়ে পড়া শয্যাশায়ী লোকটি আর শুয়ে থাকতে পারেননি। নিজের অসুস্থতার কথা ভুলে গেলেন। বার্ধক্যের নানাবিধ জটিলতা উপেক্ষা করে বেরিয়ে গেলেন। অথচ কিছুক্ষণ আগেও তাঁকে ধরে চালাতে হয়েছে। আববাজানের চিন্তা জুড়ে ছিল কেবলই মাদরাসা আর মাদরাসা।

 

মৃত্যুর কয়েকদিন আগের কথা। ঢাকার খিদমাহ হাসপাতালের বিছানায় শুয়ে আছেন। অর্ধ-অচেতন অবস্থা। আশপাশের লোকজন আববাজানের সুস্থতার চিন্তায় বেচাইন। ডাক্তার, ঔষধ, দুআ দুরুদ- এ নিয়েই সবাই ব্যস্ত। এর মধ্যে আববার চেতনা কিছুটা ফিরে এল। আববা জানতে চাইলেন, আমি কোথায়? বলা হল, আপনি ঢাকার হাসপাতালে আছেন। আববা অদ্ভুত বেচাইনির সাথে বলতে থাকলেন, পাহাড়পুর মাদরাসার কী খবর? আমি পাহাড়পুর কবে যাব? এ অবস্থাটা বারবারই হত এবং যথারীতি আববাকে অনেক বলেকয়ে শান্ত করা লাগত।

কোথাও যখন কোনো দুর্যোগ নেমে আসে তখন মানুষ প্রিয়তম বস্ত্তটির কথাই চিন্তা করে। সবার আগে ভাবে প্রিয় মানুষটির কথা। তার কিছু হয়ে গেল না তো। সংকটের মুহূর্তেই ফুটে উঠে মানুষের আসল প্রকৃতি। সংকট ও দুর্যোগের মুহূর্তেই মানুষের প্রকৃত পরিচয় লাভ করা যায়। হঠাৎ ঝড় তুফান শুরু হলে তো প্রত্যেকেই তটস্থ হয় প্রিয়তম বস্ত্তটি রক্ষা করার জন্য। মা নিজের অজান্তেই আপন সন্তানের দিকে হাত বাড়িয়ে দেয়। ঘর বাড়ি আসবাবপত্র সবকিছু ভুলে গিয়ে

সন্তানকে বুকে আগলে নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে উদ্ভ্রান্তের মত ছুটতে থাকে। এটাই মানুষের স্বভাব।

দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্ব আর আখেরাতের স্থায়িত্বের কথা কম তো শুনিনি। বই

পুস্তকে কম তো পড়িনি। এ নিয়ে চিন্তা ভাবনা কম তো করিনি। তবে পড়া, শোনা, ভাবনার অনেক অনেক আগে আল্লাহ তাআলা আমাকে এমন একটি পাঠশালা দান করেছিলেন যেখান থেকে আমি দুনিয়া ও আখেরাত সম্পর্কীয় এ বিশ্বাস হাতেকলমে লাভ করেছি। আববার জীবনের প্রতিটি নড়াচড়া আমার জীবন-পাঠ্যের একেকটি অধ্যায় ছিল। জীবনের প্রথম যে সবকটি আমার আববাজানের কাছ থেকে লাভ করেছি তা হল দুনিয়ার ক্ষণস্থায়িত্ব ও আখেরাতের স্থায়িত্বের দৃঢ় বিশ্বাস। আববাজানের জীবনের পুরোটাই ছিল এ বিশ্বাসের প্রোজ্জ্বল প্রকাশক্ষেত্র। তাঁর জীবনের কিছু কিছু ঘটনা কিছু কিছু চিত্র আমার মাঝে এ বিশ্বাস এমন গভীরভাবে প্রোথিত করেছে যে, আজো সেইসব দৃশ্য আমার চোখের সামনে উজ্জ্বল, জ্বলজ্বলে। তাই আমি এখন আমাকে চিনতে পারি। আমার চারপাশটাকে বুঝতে পারি। দুনিয়ার মায়ায় আখেরাত হারানোর মহাবিপদ থেকে নিজেকে বাঁচাতে পারি।

আমি তখন পাহাড়পুর মাদরাসার ছাত্র। মাদরাসা থেকে আমাদের বাড়ি দুই আড়াই কিলোমিটার । একদিন প্রচন্ড ঝড় শুরু হল। গাছপালা উপড়ে পড়ছে। আমাদের বাড়ির টিনের ঘরগুলো থরথর করে কাঁপছে। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়বে। আববা তখন বাড়িতে। আববার চেহারায় অস্থিরতার ছাপ। আববা প্রচন্ড পেরেশান হয়ে গেলেন। এসব মুহূর্তে মানুষ যে কাজটি করে আববা তার উল্টোটা করলেন। আববা এই তুমুল ঝড়ের মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে ঘর থেকে বের হয়ে গেলেন। আম্মা পিছন থেকে ডাকতে থাকলেন, কোথায় যান? কোথায় যান? আববার তখন হুঁশ নাই। আববা ছুটতে থাকলেন আর বলতে থাকলেন, মাদরাসায় যাই, মাদরাসার ঘরগুলো ভেঙে যেতে পারে, বাঁশ দিয়ে ঠেকনা দিতে হবে। বাতাসের প্রচন্ড ঝাপটা। ডালপালা ভাঙার কড়কড় শব্দ। গগণবিদারী বজ্রধ্বনি। আববা যেন যুদ্ধ করে এগিয়ে চললেন। মাদরাসায়  যখন পৌঁছলেন মাদরাসার ঘরগুলো তখন বাতাসের প্রচন্ড ঝাপটায় থরথর করে কাঁপছে। যেকোনো মুহূর্তে ভেঙে পড়বে। আববা ছুটলেন এই প্রচন্ড ঝড়ের মধ্যেই বাঁশঝাড়ের দিকে। বাঁশ কেটে আনলেন এবং কোনোমতে মাদরাসার ঘরগুলো ঠেকা দিলেন।

মাদরাসার ঘরগুলো তো রক্ষা পেল। এখানে আমাদের বাড়ির অবস্থা হল, আম্মা আমাদেরকে নিয়ে যে ঘরটায় থাকতেন, ঘরটা ভেঙে গেল। আম্মা কোনোমতে আমাদেরকে নিয়ে পাশের ঘরে আশ্রয় নিলেন। কিছুক্ষণ পর সে ঘরটিও ভেঙে গেল। আম্মা অন্য ঘরে আশ্রয় নিলেন। এভাবে একেকটা ঘর ভাঙে আম্মা পাশের ঘরে আশ্রয় নেন। একসময় আমাদের বাড়ির কোনো ঘরই আর অবশিষ্ট থাকলো না। আম্মা তখন আমাদেরকে নিয়ে পাশে চাচার বাড়িতে আশ্রয় নিলেন।

জানি না দুনিয়ার মানুষ এর কী ব্যাখ্যা দিবে। নিজের বাড়িঘর, স্ত্রী পরিজনকে এভাবে ঝড়ের মুখে রেখে মাদরাসার ঘর রক্ষা করার জন্য ছুটে যাওয়া এর কী অর্থ? এর কোনো ব্যাখ্যা দুনিয়ার মানুষের কাছে থাকার কথাও নয়। কিন্তু আমার কাছে এর একটা ব্যাখ্যা আছে। আববার কাছে ঘর আর মাদরাসার ভিন্নভিন্ন কোনো পরিচয় ছিল না। দুটোই এক ও অভিন্ন

পরিবারভুক্ত ছিল। আববা মনে করতেন পুরো পরিবারেরই আমি যিম্মাদার। পুরো পরিবারের যিম্মাদারিই আমাকে পালন করতে হবে। কিন্তু আগে কোনটা? আববার মনে পড়ে হুজুর সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের ঘনিষ্ঠ সহচর হযরত আবু বকর রাযিআল্লাহু আনহুর কথা। ঘরে যা ছিল সব নিয়ে হযরত আবু বকর আল্লাহর নবীর দরবারে হাজির হলেন। নবীজি জানতে চাইলেন, ঘরে কী রেখে এসেছেন? আবু বকর রাযিআল্লাহু আনহুর ঈমানদ্বীপ্ত সরল জওয়াব, আল্লাহ ও তাঁর রাসূলকে রেখে এসেছি। আমাদের ঘর ভেঙেছে, কুরআনের ঘর রক্ষা পেয়েছে - একথাটি যতবার মনে হয় দিলের মধ্যে একটা অন্যরকম কাইফিয়্যত তৈরি হয়। আমার মনে পড়ে সাহাবায়ে কেরামের ইতিহাস। কুরবানী ও আত্মত্যাগের সেই ইতিহাস, যার পরতে পরতে ছিল নিজের সর্বস্ব বিলীন করে আল্লাহর দ্বীনকে টিকিয়ে রাখার এক উজ্জ্বল প্রেরণা। নিজের জানকে কুরবানী করে আল্লাহর দ্বীনকে টিকিয়ে রাখা- একে বলা হয় শাহাদাত। আল্লাহর ঘর রক্ষা করার জন্য নিজের ঘরবাড়ি বাস্ত্তভিটা এমন নিশ্চিত ধ্বংসের মুখে ঠেলে দেওয়া - এওকি আল্লাহর নিকট প্রিয়তম আমল শাহাদাতের মধ্যে গণ্য নয়?  আমি নিশ্চিত জানি, ঘর ভাঙার খবর পেয়ে আববা খুশি হয়েছিলেন। হৃদয়ে পরম প্রশান্তি অনুভব করেছিলেন। হৃদয়ের গহীনে আববা অবশ্যই জান্নাতের আশা লালন করেছিলেন।

ঘরতো ঘর, আপন কলিজার টুকরা

সন্তানের এবং একমাত্র সন্তানের মৃত্যু সংবাদ শুনেও যাদের চোখে আনন্দের অশ্রু প্রবাহিত হয় আমার আববা তো ছিলেন তাঁদেরই একজন। মুলতানে খায়রুল মাদারিসে যখন পড়ি সেখানে আমার বহুত বড় মুশফিক উস্তায ছিলেন মাওলানা শরীফ কাশ্মীরি। এ আমার যিন্দেগীর এক পরম সৌভাগ্য। এমন অসাধারণ একজন মানুষের সান্নিধ্য আল্লাহ তাআলা আমাকে দান করেছিলেন। তারঁ সম্পর্কে একসময় কিছু লেখার ইচ্ছা আছে। তাঁর একমাত্র ছেলে মাওলানা মাসউদ কাশ্মীরি। আমাদের সাথী। খায়রুল মাদারিসে কিছুদিন শিক্ষকতাও করেছেন। তখন আফগানিস্তানে রুশ দখলদারদের বিরুদ্ধে জিহাদ চলছে। আমাদের এ সাথীও একদিন হঠাৎ আফগানিস্তান চলে গেলেন। জিহাদে অংশগ্রহণ করলেন। একদিন আমরা শরীফ কাশ্মীরি সাহেবের সবকে বসে আছি। হুজুর নিবিষ্ট মনে সবক পড়াচ্ছেন। এমন সময় সবকের মধ্যেই খবর এল, মাসউদ শহীদ হয়ে গেছে।

আমার চোখ দুটির এ এক পরম সৌভাগ্য। এমন একটি চেহারা আল্লাহ তাআলা আমাকে দেখার তাওফীক দিয়েছেন আজীবন যা আমার হৃদয়ের আয়নায় ভাস্বর হয়ে থাকবে। আমি দেখলাম একমাত্র পুত্রের  শাহাদাতের সংবাদ শুনে হুযুর যেন আনন্দে আত্মহারা হয়ে গেলেন। হুযুর অদ্ভুত এক ভঙ্গিতে বুক ফুলিয়ে বলতে থাকলেন, ‘‘আলহামদুলিল্লাহ, আলহামদুলিল্লাহ ম্যায় শহীদ কা বাপ বান গায়া, ম্যায় শহীদ কা বাপ বান গায়া।’’ এমন একটি দৃশ্য হয়তো গল্প কাহিনীতে পড়া যায়। কিংবা হয়ত কল্পনা করা যায়। কিন্তু সত্যিসত্যি সামনাসামনি দেখার সৌভাগ্য কয়জনের হয়ে থাকে। এটা ছিল আমার উস্তাযে মুহতারামের যিন্দেগীর এক বিস্ময়কর ইতিহাস।

আমার উস্তাযে মুহতারামের এ ঘটনার সাথে অদ্ভুতভাবে মিলে যায় আমার আববাজানের যিন্দেগীর একটি ইতিহাস। দুটি ঘটনার মধ্যে আমি খুঁজে পাই এক আশ্চর্য মিল। পাহাড়পুর মাদরাসায় মেহমান এসেছেন। মেহমানদারির ব্যবস্থা করতে হবে। আববা আম্মাকে বললেন, মাদরাসায় মেহমান এসেছে, খানা পাকাও। আম্মা খানা পাকানোয় ব্যস্ত হলেন। অথচ আমাদের ঘরে তখন গুরুতর অসুস্থ রোগী। আমার ছোট বোন আমেনা। বয়স চার কি পাঁচ। এতটাই গুরুতর অসুস্থ যে, যেকোনো মুহূর্তে মারা যেতে পারে। সবাই বোনটাকে নিয়ে ব্যস্ত। আম্মা মেহমানের জন্য খানা পাকানোয় ব্যস্ত। একসময় আম্মাজানের রান্না শেষ হল। কিন্তু আমার ছোট্ট বোনটা ততক্ষণে আর দুনিয়াতে নেই। বাড়িতে কান্নার রোল পড়ল। সবাই কাঁদল। আম্মাও কাঁদলেন। আববাও কাঁদলেন। সবার এমন কান্নাকাটির মধ্যে ঘটনা যেটা ঘটল তা হল আববা আমেনার কাফন দাফনের ব্যবস্থা সেরে দস্তরখানা নিয়ে মেহমানের আপ্যায়নের জন্য চলে গেলেন।

আববাজানের যিন্দেগীর এ ঘটনাটা বর্ণনা করতে আমার তো খুব ভাল লাগল। কিন্তু এমন একটা ঘটনার জন্ম দেওয়া কি আববাজানের জন্য খুব সহজ ছিল? কলিজার টুকরা সন্তানের তাজা লাশ চোখের সামনে রেখে মেহমানদারির ফিকির অব্যাহত রাখা এমন মানুষের পক্ষেই কেবল সম্ভব যিনি দ্বীনের স্বার্থে বুকে পাথর চাপা দিতে পারেন। আমার আববাজান ছিলেন অত্যন্ত নরম দিলের  মানুষ। অথচ পৃথিবীর রুক্ষতম মানুষটির পক্ষেও সম্ভব না এমন কঠিন মুহূর্তে নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করা। কিন্তু আমার আববাজান পেরেছেন।  কেননা দুনিয়ার মানুষের প্রতি আববাজানের ভালোবাসা ছিল আল্লাহকে রাজী খুশি করার উদ্দেশ্যেই। হোকনা সে আপন ঔরসজাত সন্তান। সুতরাং এমন মুহূর্তেও তিনি ভুলে যাননি মেজবানের দায়িত্ব। মেহমানরা ছিলেন মাদরাসার মেহমান। আববা ছিলেন মাদরাসার যিম্মাদার। মাদরাসার যিম্মাদারির প্রতি এতটাই সজাগ দৃষ্টি পৃথিবীর মানুষ আর কবে কোথায় দেখেছে। ষ

 

 

advertisement