জুমাদাল উলা ১৪৩৫   ||   মার্চ ২০১৪

প দ ক : ইজ্জতের সরকারি সনদ

খসরূ খান

পুরস্কার-পদক ব্যাপারগুলোই কেমন যেন আরামদায়ক। যারা দেন যারা নেন-সবাই আরাম পান। এ যুগে অনেকেই এর সঙ্গে আরও বিচিত্র কিছু মাহাত্মও যোগ করেন। কেউ কেউ পদক পেয়ে মর্যাদা বাড়ান। কেউ আবার ইজ্জতের সনদ গলায় ঝুলিয়ে বুকটা ফুলান। কাটা নাক-কান জোড়া লাগাতেও কেউ কেউ পদক-পুরস্কারের বাহবা কামান। কিন্তু কে যে কী জন্য পদকের পিছে ছুটেন- সেটা নির্দিষ্টভাবে বুঝতে অনেক সময় বহুদিন লেগে যায়। এ জন্য মাঝে মাঝে পদক-পুরস্কারের মাহাত্ম্য নির্ণয় করাও মুশকিল হয়ে পড়ে।

গত ২০ ফেব্রুয়ারি ঢাকার একটি দৈনিক পত্রিকায় এরকম একটি পদকের খবরই প্রকাশ হয়েছে। খবরের শিরোনামটি ছিল- অপারেশন শাপলার জন্য পদক পাচ্ছেন পুলিশ-র‌্যাবের কর্মকর্তারা। ওই খবরে বলা হয়েছে, গত বছর ৫ মে মতিঝিল শাপলা চত্বরে অভিযানে সফলতার জন্য পুরস্কার দেওয়া হচ্ছে পুলিশ ও র‌্যাবের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের। এ জন্য ঢাকা মহানগর পুলিশ ও র‌্যাবের সদর দপ্তর থেকে পৃথক দুটি প্রস্তাব পাঠানো হয়েছে পুলিশের সদর দপ্তরে। বর্তমানে ওই প্রস্তাবের যাচাই-বাছাই চলছে। আগামী ৫ মার্চ রাজারবাগ পুলিশ লাইন্স মাঠে পুলিশ সপ্তাহ-২০১৪ অনুষ্ঠানে পুরস্কারপ্রাপ্তদের মাঝে পদক বিতরণ করবেন স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

শাপলা অপারেশনের জন্য পদকের এই প্রস্তাব কি সরকারের উঁচু মহলের ইশারা ছাড়াই পুলিশের সদর দপ্তরে জমা হয়েছে? এমন মনে করার কোনো কারণ কি আছে? মনে হয় নেই। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন, সরকারের ভেতরে কোনো দ্বিধাগ্রস্ততা নেই। এ সরকার লুকোচুরির পথ মাড়াতে কোনোভাবেই রাজি নয়। তাই শব্দ করে, ঘোষণা দিয়েই তারা যা করার করেন এবং করেই ছাড়েন। রক্তাক্ত শাপলা অভিযানের পর এখন তার জন্য এই পদকের আয়োজনও সেরকম একটি উদ্যোগ। যে অভিযানে কোটি মানুষের হৃদয়ে কষ্টের কান্না  ঝরেছে এবং ঝরছে সে অভিযানের জন্যই এবার পদক দেয়ার আয়োজন হাতে নিয়েছে সরকার। এটি একদম সত্য কথা যে, কোনো মহলের এতোটা বেপরোয়া ভঙ্গি আসলেই সাহসের ব্যাপার! কলিজার ব্যাপার!! এ সরকারের সে সাহস রয়েছে। এ সাহসের পরিচয় সরকার বার বারই দিয়েছে। নিহত ঘৃণিত খোদাদ্রোহী রাজীবের বাসায় শান্ত্বনার বাণী নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতির সময়ও এ সাহসের পরিচয় পাওয়া গেছে। এরপর ৫ মে মধ্যরাতের শেষে রক্তাক্ত সশস্ত্র অভিযানের ঘটনাতেও সে সাহসের নজির দেখা গেছে। মাসের পর মাস খোদাদ্রোহী ও নবীর দুশমন শাহবাগী ব্লগারদের পৃষ্ঠপোষকতা দেয়া আর একরাতের জন্য শাপলা চত্বরে ধর্মপ্রাণ হাফেজ-আলেমদের অবস্থানকে সহ্য না করার অভিযানেও পাওয়া গেছে সে সাহসের দৃষ্টান্ত। আর এখন ঢাকঢোল পিটিয়ে সে অভিযানের নায়কদের (!) পদক দিয়ে আরও বড় সাহসের নমুনা সৃষ্টি করা হচ্ছে। সবই সাহসের ঘটনা। সাহসের সব অপূর্ব নজির!

বর্তমান প্রশাসনের ক্ষেত্রে এ ধরনের ঘটনা সম্ভবত এটাই প্রথম নয়। শাপলা অভিযানের কিছুদিন পর ঢাকা মিরপুর ১৪ নম্বরের দিকে পুলিশকে জনবান্ধব বানানোর একটি মতবিনিময় সভায় আইজিপি বলেছিলেন , ৫ মের অভিযান নিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী লজ্জিত নয়- গর্বিত। সংবাদপত্রে সে বক্তব্য পড়ে অনেকেই চমকে গিয়েছিল। তাছাড়া রাজপথে সাবেক বিরোধী দলীয় চীফ হুইপকে পোশাক খুলে টেনে হিঁচড়ে বেদম প্রহারের নায়ক এক পুলিশ কর্মকর্তাকে গত বছর পুলিশ-পদক দেয়া হয়েছিল। সে ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করায় সাবেক পিএইচডি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, হ্যাঁ ওই কৃতিত্বের জন্যই তাকে পদক দেয়া হয়েছে। এখন দেখা যাচ্ছে ধিক্কার ও পদক একসাথেই বসবাস করছে। অভিশাপ ও অভিনন্দনের মহড়া চলছে এক কারণে, একই পাত্রে। কোটি মানুষের কান্নার উপলক্ষ তৈরির কৃতিত্বই কিছু মানুষের হাতে তুলে দিচ্ছে উল্লাসের উপাদান। এতে অনেক সময় মর্যাদা ও ইজ্জতের তগমা পকেটে চলে যাচ্ছে বস্ত্রহীন মানুষেরও।

শাপলা-পদকের খবর শুনে ঠোঁটকাটা কেউ কেউ বলতে শুরু করেছেন, এখন কবে জানি বিগত কয়েক বছরে শত শত মানুষের গুম হয়ে যাওয়ার সাফল্য নিয়েও কাউকে কাউকে পদক দেওয়ার ধুম পড়ে যায়। একইভাবে গত এক বছরে ঢাকা, মানিকগঞ্জ, গাইবান্ধা, লক্ষ্মীপুর, নিলফামারী আর সাতক্ষীরায় যেসব হত্যা, দমন, বাড়ি ধসানোর ঘটনা ঘটেছে সেগুলোর জন্যও তো সম্মাননার ব্যবস্থা হয়ে যেতে পারে। অবাক হওয়ার তখন কিছুই থাকবে না।

তবে এটা বলা খুবই মুশকিল হতে পারে যে, শাপলা অভিযানের এই পদকটা এবার যারা পাচ্ছেন তাদের জন্য সেটা আরামের ব্যাপারই হবে। সেখানে কেবল কিছু স্বস্তি, সুখ ও আনন্দই থাকবে, এমন ভাবাটা বোধ হয় সঠিক না-ও হতে পারে। রক্ত, কান্না আর উল্লাস আসলে তো একসঙ্গে যায় না। এক জাতির মধ্যে, এক দেশের মধ্যে সেই না যাওয়াটা আরও বড় প্রাসঙ্গিক। ইতিহাস তো সে কথাই বলে। একজন ইতিহাস বিশ্লেষকের অভিমত হচ্ছে, কারবালার ঘটনায় রক্ত ও কান্না ছিল। আবার বিজয়ী কাপুরুষদের মুখে উল্লাসও ছিল। সে ঘটনায় কেউ পদক পেয়েছিলেন বলে শুনতে পাইনি। চলুন কল্পনা করি, কারবালার সেই অভিযানের সাফল্যের জন্য ইয়াযীদ ও শিমারকে বিশেষ (মরণোত্তর) পদক দেয়া হচ্ছে। দেখুন কাল্পনিক এই চিত্রটি কল্পনা করতে কেমন লাগে। যদি ওই কল্পনার চিত্রে আপনি স্বস্তিবোধ করেন তাহলে

পদক-পুরস্কারের কোনো রকম নতুন খবরেই আপনার বিচলিত হওয়ার

কথা নয়।

তার কথায় আমরা চুপ হয়ে যাই। তারপর বলি কারবালা আর শাপলার মাঝে আমরা নতুন কোনো মিল খুঁজতে চাই না। তাই পদক-সম্মাননার মধ্য দিয়েও যদি দুটি ঘটনার আবেদনে কিছু ভিন্নতা সৃষ্টি হয়-তাহলে কী অসুবিধা! 

 

 

advertisement