রবিউল আখির ১৪৩৫   ||   ফেব্রুয়ারি ২০১৪

প রা ম র্শ : গণতন্ত্রের কথায় অবাক!

খসরূ খান

একজন প্রধানমন্ত্রী, অন্যজন তথ্যমন্ত্রী। একান্তে কথোপকথন করছিলেন। তাদের সামনে ছিল মাইক্রোফোন ও টেলিভিশনের বুম। আনুষ্ঠানিক সংবাদ সম্মেলনের আগ মুহূর্ত। তখনই একান্ত কথাবার্তা শুরু করেন তথ্যমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রীর দিকে কিছুটা ঝুঁকে যেন সবাই মনে করে আমরা রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত আছি বলে তিনি নির্বাচনে জালভোট বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একটি পয়েন্ট নিয়ে কথার সূত্রপাত করেন। তখন প্রধানমন্ত্রী হেসে তাকে সতর্ক করে দেন-সব তো অনইয়ারে যাচ্ছে। সে সময় তথ্যমন্ত্রীর উত্তরে মনে হয়েছে, তিনি বিষয়টি বুঝেও গুরুত্ব দেননি। আবার এটাও মনে হয়েছে যে, প্রধানমন্ত্রীর সতর্কবাণীসহ পুরো বিষয়টি তিনি সেভাবে খেয়ালই করেননি। কিন্তু আলোচনার একদম শেষ পর্যায়ে তথ্যমন্ত্রীকে সতর্ক হয়ে উঠতে দেখা গেছে। প্রধানমন্ত্রীর একটি মন্তব্যের প্রেক্ষিতে তখন সামনের মাইক্রোফোন ও বুমগুলো দেখিয়ে তিনি বলেছেন, এইগুলো সব অনইয়ারে আছে। তখন অবশ্য প্রধানমন্ত্রীর উত্তর ছিল, তাই তো সব বলে দিলাম। এতে পরিষ্কার হয়েছে, শুরুতে ও শেষে দুজনই তাদের অনানুষ্ঠানিক কথোপকথন প্রকাশ হওয়া নিয়ে পুরোপুরিই সচেতন ছিলেন। তারপরও তাদের কথোপকথন প্রকাশ হয়ে গেছে।

ঘটনাটি ঘটেছে গত ৬ জানুয়ারি সোমবার। প্রধানমন্ত্রীর সরকারি বাসভবন-গণভবনের উন্মুক্ত চত্বরে। আগের দিনের বিশ্ববিখ্যাত নির্বাচন নিয়ে সরকারি উদ্যোগে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছিল। সেখানে প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য ও বক্তব্যের নোট তৈরিই ছিল বলা যায়। তারপরও তার পাশে বসা তথ্যমন্ত্রী জালভোট ও নির্বাচনের সফলতা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীকে উপযাচক হয়েই পরামর্শ দিলেন। ফাঁস হয়ে যাওয়া অডিও-ভিডিও ক্লিপিংয়ের মাধ্যমে তার পুরোটাই দেশের মানুষ দেখেছেন বা জেনেছেন।

প্রধানমন্ত্রীর প্রতি তথ্যমন্ত্রীর ওই সযত্ন পরামর্শের দৃশ্যকথা প্রকাশ হওয়ার পর অনেককেই বলতে শোনা গেছে অন্য একটি কথা। তারা বলেছেন, এতদিন পর বোঝা গেল, তথ্যমন্ত্রীর অনবরত তেঁতুলপ্রীতির ব্যাপারটি প্রায়ই কেন প্রধানমন্ত্রীর মুখে চলে আসতো। কেন হেফাযত, আলেমসমাজ এবং ইসলামী শিক্ষা ও রাজনীতি নিয়ে তথ্যমন্ত্রীর বিচিত্র উপলব্ধির ধ্বনি প্রধানমন্ত্রীর মুখে প্রতিধ্বনিত হতো। প্রধানমন্ত্রী যাকে এত গুরুত্ব দেন এবং যিনি অনইয়ারে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে গুরুত্বপূর্ণ গোপন পরামর্শ করেন  তার উপলব্ধি ও দৃষ্টিভঙ্গির প্রভাব প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যে থাকা তো অস্বাভাবিক কিছুই নয়। তেঁতুল তো সেখানে কোনো ব্যাপারই নয়।

অবশ্য কেউ কেউ এ ধারণার সঙ্গে ভিন্নমত পোষণ করেন। তারা বলেন, প্রধানমন্ত্রীর মুখের বক্তব্য যা-ই থাকুক বাস্তব অবস্থা সম্পর্কে তিনি পুরোপুরি সচেতন। কারণ ওই কথোপকথনে তথ্যমন্ত্রী যখন ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে গণতন্ত্রের সফলতা এবং সংবিধানের সফলতা বলে ব্যাপক গণতান্ত্রিক-সাংবিধানিক আমেজ তৈরি করেছিলেন তখনই প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, জাসদের মুখ দিয়ে এখন গণতন্ত্রের কথা শুনতে হচ্ছে! (এরপর এক যৌথ অট্টহাসি)। তার মানে প্রধানমন্ত্রী বলতে চেয়েছেন, জাসদের মতো দলের নেতাদের মুখে গণতন্ত্রের কথা শোনা তো এক বিস্ময়ের ব্যাপার। তারা তো অতীতে সংবিধান ও গণতন্ত্রকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে সশস্ত্র রাজনীতি করেছে। সমকালীন রাজনীতিক ও সাংবাদিকরা বহুবার বলেছেন, স্বাধীনতার পর গণবাহিনী করে আওয়ামী লীগারসহ বহু বেসামরিক নাগরিককে হত্যা করেছে। বিপ্লবী সৈনিক সংস্থা গঠন করে

সেনাবাহিনীতে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করেছে এবং বেশ কিছু সেনা অফিসারকেও হত্যা করেছে। প্রধানমন্ত্রীর ভাষায়-জাসদের মুখে এখন গণতন্ত্রের কথা! শুনে মনে হয়েছে প্রধানমন্ত্রী স্বাধীনতার পর পর জাসদের সংবিধান-বহির্ভূত ও জঙ্গি রাজনৈতিক কর্মকান্ডের বিষয়ে একদমই বিস্মৃত হননি। তিনি স্পষ্টতই সচেতন আছেন, কার কার মুখে গণতন্ত্রের কথা পুরোপুরি বেমানান। এমনকি তিনি হয়তো চেয়েছেন নতুন প্রজন্মও এ বিষয়টা জানুক যে, স্বাধীন বাংলাদেশে সংবিধানের প্রতি অবজ্ঞা প্রকাশ করে আইন হাতে তুলে নিয়ে রক্তাক্ত রাজনীতি কারা শুরু করেছিল। এজন্যই তিনি জাসদের মুখে গণতন্ত্রের কথা! বলে প্রকাশ্যে

 

বিদ্রুপাত্মক আচরণ করেছেন। বাকি রাজনীতির নগদ হিসাবটা পায়ে মাড়িয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা এখন তার নেই। তাই জাসদকে সঙ্গে নিয়েই তাকে সংবিধান ও গণতন্ত্র রক্ষা করতে হচ্ছে। এ বিষয়ে আপাতত হয়তো কিছুই করার নেই।

একান্ত কথোপকথন প্রকাশ হওয়া ওই সংবাদ সম্মেলনের এক পর্যায়ে প্রধানমন্ত্রী এদেশের কম্যুনিস্টদের সঙ্গে তার সম্পর্ক বিষয়ে একটি গুরুত্বপূর্ণ কথা বলেছেন। তিনি বলেছেন, পাক্কা কম্যুনিস্টদের তিনি তার সঙ্গে নিয়ে এসেছেন। এখন যেসব কম্যুনিস্ট তার বলয় ও জোটের বাইরে রয়েছে তারা আসল কম্যুনিস্ট নয়। কেউ কেউ প্রধানমন্ত্রীর এই উক্তিটিকে

হেয়ালিপূর্ণ রসিকতা মনে করলেও আমাদের কাছে তা মনে হয়নি। মনে হয়েছে, রসিকতার আড়ালে তিনি একটি সত্য চিত্র  তুলে ধরেছেন। কারণ বাংলাদেশে যারা বাম রাজনীতি করেন তাদের সামনে এখন মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার নামে ইসলাম ও ধর্মপ্রাণ মুসলিমদের বিরোধিতা করা ছাড়া অন্য কোনো ইস্যু নেই। আর এই ইস্যুতে রাজনীতি, সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমে যারা সবচেয়ে বেশি সক্রিয় তাদের প্রায় সবাই বর্তমান সরকারের আশীর্বাদধন্য জীবন যাপন করছেন। রাজনীতির দৃশ্যপট তো সামনেই আছে, গত কিছুদিনের মধ্যে দুবার প্রধানমন্ত্রীর বাসভবনে পিঠা ও চায়ের দাওয়াতে সমবেত কবি-সাহিত্যিক, সুশীল-সাংবাদিকদের দেখলে সংস্কৃতি ও গণমাধ্যমের অঙ্গনটিও স্পষ্ট হয়ে যায়। বোঝাই যায় প্রধানমন্ত্রীর একটু হাসিমুখ বাহবা পাওয়ার জন্য এসব কম্যুনিস্ট বাক্যবাগিশ কতোটা মুখিয়ে থাকেন!

শুধু বোঝা যায় না, চিন্তা ও বক্তব্যের প্রভাব কিংব ধারা গ্রহণের ক্ষেত্রে কে কখন কার অনুগামী হন। 

 

 

advertisement