মুহাররম ১৪৩১   ||   জানুয়ারী ২০১০

মৃত্যুর স্মরণ

হযরত মাওলানা মুফতি তকী উছমানী

[হযরত মাওলানা মুফতী তাকী উছমানী কিছুদিন আগে বাংলাদেশ সফর করেছেন। সে সফরে ১৭ ফেব্রুয়ারি ’০৯ ঈ. সুন্নত চৌধুরী সাহেবের বাড়িতে মহিলাদের উদ্দেশে এই বয়ানটি করেছিলেন। তা রেকর্ড করা হয়েছিল। পরে তা কাগজে লেখা হয় ও অনুবাদ করা হয়। লিখেছেন মাওলানা সায়ীদ আহমদ, অনুবাদ করেছেন মাওলানা আবদুল্লাহ ফাহাদ। আলকাউসারের পাঠকদের জন্য তা ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করা হচ্ছে।]

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

এই চিন্তা-ভাবনা ও মানসিকতা তৈরির বিষয়ে সবচেয়ে বড় দায়িত্ব মহিলাদের। তারা প্রথম দিন থেকেই শিশুর মনে এই চিন্তার বীজ বপন করবে। আল্লাহ তাআলা মহিলাদেরকে উচ্চ মর্যাদা দান করেছেন। এত অধিক মর্যাদা দিয়েছেন যে, পুরুষের তাতে ঈর্ষা করা উচিত। কেননা, নারীর কোলেই জাতির ভবিষ্যত তৈরি হয়। ভবিষ্যতের বড় বড় আলেম মনীষী তাঁদের কোলেই লালিত-পালিত হয়। যাদের মধ্যে মানুষের ব্যক্তিত্ব গঠিত হয়। মহিলারাই এসব দায়িত্ব পালন করে থাকে।

আমি বলে থাকি, পৃথিবী এখন বড় বড় ইমাম ও বড় বড় ওলিকে চিনে। ইমাম আবু হানীফা, ইমাম শাফেয়ী, ইমাম মালেক, শায়খ আবদুল কাদের জিলানী, ইমাম গাযালী, শিবলী, জুনায়েদ যাদের ব্যক্তিত্ব ও বুযুর্গি গোটা বিশ্বে সমাদৃত। কিন্তু এটি কারো চোখে পড়ে না আবু হানীফার ইমাম আবু হানীফা হওয়ার পেছনে প্রথম ভূমিকা কার, গাযালিকে ইমাম গাযালি কে বানিয়েছেন, আবদুল কাদের জিলানীর শায়খ আবদুল কাদের জিলানী হওয়ার পেছনে কার ভূমিকা ছিল? বাস্তবিক পক্ষে তাঁদের মায়েরাই তাদেরকে এমনভাবে প্রতিপালন করেছেন, যার ফলে আল্লাহ তাআলা তাদেরকে এই মর্যাদায় অধিষ্ঠিত করেছেন। তাঁরা এমন মা ছিলেন, যারা নাড়ি ভেদ করে ক্ষুধার যন্ত্রণা সহ্য করে নিজের সন্তানদেরকে জ্ঞান ও প্রজ্ঞা দ্বারা সুসজ্জিত করেছেন এবং তাদের মাঝে আখিরাতের চিন্তা সৃষ্টি করেছেন। তাঁরা এমন মা ছিলেন যারা সূরা ইয়াসীন পাঠ করে সন্তানকে দুধ পান করাতেন, সন্তানকে সর্বপ্রথম ‘লা ইলাহা ইল্লাল্লাহ’ শিক্ষা দিতেন। যারা সন্তানকে এমনভাবে তরবিয়ত করেছেন যেন সে স্বভাবগতভাবে সত্যভাষী, আমানতদার ও শরীয়তের অনুগামী হয়ে গড়ে ওঠে। সে হালাল-হারামের পার্থক্য বুঝবে, সুন্নতের অনুসারী হবে। তাদের অন-রে এই ভাবনা সর্বদা বিরাজমান ছিল যে, এই সন্তানের তরবিয়তের দায়িত্ব আমার। আজ সেসব মায়েদের নাম কেউ জানে না। তাই আমি বলছি যে, পুরুষদের চেয়ে বেশি মর্যাদা সেসব মায়েরা। কেননা, মনে করুন, একজন আলেম কিংবা আল্লাহ ওয়ালা দুনিয়াতে খুব প্রসিদ্ধি লাভ করলেন। এতে কিন্তু প্রসিদ্ধির ফেতনাও থেকে যায়। আল্লাহ না করুন-তার মধ্যে সুনাম-সুখ্যাতির চিন্তাও আসতে পারে, তার মধ্যে অহংবোধও জাগ্রত হতে পারে, উজবও হতে পারে। কিন্তু পিছনের সে অজানা-অপরিচিতা মা, যার কথা কোথাও পাওয়া যায় না, যাকে কেউ চেনেও না তিনি তো শুধু ইখলাছের সঙ্গে জাতির বুনিয়াদ স্থাপন করে যাচ্ছেন; যার মধ্যে শয়তানের ধোঁকার কোনো সম্ভাবনাও নেই।

সে মায়েরা কীভাবে সন্তানকে লালন-পালন করেছেন! হযরত রবীআতুর রায় যিনি হযরত ইমাম মালেক রাহ.-এর উস্তাদ। তার পিতা বিয়ের পরপরই জিহাদে চলে গিয়েছিলেন। দীর্ঘ সময়ের জিহাদ ছিল। আনুমানিক ২২ বছর তিনি জিহাদে থাকার পর মদীনা মুনাওয়ারায় ফিরে এলেন। বাড়ি ফিরে গৃহে প্রবেশ করার সময় দেখলেন, এক যুবক তার ঘর থেকে বের হচ্ছে। তিনি মনে করলেন, কোনো অপরিচিত মানুষ। তিনি তাকে ধমক দিলেন-তুমি আমার ঘরে প্রবেশ করলে কীভাবে? একপর্যায়ে তাদের মাঝে ঝগড়া বেধে গেল। ভিতর থেকে স্ত্রী বলল, ঝগড়া করবেন না। সে আপনার ছেলে। মসজিদে নববীতে নামায পড়তে গিয়ে লোকদের একটি বড় মজলিস দেখতে পেলেন, যারা হাদীস পড়তে এসেছেন। চেহারা চাদরাবৃত ছিল এজন্য তিনি তাকে চিনতে পারেননি। তিনিও দরসে বসে পড়লেন। পরবর্তীতে জানতে পারলেন, তা তার ছেলের দরস ছিল। ইনি রবীআতুর রায়-ইমাম মালেকের উস্তাদ ছিলেন।

হযরত রবীআতুর রায় রাহ.-এর পিতা একদিন স্ত্রীকে জিজ্ঞাসা করলেন, আমি তোমাকে দশ হাজার দিনার দিয়েছিলাম। তোমার কোনো কষ্ট হয়নি তো? উত্তরে স্ত্রী বললেন, আমি দশ হাজার দিনার এই ছেলের লালন-পালনে খরচ করেছি। নিজের সকল প্রয়োজন উৎসর্গ করেছি এবং আপনার এই ছেলেকে হাদীসের ইলম শিক্ষা দেওয়ার জন্য ২২ বছর পর্যন্ত আমি এমনটি করেছি। রবীআতুর রায়কে তো আজ সবাই চিনে, তাকে ইমাম মালেকের উস্তাদ বলে। কিন্তু যে মা সবকিছু উৎসর্গ করে এই মানুষটিকে তৈরি করেছেন, এই আলেমকে সৃষ্টি করেছেন তাকে কেউ চিনে না। সুতরাং সে মায়ের মর্যাদা নিঃসন্দেহে রবীআতুর রায় থেকে হাজার গুণ বেশি হবে। যিনি এত ইখলাছের সঙ্গে, এত কিছু উৎসর্গ করে এই মানুষটিকে গঠন করেছেন। আল্লাহ তাআলা মহিলাদেরকে এমনই মর্যাদা দান করেছেন। কিন্তু আফসোসের বিষয়, আজ পশ্চিমা প্রচারণার ফলে মহিলারা তাদের মর্যাদা ভুলে গেছে। তাদেরকে এই মর্যাদার কথা ভুলিয়ে দেওয়া হয়েছে। ইংরেজ ও পশ্চিমা শক্তির অপপ্রচার মহিলাদেরকে বুঝিয়েছে যে, তোমাদেরকে ঘরের চার দেওয়ালের ভিতরে আবদ্ধ করে রাখা হয়েছে। অথচ তোমার তো পুরুষের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করার কথা। তুমিও বের হও, তুমিও রাষ্ট্রপ্রধান হও, তুমিও প্রধানমন্ত্রী হও, তুমিও বড় বড় পদ লাভের চেষ্টা কর। তোমাকে কেন তা থেকে বঞ্চিত করা হবে? ফলে মহিলারা ধোঁকায় পড়ে গেছে এবং ঘর থেকে বের হয়ে গেছে। এ ধোঁকায় তাকে ঘর থেকে বের করা হয়েছে যে, তোমাকে প্রধানমন্ত্রী বানানো হবে, রাষ্ট্রপ্রধান বানানো হবে, উচ্চ পদ প্রদান করা হবে।

আজ আমেরিকার অবস্থা দেখুন, আমেরিকার ইতিহাসে কোনো মহিলা রাষ্ট্রপ্রধান হয়নি। কিছুদিন আগে একজন প্রার্থী হয়েছিল কিন্তু পরাজিত হয়েছে। রাষ্টপ্রধান তো কেউ হতে পারেনি। কিন্তু লক্ষ লক্ষ মহিলাকে রাস্তায় বের করা হয়েছে। পৃথিবীর যত নিকৃষ্টতম কাজ আছে তা মহিলাদেরকে দেওয়া হয়েছে। রাস্তা পরিষ্কার করছে মহিলারা, হোটেলে বেয়ারার কাজও তারা করছে। হোটেলে পুরুষদের বিছানার চাদর সাজানোর দায়িত্ব মহিলাদের, তাদের ঘরবাড়ি পরিচ্ছন্ন করার কাজও মহিলারা করছে। এছাড়া আরো নিকৃষ্টতম কাজ তাদের উপর ন্যস্ত করা হয়েছে। অথচ এই মহিলা যদি নিজের ঘরে নিজের জন্য, নিজের স্বামীর জন্য এবং নিজের সন্তানের জন্য রান্না করে তখন তা লজ্জার চোখে দেখা হয় এবং তা পশ্চাদপদতা হয়ে যায়! (চলবে ইনশাআল্লাহ)

 

advertisement