মুহাররম ১৪৩১   ||   জানুয়ারী ২০১০

অহংকার থেকে সাবধান!

হাফেযা সামিয়া হাফিয

আমি কুরআন পাকের হাফেযা। দশ বছর বয়সেই আমি পবিত্র কুরআন হেফয করেছি। আমাদের দলে আমি ছিলাম সবচেয়ে ছোট্ট বালিকা, কিন্তু ইয়াদ ছিল সবচেয়ে বেশি। আব্বাজান যখনই আমাকে ডেকে পবিত্র কুরআনের যে কোনো স্থান থেকে শুনতে চাইতেন তখন কোনো উদ্বেগ ও পেরেশানী ছাড়া তাকে শুনিয়ে দিতাম। অবশ্য আব্বাজান ছাড়া অন্য কেউ এমন শুনতে চাইলে আমার প্রাণ বের হয়ে যেতে চাইত। ভয়ে শ্বাস বন্ধ হয়ে যেত, গলা শুকিয়ে যেত। এজন্য কেন্দ্রীয় বোর্ডের অধীনে পরীক্ষায় অংশ নেওয়ার চিন্তা মাথায় আসলে খুব ভয় লাগত। অন্য বালিকারা তখন আমাকে পরামর্শ দিল-‘তাহাজ্জুদের নামায পড় এবং আল্লাহ তাআলার কাছে দুআ কর।’

যেদিন কেন্দ্রীয় বোর্ডের পরীক্ষা যেদিন, সেদিন আমি তাহাজ্জুদের নামায পড়ে দুআ করি। তাহাজ্জুদের নামায পড়ার পর অন্তর এতটাই প্রশান্ত হয়ে যায় যা আমি ভাষায় ব্যক্ত করতে পারব না। পরীক্ষা শুরু হলে দেখা গেল সিরিয়ালে প্রথম নম্বরটিই আমার। কিন্তু তখন ভয়ের পরিবর্তে আমি ছিলাম অত্যন্ত প্রশান্ত। পরীক্ষক সাহেবা আমাকে যা কিছু এবং যেখান যেখান থেকে জিজ্ঞাসা করলেন তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়ে গেছি। কোথাও আমার কোনো ভুল হয়নি। ফলাফলে দেখা গেল আমি পূর্ণ ১০০ নম্বর পেয়েছি। যেহেতু ছয় বছর বয়স থেকে আমি পবিত্র কুরআন হেফয শুরু করেছিলাম সেজন্য বাসায় বসে প্রাইভেটভাবে স্কুলের পড়াশোনা চালিয়ে যাই। যখন নবম শ্রেণীতে আমার স্কুলে ভর্তি হওয়ার সময় হল তখন অষ্টম শ্রেণীতে বোর্ডের অধীনে অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় সনদ দেখিয়ে ভর্তি করার নিয়ম চালু হল। বোর্ডের অধীনে পরীক্ষা দেওয়ার কোনো প্রস্তুতি আমার ছিল না। আম্মা আমাকে বললেন, তাহাজ্জুদের নামায পড় এবং নিজের সহজ সাফল্যের জন্য দুআ কর।’

তোমরা বিশ্বাস করো, আমি তাহাজ্জুদের নামায পড়ে পরীক্ষা দিতে যেতাম এবং প্রশ্নপত্রে সেটাই আসত, যা আমার মুখস্থ থাকত। পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ফলাফল প্রকাশ হওয়া পর্যন্ত তাহাজ্জুদের নামায পড়ে পরীক্ষার ভালো ফলাফলের জন্য দুআ করে যেতে লাগলাম। ফলাফল প্রকাশের দিনও অনেক দুআ করলাম। ফলাফল যখন প্রকাশ হল আনন্দে আমি আটখানা হয়ে গেলাম। বিশ্বাসই হচ্ছিল না, এত ভালো ফলাফল আমার হতে পারে। আমি আমার মহল্লা ও থানার মাঝে সবচেয়ে ভালো ফলাফলের অধিকারী হলাম এবং বৃত্তি পেলাম। সবাই আমার প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে গেল। তারা বলাবলি করতে লাগল, এই মেয়েটা বড় ভালো! নিয়মিত সে তাহাজ্জুদ পড়ে এবং তার ওপর আল্লাহর রহমতও রয়েছে।’ সেদিনের পর থেকে আমার মাঝে ধীরে ধীরে অহংকার দানা বেঁধে উঠে। নামায পড়া ও দুআ করার প্রতিও সেই আগ্রহ আর আমার মাঝে থাকল না, যা আগে ছিল। তাহাজ্জুদের নামায কখনো শুধু এজন্য পড়তাম যেন লোকের মাঝে আমার প্রশংসা চালু থাকে এবং আমার প্রতি আল্লাহর খাছ রহমত রয়েছে-এটা বলাবলি হতে থাকে।

এরপর থেকে আমার মেধা ও স্মৃতিশক্তি দুর্বল হয়ে গেল। ক্লাসে নানা সমস্যায় পড়তে থাকলাম। যে পড়াটা বাসায় ভালোভাবে মুখস্থ করে যেতাম স্কুলে গিয়ে শোনানোর সময় কিংবা লেখার সময় সেটাও ভুলে যেতাম। শিক্ষিকাও আর আমাকে ভালো চোখে দেখতেন না। একবার ক্লাস শিক্ষিকা ছাত্রীদের বিভিন্ন দলে ভাগ করে দিচ্ছিলেন। দলনেতাদের মাঝে এক ছাত্রী ছিল হাফেযা। যখন শিক্ষিকা বললেন, হাফেযা ছাত্রীর দলে কে যেতে চাও তখন আমি হাত উঠালাম। হাফেযা ওই ছাত্রীটি তখন মুখ ঘুরিয়ে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলল, আমি তাকে আমাদের দলে নিতে চাই না।’ আসলে অযোগ্য ভেবে কেউ আর আমাকে তাদের দলে নিতে চাচ্ছিল না। তখন শিক্ষিকা আমার প্রতি কিছুটা বিদ্রূপ করেই তাকে বললেন, সমস্যা নেই, তোমার দলে তাকে নিয়ে নাও। সওয়াব হবে।’ কথায় বলা হয়, কথার আঘাত তীরের জখমের চেয়েও মারাত্মক হয়ে থাকে, সরাসরি যা অন্তরে গিয়ে বিঁধে। আমার শিক্ষিকার এই কথাটিও আমার অন্তরে গিয়ে বিঁধেছিল। কিন্তু এটা ছিল আমার অহংকারেরই পরিণতি। নবম শ্রেণীর বার্ষিক পরীক্ষাতেও আমার ফলাফল অনেক খারাপ হয়েছে।

আমি সব কিশোর-কিশোরী পাঠকদের কাছে অনুরোধ করব-কখনো অহংকার করবে না। অহংকার এমন একটি রোগ, যা সব কিছু ধ্বংস করে মানুষকে অন্তঃসারশূন্য করে ফেলে। তোমরা আমার জন্য দুআ করো, আল্লাহ তাআলা যেন আমাকে ক্ষমা করে দেন। তিনি বড়ই ক্ষমাশীল, দয়ালু। তিনি যেন আমাকে অন্তর দিয়ে তাহাজ্জুদের নামায পড়ার তাওফীক দেন, আমার দুআগুলোর মাঝে ব্যাকুলতার সৃষ্টি করে দেন, আমাকে পাঁচ ওয়াক্ত নামাযী বানিয়ে দেন এবং নিয়মিত কুরআন তিলাওয়াত করার ও তার উপর আমল করার তাওফীক দান করেন।

[শিশু-কিশোর ম্যাগাজিন, ‘বাচ্চুঁ কা ইসলাম’ থেকে অনূদিত।] অনুবাদ : আবু তাশরীফ

 

advertisement